ঝড়-জলোচ্ছ্বাস হলেই বড় ক্ষতির আশঙ্কা লক্ষ্মীপুরে
ঘূর্ণিঝড় মোখাসহ আগামী ৩ বছরের মধ্যে যেকোন ধরনের ছোট বড় ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস হলেই বড় রকমের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন মেঘনা নদীপাড়ের জেলা লক্ষ্মীপুরের দক্ষিণাঞ্চলের বাসিন্দারা।
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস হলেই ঝূঁকিতে পড়বে জেলার কমলনগর ও রামগতি উপজেলা রক্ষাকারী ৩১শ' কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প। একারণেই ঘূর্ণিঝড় মোখা নিয়েও তাদের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই।
সরেজমিনে ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রস্তুতির বিষয় জানতে গেলে শুক্রবার (১২ মে) মেঘনা নদীর তীরে অবস্থানকারী স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা এমন আশঙ্কার কথা জানান।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে এই বাঁধ প্রকল্পের অধীনে - চলতি অর্থবছরে প্রায় দুইশ কোটি টাকার কাজ চলমান রয়েছে। প্রকল্পের কিছু অংশের কাজের মেয়াদ চলতি বছরের জুন মাসে শেষ করার কথা রয়েছে। তবে বাদবাকী কাজ শেষ হতে আরো ৩ বছর লাগবে।
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, মেঘনানদীর পূর্বপাড়ের জেলা লক্ষ্মীপুরের ৩৩ কিলোমিটার এলাকায় নদীতীর রক্ষায় ৩ হাজার ৮৯ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি বাঁধনির্মাণ প্রকল্প চলমান রয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় ২০২২ সাল থেকে বাঁধ নির্মাণের প্রাথমিক কাজ বা নদীতে জিও ব্যাগ ডাম্পিং চলছে ।
কমলনগরের মাতব্বরহাট এলাকার দক্ষিণপাশে দাঁড়িয়ে সেখানকার বাসিন্দা মো. কবির জানায়, ঝড়ের কারণে অতিমাত্রায় জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস হলে জিও ব্যাগ স্থানচ্যুত হয়ে নদীতে পড়ে যেতে পারে। এমন হলে, ঠিকাদাররা আর দ্বিতীয়বার নির্মাণ করবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
পাটোয়ারিরহাট এলাকার বাসিন্দা রাকিব হোসেন লোটাস জানান, আসন্ন ঘূর্ণিঝড় মোখাসহ এ প্রকল্প চলাকালীন সময়ে যেকোন ছোট বড় ঘূর্ণিঝড়ে বাঁধের জিও ব্যাগ নষ্ট হলে বা অন্য কোন ক্ষতি হলে– এলাকার বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। কারণ তাহলে ঠিকাদার কিংবা কর্তৃপক্ষ কেউই দায় নিবে না। তাই আমাদের আশঙ্কা এমন ক্ষতির পর ঐ এলাকায় আর কোন বাঁধ নির্মাণ হয়তো হবে না।
অন্যদিকে নদী ভাঙ্গনের ভুক্তভোগী মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করা স্থানীয় সামাজিক সংগঠন 'কমলনগর-রামগতি বাঁচাও মঞ্চ'- এর আহ্বায়ক এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আবদুস সাত্তার পালোয়ান বলেন, 'কিছু অসৎ ঠিকাদার সব সময় দূর্নীতির ফাঁকফোকর খোঁজে। আসন্ন যে কোন ঘূর্ণিঝড় কিংবা আমবস্যা ও পূর্ণিমার উচ্চ জোয়ারের কারণে বাঁধের জিও ব্যাগের সামান্য ক্ষতি হলে ঠিকাদাররা সে অজুহাত দেখিয়ে বড় দুর্নীতির সুযোগ পেয়ে যাবে। তারা হয়তো কাজ না করেও বলবে, সেখানে কাজ হয়েছে, কিন্তু নদীতে তলিয়ে গেছে'।
