কলকাতার ছোট এক কারখানা থেকে ডাবর যেভাবে ১০০-র বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়ল
ডাবর—ভারতের জনপ্রিয় ব্র্যান্ড। শুধু ভারত নয়, বাংলাদেশেও বেশ জনপ্রিয় এই নাম। আয়ুর্বেদিক ওষুধ থেকে শুরু করে তেল পর্যন্ত হরেক পদের পণ্য নিয়ে ব্যবসা করছে কোম্পানিটি। বাংলাদেশেও পাওয়া যায় এদের পণ্য। ডাবরের যাত্রা শুরু হয়েছিল অবিভক্ত বাংলা থেকেই, আজ থেকে সোয়া একশ বছরেরও আগে। ডাবরের সেই যাত্রা ও সাফল্যের কাহিনি উঠে এসেছে স্ক্রল ডটইনের এক প্রতিবেদনে—সেটি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের পাঠকদের জন্য সংক্ষেপে অনূদিত হলো।
১৩০ বছরেরও বেশি আগের কথা। সময়টা ১৯ শতকের মাঝামাঝি। কলকাতায় থাকতেন এস কে বর্মণ নামে একজন আয়ুর্বেদিক ডাক্তার। তার অধিকাংশ সময় কাটত বাড়িতে নানা ভেষজ ও গাছপালা দিয়ে ওষুধ তৈরি করে।
এস কে বর্মণকে সবাই ভালোবেসে ডাক্তার বর্মণ বলে ডাকত। ম্যালেরিয়া ও কলেরার মতো রোগ নিরাময়ের জন্য আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরি করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন তিনি।
সাশ্রয়ী দামের এই ওষুধগুলো দরিদ্রদের খুব উপকারে আসে। আয়ুর্বেদের ওপর প্রায় সবারই বিশ্বাস ছিল। তবে ডাক্তার এসকে বর্মণ আয়ুর্বেদকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তার ওষুধে কলকাতায় আরও বেশি বেশি মানুষ রোগ থেকে সেরে উঠতে আরম্ভ করে।
কলকাতায় সাফল্য পাওয়ার পর ডাক্তার এস কে দূর-দূরান্তের গ্রাম ও শহরের রোগীদের কাছে পৌঁছানোর উপায় খুঁজতে শুরু করলেন। তখনই তার মাথায় আসে মেইল-অর্ডারের মাধ্যমে দূরের শহর-গ্রামের রোগীদের ওষুধ পাঠানোর আইডিয়া। বুদ্ধিটা কাজে লেগে যায়।
১৮৮৪ সালে নিজের কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন ডাক্তার এসকে। কোম্পানির নাম দেওয়ার সময় 'ডাক্তার'-এর ডা এবং নিজের পদবির প্রথম অংশ অক্ষর নেন। এতে তার কোম্পানির নাম দাঁড়ায় 'ডাবর'—ইংরেজিতে 'Dabur'.
