মা দিবসের এমন বাণিজ্যিকীকরণ চাননি দিবসটির বিস্মৃত স্রষ্টা অ্যানা জারভিস
ফিলাডেলফিয়ায় বন্ধুর রেস্তোরাঁয় খেতে বসেছিলেন অ্যানা জারভিস। একটা সালাদের অর্ডার দিয়েছিলেন, সেটা আসার পর মেঝের ওপর পুরোটা ছড়িয়ে দিলেন তিনি।
জারভিস সালাদটি পছন্দ করেনি এর নামের জন্য। "মাদার'স ডে সালাদ" নামক খাবারটি নাম রাখা হয়েছিল কয়েক বছর আগে তার উদ্যোগে শুরু হওয়া মায়েদের উদযাপন করার দিবসটির নামে।
জারভিসের কাছে মনে হয়ছিল, খাবারের ওরকম নামে মাকে সম্মানের কোনো বিষয় জড়িয়ে নেই, বরং সেটা সস্তা মার্কেটিংয়ের পদ্ধতি। জারভিস মা দিবসকে কেবল তার একান্ত নিজস্ব ধারণা বলে মনে করতেন। এটি থেকে কেউ ব্যবসায়িকভাবে লাভ করুক, সেটা কখনোই চাননি তিনি।
জারভিসের কাজ ও মা দিবস আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে যাওয়া নিয়ে গবেষণা করেছেন ইতিহাসবিদ ক্যাথারিন আন্তোলিনি।
আজকের দিনে মা দিবস পুরোদস্তুর ব্যবসায়িক রূপ পেয়েছে। কিন্তু এমন কিছু না ঘটার জন্য জীবদ্দশায় কয়েক দশক ধরে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন জারভিস। তার কাছে মা দিবস ছিল স্রেফ মায়েদেরকে সম্মান করার জন্য একটা দিন। তাই যখন মানুষ অন্য উদ্দেশ্যে মা দিবসকে ব্যবহার করতে শুরু করলেন, তখন যারপরনাই বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন জারভিস।
এ কারণে তিনি এমন চর্চার বিরুদ্ধে একপ্রকার লড়াই শুরু করেন। মামলা করার হুমকি দিয়েছিলেন। বিভিন্ন রাজনীতিবিদদের চিঠি লেখেন, মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলাপে বসারও চেষ্টা করেছিলেন।
দিনটির জন্য আইনগত কপিরাইটও চেয়েছিলেন অ্যানা জারভিস, বলেন আন্তোলিনি। নিজের চিঠিগুলো তিনি স্বাক্ষর করতেন, "অ্যানা জারভিস, ফাউন্ডার অভ মাদার'স ডে" হিসেবে।
'এটা তার পরিচিতির অংশ হয়ে উঠেছিল,' বলেন এ ইতিহাসবিদ। 'পুরো ব্যাপারটা তার ইগোর সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল।'
কিন্তু তার এ লড়াই শেষ পর্যন্ত কোনো কাজে আসেনি। উত্তরাধিকারসূত্রে যা অর্থসম্পদ পেয়েছিলেন, সবই এসব করতে গিয়ে খোয়ান। ৮৪ বছর বয়সে এক স্যানিটেরিয়ামে একাকী, অন্ধ ও কপর্দকশূন্য অবস্থায় মারা যান অ্যানা জারভিস।
আজকের দিনে বিশ্বব্যাপী মা দিবস কীভাবে উদযাপিত হয়, তা দেখলে তার মিশ্র অনুভূতি হতো বলে মনে করেন আন্তোলিনি। মা দিবস জনপ্রিয় হয়েছে দেখে জারভিস আনন্দিত হতেন, কিন্তু তাকে যে কেউ মনে রাখেনি, সে কথা ভেবে হয়তো বিমর্ষ হয়ে যেতেন।
মা দিবসকে পুঁজিবাদের মাধ্যমে উদযাপনের জন্য হয়তো তিনি মারাত্মক সংক্ষুব্ধও হতেন।
ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার গ্র্যাফটনে ইন্টারন্যাশনাল মাদার'স ডে শ্রাইন নামক একটি চার্চে প্রথমবারের মতো মা দিবস উদযাপন করা হয়। ওই চার্চের রান্নাঘরে জারভিসের বিভিন্ন কাগজপত্র খুঁজে পান আন্তোলিনি। নিজ দায়িত্বে সেগুলো আর্কাইভ করার কাজ করেন তিনি। সে সুবাদে এসব কাগজপত্র পড়েছিলেন এ গবেষক।
অ্যানা জারভিসের নিজের কোনো সন্তান ছিল না। কিন্তু মায়েদের জন্য একটি দিবস তৈরি করতে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন তিনি।
ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার ওয়েবস্টারে জন্মগ্রহণ করেন জারভিস। তার মা অ্যান রিভস জারভিসের কাছ থেকে মা দিবস তৈরির উৎসাহ পেয়েছিলেন তিনি।
অ্যান জারভিস সানডে স্কুলে পড়াতেন। মাদার'স ডে ওয়ার্ক ক্লাবস নামক একটি সংঘ শুরু করেছিলেন তিনি, সেখানে অন্য নারীদেরকে তাদের সন্তানের যত্নআত্তি নেওয়ার বিদ্যা শেখানো হতো ।
১৮৭৬ সালে ক্লাসে পড়ানো শেষে অ্যান জারভিস প্রার্থনা করেছিলেন, কেউ একজন কোনো একদিন সমাজে মায়েদের অবদানের কথা ভেবে তাদের জন্য একটি দিবসের সূচনা ঘটাবে।
অ্যানা জারভিসের বয়স তখন ১২ বছর। মায়ের ওই প্রার্থনা তার মনে গেঁথে গিয়েছিল।
তার মা মারা যান ১৯০৫ সালে। জারভিসের বয়স তখন ৪০-এর কোঠায়। মায়ের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তিনিই মায়ের প্রার্থনাকে বাস্তব রূপ দেবেন।
পরের বছরগুলোতে জারভিস আমেরিকার প্রতিটি রাজ্যের গভর্নরদের চিঠি লেখেন মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে মা দিবস ঘোষণা দিতে। জারভিসের মায়ের মৃত্যু দিনের সবচেয়ে কাছাকাছি রোববার ছিল সেটি।
মার্ক টোয়েন, প্রেসিডেন্ট থিওডর রুজভেল্টসহ আর যত প্রভাবশালী রাজনৈতিকের কথা মনে করতে পেরেছিলেন, সবাইকে চিঠি লিখেছিলেন অ্যানা জারভিস। নিজের বন্ধু ও ফিলাডেলফিয়ার ব্যবসায়ী ওয়ানামেকারের সহায়তাও চেয়েছিলেন তিনি। এ বন্ধুর খাবারে দোকানেই মা দিবসের সালাদ ফেলে দিয়েছিলেন তিনি।
১৯০৮ সালে প্রথমবারের মতো গ্রাফটনের ওই চার্চে মাদার'স ডে সার্ভিস অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন বিকেলে পেনসিলভানিয়ায় আরও একটি বড় অনুষ্ঠান হয়েছিল দিনটি উপলক্ষ্যে। সেখানে বক্তব্য রেখেছিলেন জারভিস।
এর দুই বছর পরে সবার প্রথমে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া দিনটিকে স্বীকৃতি দিয়ে একটি আইন পাস করে। তারপর অন্য রাজ্যগুলোও মা দিবস উদযাপন করা শুরু করে।
কিন্তু জারভিসের কাজ তখনো শেষ হয়নি।
মা দিবসকে জাতীয় ছুটির দিন করতে তোড়জোড় শুরু করেন জারভিস। গাঁটের পয়সা খরচ করে সারা আমেরিকা ঘুরে বেড়াতে আর চিঠি লিখতে শুরু করলেন তিনি।
১৯১৪ সালে ৮ মে মার্কিন কংগ্রেস মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে মা দিবস ঘোষণা করে আইন পাস করে। পরের দিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন মা দিবসকে যুদ্ধে মারা যাওয়া সন্তানদের মায়েদেরকে সম্মান জানানোর দিন হিসেবে একটি ঘোষণা জারি করেন।