আবদুস সাত্তার পলোয়ান বলেন, এত বড় একটি প্রকল্প চলছে কোন রকম তদারকি ছাড়াই চলার বিষয়ে শুরু থেকেই আমার প্রতিবাদ করে আসছি। জিও ব্যাগের যে কাজ হচ্ছে, তাও দায়সারাভাবে করা হচ্ছে। জিও ব্যাগ রক্ষায় এখনো বড় প্রতিরক্ষা তৈরি করা হয়নি। ফলে ঝড় ও জোয়ার জলোচ্ছ্বাসকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলের মানুষের বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘ তিন যুগের বেশির সময় ধরে মেঘনা নদীর তীব্র ভাঙ্গন চলছিল লক্ষ্মীপুরের উপকূলীয় কমলনগর ও রামগতি উপজেলায়। এতে প্রায় ৩শ বর্গকিলোমিটার এলাকা মেঘনায় বিলীন হয়ে যায়।
নদী ভাঙ্গন থেকে রক্ষার জন্য ২০২১ সালের ১ জুন তারিখে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ৩ হাজার ৮৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়।
প্রকল্পের আওতায় মেঘনাপাড়ে ৩৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ নির্মাণ করা হবে। ৩ ধাপের কাজের প্রথম ধাপ হচ্ছে- নদীপাড়ে বালু ভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে পানির তীব্র স্রোত বন্ধ করা। ২য় ধাপে জিও ব্যাগের ৩০ মিটার দূরে মাটি দিয়ে উঁচু বাঁধ নির্মাণ করা হবে। ৩য় ধাপে বাঁধের ওপর পাথরের তৈরি ব্লক ফেলে বাঁধ সংরক্ষণ করা হবে।
২০২১ সালের আগস্ট থেকে কয়েকটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকার কাজের টেন্ডার আহবান করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে ৯৯টি লটে কাজ পায় ঠিকাদাররা। প্রতি লটে ৩শ ৩০ মিটার বাঁধ নির্মাণ করা হবে। ২০২২ সালের ৯ জানুয়ারি লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের মাতাব্বর হাটে কাজের উদ্বোধন করেন পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অবঃ) জাহিদ ফারুক।
স্থানীয়রা জানায়, উদ্বোধনের পর দীর্ঘসময় বালুর অভাব দেখিয়ে কয়েক মাস কাজ বন্ধ ছিল। চলতি বছরে কয়েকটি পয়েন্টে শুধুমাত্র জিও ব্যাগের কাজের কিছুটা অগ্রগতি হয়। মাত্র একটি পয়েন্টে ৩শ' মিটারের একটি বাঁধ তৈরি হয়। অন্য সবগুলো পয়েন্ট পুরো অরক্ষিত।
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ফারুক আহমেদ জানায়, বর্তমানে কোন ঘূর্ণিঝড় ও বড় জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলায় রামগতি কমলনগর উপজেলার ৩৩ কিলোমিটার নদীর তীরে বাঁধ নেই ।
বাঁধ নির্মাণের জন্য টেন্ডার হওয়া ৯৯টি লটের মধ্যে ৪৩ লটে প্রায় ১৪ কিলোমিটার বাঁধ নিমার্ণের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ১৩ কিলোমিটার এলাকায় জিও ব্যাগের ড্যাম্পিং শুরু হয়েছে। কিন্ত একটি পয়েন্টেও ড্যাম্পিং শেষ হয়নি। এর মধ্যে মাত্র ৪ কিলোমিটার এলাকায় ৫০-৮০ ভাগ ড্যাম্পিং কাজ শেষ হয়েছে । যা ৩৩ কিলোমিটার পুরো প্রকল্পের ১০-১৫ ভাগ । ৩ হাজার কোটির টাকার প্রকল্পে এপর্যন্ত প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকার কাজের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিল মাসের পর থেকে মাত্র ৮টি লটে (প্রতি লটে ৩৩০ মিটার) কাজ চলছে।
নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, জিও ব্যাগ নদী ভাঙ্গন ঠেকাতে পারলেও বাঁধ শেষ না হলে ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সাথে তা লড়াই করতে পারবে না। সেক্ষেত্রে ঝড় বা ভারী জলোচ্ছ্বাসে বাঁধের জিও ব্যাগের ক্ষতির আশঙ্কা থাকবেই।