এর তিন দশকেরও বেশি সময় পর, ১৯১৯ সালে, ডাক্তার এস কে-র ছেলে সিএল বর্মণ ওষুধ নিয়ে গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য একটি ইউনিট স্থাপন করেন। ওষুধ উৎপাদন করার জন্য মেশিনও চালু করেন সিএল। দিনে দিনে ব্যবসা বড় হতে থাকে। কোম্পানিটির পণ্য ব্যবহার করা মানুষের সংখ্যাও বাড়তে থাকে।
ধীরে ধীরে সিএল বর্মনের দুই ছেলে পুরান ও রতন চাঁদ কোম্পানির দায়িত্ব নেন এবং কাজ ভাগ করে নেন। উৎপাদন অংশের দেখাশোনা করতেন পুরান, আর রতন দেখভাল করতেন ওষুধ বিক্রির। ডাবর ১৯৪০-এর দশকে আমলা দিয়ে চুলের তেল উৎপাদন শুরু করে। ভারতে তারা এ পণ্যের প্রথম উৎপাদনকারীদের অন্যতম।
ডাবরের ব্যবসা বাড়তে থাকে, তার সঙ্গে বড় হতে থাকে বর্মণ পরিবার। বর্মণ পরিবারের তিন প্রজন্ম এক বাড়িতে একসঙ্গে থাকত। একই ছাদের নিচে বসবাস করত মোট সাতটি পরিবার। পরিবারগুলোর আলাদা আলাদা থাকার জায়গা থাকলেও, তারা প্রতিদিন তাদের খাবার একসাথেই খেত। তারা প্রায়ই তাদের ব্যবসা কীভাবে বড় করা যায়, তার উপায় নিয়ে আলোচনা করত।
বর্মণ পরিবারের প্রবীণ সদস্যরা ছোটদের হাতে ধরে ব্যবসা চালানো শেখাতেন। বহু বছর ধরে এই প্রথা চলতে থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে এবং ১৯৭০-এর দশকে কলকাতা রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গে নকশাল আন্দোলন দানা বাঁধছিল। ট্রেড ইউনিয়নগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী এবং কখনও কখনও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছিল। শ্রমিকরা ব্যবসায়ীদের তাদের শ্রেণীশত্রু হিসেবে দেখতে শুরু করেন। একে একে শিল্প-কারখানা বন্ধ হতে থাকে। বিখ্যাত বিড়লা গ্রুপ এবং স্টেট ব্যাংক অভ ইন্ডিয়ার মতো অনেক কোম্পানি তাদের প্রধান কার্যালয় কলকাতার বাইরে সরিয়ে নেয়।
এই পরিস্থিতিতে বর্মণ পরিবারের পক্ষেও কলকাতায় থাকা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ে। তারা উত্তরে, নয়াদিল্লির দিকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর ১৯৭২ সালে ডাবরের প্রধান কার্যালয় সরিয়ে নেওয়া হয় নয়া দিল্লিতে। এরপর পরিবারটিও ওই শহরেই থিতু হয়।
১৯৯৮ সাল নাগাদ বর্মণ পরিবারের চতুর্থ ও পঞ্চম প্রজন্মের হাতে চলে যায় ডাবরের দায়িত্ব। তারা চুলের তেল, চ্যবনপ্রাশ থেকে শুরু করে টুথপেস্টসহ নানা পণ্য তৈরি করতে আরম্ভ করে। ব্যবসা বড় হতে থাকে। কিন্তু বর্মণ পরিবারের কাঙ্ক্ষিত গতিতে নয়। দ্রুত ব্যবসা বড় করার জন্য কী কী করা যায়, নিয়ে ভাবতে শুরু করে তারা। অবশেষে একজন বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়।
আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ম্যাককিনসে অ্যান্ড কোম্পানির পরামর্শ চায় তারা। প্রতিষ্ঠানটি খুব অস্বাভাবিক একটি পরামর্শ দেয়: বর্মণদের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে হবে। অর্থাৎ পরিবারটিকে কোম্পানির প্রতিদিনের পরিচালনায় অংশগ্রহণ করা বন্ধ করতে হবে। তার বদলে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ফিন্যান্সিয়াল অফিসারসহ অন্যান্য বড় বড় বদে বাইরে থেকে বা কোম্পানির মধ্যে থেকে পেশাদারদের নিয়োগ দিতে হবে।