মা দিবস তো জাতীয় দিবসে পরিণত হলো। কিন্তু যা হলো, তেমনভাবে হওয়ার পরিকল্পনা করেননি জারভিস।
দিবসটি উপলক্ষ্যে ফুলের দোকানের মালিক, কার্ড প্রস্তুতকারী, ও চকলেট ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে শুরু করেন। এর প্রতিবাদে প্রতিবছর এসব ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সমাবেশ করতে শুরু করেন জারভিস।
১৯৮৬ সালে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পত্রিকাগুলোর কাছে লেখা এক চিঠিতে জারভিস অভিযোগ করেছিলেন, 'তারা আমার মা দিবসকে বাণিজ্যিকীকরণ করে ফেলছে। এমনটা তো আমি চাইনি।'
১৯২৩ সালে মাদার'স ডে মিটিংয়ের একটি পরিকল্পনা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে জারভিস নিউ ইয়র্কের গভর্নর আল স্মিথের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দেন। এ দিবসটি নিয়ে তৎকালীন ফার্স্ট লেডি এলেনর রুজভেল্টের সঙ্গেও লড়াই হয়েছিল তার।
১৯৩০-এর দশকে গ্রেট ডিপ্রেশনরে সময় আমেরিকার বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা অর্থ উত্তোলনের চিন্তা করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল দরিদ্র মায়েদের ওই অর্থ দিয়ে সহায়তা করা। কিন্তু এ পরিকল্পনাতেও তীব্র বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন জারভিস।
আন্তোলিনি বলেন, 'তিনি চাননি দিনটি ভিক্ষুকদের একটি দিনে পরিণত হতে, স্রেফ আরেকটি চ্যারিটি ইভেন্টে রূপ নিতে। আপনি মায়েদের দয়া দেখাতে পারেন না, তাদেরকে সম্মান করেন।'
জারভিস ছিলেন নাছোড়বান্দা ও মারাত্মক স্বাধীনচেতা একজন নারী। নিজে কখনো বিয়ে করেননি, মাও হননি। যদিও তিনি যে মার্কিন সমাজে যে সময়ে বেঁচেছিলেন, তখন নারীদের থেকে মানুষ উল্টোটাই আশা করত।
আন্তোলিনি মনে করেন, জারভিসের দাবি ও যুক্তিগুলো সঠিক ছিল। 'মা দিবসকে এভাবে পরিবর্তন করে ফেলার জন্য তার রাগ হওয়ার বিষয়টি যথেষ্ট যৌক্তিক,' বলেন তিনি।
তবে এ ইতিহাসবিদের ভাষ্যে, মাতৃত্ব সম্পর্কে কিছুটা সংকুচিত দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অ্যানা জারভিসের। জারভিস মাকে দেখেছিলেন একজন শিশু, একজন কন্যার চোখ দিয়ে, যে তার মাকে তীব্রভাবে ভালোবেসেছিল।
১৯৪০-এর দশকের শুরু থেকে অপুষ্টিতে ভুগতে শুরু করেন জারভিস। একইসঙ্গে চোখের দৃষ্টিশক্তিও হ্রাস পেতে থাকে। বন্ধু ও অন্য সহযোগীরা তাকে ওয়েস্ট চেস্টারের একটি স্যানিটারিয়ামে রেখে আসেন। সেখানে ১৯৪৮ সালের ২৪ নভেম্বর মারা যান অ্যানা জারভিস।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মা দিবস এখন সবচেয়ে লাভজনক ছুটির দিনগুলোর একটি।
আন্তোলিনি বলেন, মা দিবসের এমন বাস্তবতা দেখতে পেলে রাগে ফেটে পড়তেন জারভিস।