যেভাবে বদলে যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে বন্ধুত্ব
'বন্ধু ছাড়া জীবন অচল'-এ ধরনের কথা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। কিন্তু বন্ধুত্বের মূল্য কতখানি তা কিসের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়? স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম 'এল-পাইস' এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিছু মানদণ্ডের ভিত্তিতে এটি নির্ধারণ করা যেতে পারে: একজন বন্ধু কি শুধুই একজন চেনাজানা সঙ্গী, যাকে নিয়ে মাঝেমধ্যে নানা পরিকল্পনা করা যায়? নাকি বন্ধু মানে এমন কেউ, যার সাথে আপনি নিজের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিতে পারেন, যে দুঃসময়ে আপনার পাশে এসে দাঁড়ায় এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে আপনার পাশে থাকে? অথবা বন্ধু মানে শুধুই এমন একজন মানুষ যার সাথে আপনি দীর্ঘদিন যাবত সম্পর্ক বজায় রাখছেন এবং যার সঙ্গে নিজের অতীত সম্পর্কে সবকিছু বলেন?
অতীতে 'বন্ধু' শব্দের অর্থ যা-ই ছিল না কেন, আমাদের জীবনে সোশ্যাল মিডিয়ার উপস্থিতি আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগের আবেদনকে অনেকটাই ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে নিয়ে গিয়েছে এবং বন্ধুত্বের নতুন ধারণার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে, যেখানে বন্ধুত্বের প্রথাগত সংজ্ঞা পাল্টে গিয়েছে। দুজন মানুষ একে অপরকে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনুসরণ না করেও কি বন্ধু হতে পারে না? অথবা বিপরীতভাবে বলা যায়, শুধুমাত্র ইনস্টাগ্রাম বা টিকটকে একে অন্যের সাথে মিথস্ক্রিয়া করা ব্যক্তিরা কি সত্যিই 'বন্ধু' হিসেবে বিবেচিত হবে?
'লো কে হায়' (রিজারভয়্যের বুকস,২০২২) বইয়ের লেখক সারা তরেস 'সিবেরলোকিউটোরিও' নামক একটি পডকাস্টে বন্ধুত্বের বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। "যেসব মানুষকে আমরা একটি বিশেষ সম্মানের জায়গা দিয়ে থাকি, তাদেরকেই কি আমরা বন্ধু ভাবি? আমরা কি কাউকে 'বন্ধু' বলে ডাকি এই কারণে যে আমরা তার জগতের একটা অংশ জুড়ে থাকতে চাই?" এই প্রশ্নগুলোর ভিত্তিতে একই পডকাস্টের পরবর্তী এপিসোডেও বন্ধুত্বের ভাঙন এবং এর পরবর্তী শোক নিয়ে কথা বলা হয়। পরিচালনা, বিনিয়োগ, ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি অর্থনৈতিক বিষয়গুলো তখন ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যে উঠে আসে।
একজন ভালো বন্ধু কী এবং একজন ভালো বন্ধুর কর্তব্য কী কী- তা নিয়ে সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় চলছে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক। ব্রিটিশ স্টাইম ম্যাগাজিন ডেজড-এ 'আর উই অল বিকামিং টেরিবল ফ্রেন্ডস' শিরোনামে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে হানা ম্যাকেঞ্জি আমাদের সমাজে বন্ধুত্বের বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করেছেন। কোনো রকম সতর্কতা ছাড়াই একজন তার জীবনের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা অন্যদের সাথে শেয়ার করতে পারে কিনা- তা নিয়ে টিকটকে যে সমালোচনা হয়েছে, সে বিষয়টি ম্যাকেঞ্জি তার আলোচনায় তুলে ধরেছেন। একইভাবে একজন বন্ধুর কাছে সাহায্য চাওয়া যাবে কিনা, এতে বন্ধুর কাছে খুব বেশি প্রত্যাশা করা হয়ে যাবে কিনা... তা নিয়েও নানা মুনির নানা মত রয়েছে। যেমন, বিমানবন্দরে যেতে যখন আপনি উবার নিতে পারেন, সেক্ষেত্রে বন্ধুর গাড়িতে যেতে চাওয়াটা কি সমীচিন?
বন্ধুর কাছে কি কি চাওয়া যাবে এবং তাদেরকে কতটা সাহায্য করা যাবে- এ বিষটিকে কেন্দ্র করে সোশ্যাল মিডিয়ায় এক ধরনের উভয় সংকট পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সেই সাথে আরও যে প্রশ্নগুলো উঠে এসেছে তা হলো, "কিভাবে বন্ধুত্বের সীমা নির্ধারণ করবেন? কিভাবে ক্ষেত্রবিশেষে বন্ধুকে 'না' বলবেন? কিভাবে প্রয়োজনে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবেন?"
বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং এর পেছনে কারণ দেখানো সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে সাংবাদিক ও 'র্যা ডিক্যাল ইনটিমেসি' বইয়ের লেখক সোফি কে. রোজা আমাদের জীবনের স্বাভাবিক ছন্দের ওপর আধুনিক পুঁজিবাদের প্রভাবের কথা উল্লেখ করেন- যার শুরুটা হয় একজন ব্যক্তির দৈনন্দিন কর্মঘণ্টা দিয়ে।
স্পেনের মাদ্রিদ অ্যাসোসিয়েশন অব মেন্টাল হেলথ-এর সদস্য ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মার্তা কারমোনা এ বিষয়টি নিয়ে এল পাইস'কে আরও বিস্তারিত জানিয়েছেন। কারমোনা 'ম্যালেস্তামোস' নামক একটি প্রবন্ধের সহ-লেখক। আধুনিক পুঁজিবাদের প্রভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় বারবার বন্ধুত্বের সীমারেখা টেনে দেওয়ার যে একটা ট্রেন্ড দাঁড় করানো হয়েছে, আর তার ফলে ব্যক্তির যে মানসিক চাপ সৃষ্টি হচ্ছে- এ বিষয়গুলো নিয়েই প্রবন্ধটি লেখা।
কারমোনা বলেন, "একটা সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত তা আগে থেকেই অনুমান করে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম বেঁধে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে মানব সম্পর্কের জটিল ধাপগুলো বাদ পড়ে যায়, বন্ধুত্বের ক্ষেত্রেও তাই। বিভিন্ন পরীক্ষা-গবেষণায় দেখা গেছে, সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু সীমারেখা থাকা ভালো। কিন্তু সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ নির্বিশেষে বন্ধুত্ব ও তাদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাত্রা চিন্তা করলে, সেই ধরাবাধা নিয়মগুলোকেই প্রচলিত নিয়ম বানিয়ে দেওয়া যায় না।
এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বন্ধুর কাছে এমন কোনো অনুরোধ করা, যেই সেবা কিনা টাকার বিনিময়েই নেওয়া যায় অন্যদের কাছ থেকে (যেমন- উবার ভাড়া করা) এবং এর মাধ্যমে বন্ধুর সাথে ঝামেলা এড়ানোর পেছনে একটি আর্থিক যুক্তি কাজ করে। বন্ধুত্বকে খুব সাবধানে পরিচালনা করতে হবে- এমন চিন্তা আবারও প্রমাণ করে, সেই একই আর্থিক চিন্তাই আমাদের সম্পর্ককে কতটা ভঙ্গুর করে তোলে।
একটা রোমান্টিক সম্পর্ক শেষ করে দেওয়ার চাইতে বন্ধুত্ব ছিন্ন করা আরও বেশি জটিল প্রক্রিয়া। কাউকে কোনো কারণ-যুক্তি না দেখিয়ে তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা অথবা নিঃশব্দে সরে আসাকে ইতোমধ্যেই একটি খারাপ চর্চা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে আপনি জানেন যে এই আচরণের একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। কিন্তু বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে এটা প্রায়ই দেখা যায়।
কারমোনা বলেন, রোমান্টিক সম্পর্কের ইতি টানার বিষয়ে প্রচুর সাহিত্যকর্ম দেখা গেলেও, বন্ধুত্বের অবসান নিয়ে সেরকম 'কালচারাল রেফারেন্স' দেখা যায় না। শুধুমাত্র বয়ঃসন্ধিকালে গড়ে ওঠা সম্পর্ক, যেখানে দুজনের মধ্যে আস্তে আস্তে গভীর টান তৈরি হয়; সেই বন্ধুত্বের সম্পর্কটি ব্যক্তির পরিচিতি গড়ে তোলার নেপথ্যে কাজ করে- সেরকম সম্পর্ক ব্যতীত অন্যান্য বন্ধুত্ব ছিন্ন করা নিয়ে শোক করার কথা সাহিত্যে খুব কমই পাওয়া যায়। এটিকে কারমোনা 'কালচারাল টুলের অভাব' বলে উল্লেখ করেছেন।
সবকিছু 'পরিচালনা' করতে হবে- এমন ধারণা আমাদের বন্ধুত্ব ও সম্পর্কগুলোর শক্তি আরও কমিয়ে ফেলছে। এই কারণে নয় যে আমরা ন্যায্যতা দিতে শুধু আর্থিক যুক্তিকে বেছে নেই, বরং এটাই আমাদের হাতে একমাত্র বিকল্প হিসেবে থাকে।
যদিও বন্ধুত্ব নিয়ে এসব টানাপোড়েন নতুন নয়, কিন্তু ডিজিটাল যুগে এগুলো আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কারমোনা বলেন, "মানুষকে আবারও নিজেদের জীবন নিয়ে চিন্তাশীল হয়ে কাজ করার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে, নিজে কী তা বোঝার মতো শক্তি থাকতে হবে, কিভাবে তারা অন্যদের সাথে যোগাযোগ ও সম্পর্ক স্থাপন করবে তা বুঝতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে যে বন্ধুত্বের গতানুগতিক সংজ্ঞাটি পাল্টে গেছে তা উল্লেখ করে সবশেষে তিনি বলেন, মূল একটা প্রশ্ন থেকেই যায়- 'আমরা আসলে কোন ধরনের বন্ধুত্ব চাই?'