ডাবর থেকে বেতন না পেলেও তারা কোম্পানির শেয়ার পাবেন। কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদেও বর্মণ পরিবারের সদস্যদেরও পদ বজায় থাকবে। পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে তারা কোম্পানির ভবিষ্যতের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
কোনো নতুন পণ্য বাজারে আনা, সেটি কোন দেশ বা নতুন কোন শহরে বিক্রি করা হবে, উৎপাদন কেন্দ্র কোন জায়গায় স্থাপন করতে হবে এবং কী পরিমাণ উৎপাদন করতে হবে—এই সমস্তা সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বর্মণ পরিবারের বাইরের পেশাদারদের দিয়ে। ওই সময়ে এই ধারণাটি রীতিমতো তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল। তখনও ভারতে এমন পদক্ষেপ নেওয়া ব্যবসায়ী পরিবারের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। তা সত্ত্বেও বর্মণরা এই প্রস্তাবে রাজি হন।
শুরুতে উদ্যোগটি বাস্তবায়ন করা কঠিন ছিল। নতুন এই ব্যবস্থা চালু করতে গিয়ে অনেক ছোটখাটো সমস্যার উদয় হয়। অনেকবার বর্মণ পরিবারের দৃঢ়-প্রতিজ্ঞা ও ধৈর্যের অগ্নিপরীক্ষা নেওয়া হয়ে যায়।
২০০৯ সালের কথা। তখন কোম্পানির চেয়ারম্যান ছিলেন আনন্দ বর্মণ (পঞ্চম প্রজন্ম)। ওই সময় এক সভায় তাকে বলা হয় হজমোলায় নতুন ফ্লেভার আনা হবে। নতুন ফ্লেভার আনন্দের মোটেও পছন্দ হয়নি। তবে তিনি সিইও সুনীল দুগ্গালের কাছে জানতে চান, এ ক্যান্ডি নিয়ে গবেষণা দল কী ভাবছে। সুনীল বলেন, গবেষণা দল বলেছে, ক্যান্ডিটি ভালো বিক্রি হবে। তাই ক্যান্ডির স্বাদ পছন্দ না হওয়া সত্ত্বেও হজমোলা মিন্ট বাজারে আনেন আনন্দ।
এখন ডাবর ইন্ডিয়ার নেতৃত্বে আছেন মোহিত মালহোত্রা। কোম্পানিটির বর্তমান চেয়ারম্যান আনন্দের চাচাতো ভাই অমিত বর্মণ। পুনে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন ম্যানেজমেন্টে স্নাতক সম্পন্ন করা অমিত ১৯৯৪ সালে ডাবরে ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। ২০১৯ সালে তিনি চেয়ারম্যান হন।
বর্মণ পরিবারের একটি কাউন্সিল রয়েছে যা বর্মণদের এবং ডাবরের বোর্ড ও ব্যবস্থাপকদের মধ্যে ইন্টারফেস হিসাবে কাজ করে। তারা কৌশল নির্ধারণ করে। বর্মণ পরিবারের চার সদস্য—অমিত, মোহিত, আদিত্য ও সাকেত—পরিচালনা পর্ষদে পরিবারের প্রতিনিধিত্ব করেন। পরিবারের সদস্যরা ডাবরের বাইরেও তাদের নিজস্ব ব্যবসা পরিচালনা করেন। এই মডেল বিশ্বের বৃহত্তম আয়ুর্বেদিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ডাবরের জন্য ভালো কাজে আসছে বলে মনে হচ্ছে।
ডাবর ধীরে ধীরে হেয়ার কেয়ার, ওরাল কেয়ার, হেলথকেয়ার, স্কিনকেয়ার, হোম যত্ন ও খাবারের মতো নানা খাতে দৃঢ় অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। কলকাতার একটি গলির ছোট এক উৎপাদন কারখানা থেকে ভারতের ১২টি স্থানে এবং দেশের বাইরে ৮টি উৎপাদন কারখানা করেছে।
ডাবরের ভেষজ বা আয়ুর্বেদিক পণ্যের সংখ্যা ২৫০টিরও বেশি, যার মধ্যে রয়েছে কাশির সিরাপ ডাবর হনিটাস ও নারীদের স্বাস্থ্য টনিক ডাবর অশোকারিষ্ট-র মতো ওভার-দ্য-কাউন্টার ওষুধ।
কোম্পানিটি মূলত পাঁচটি ফ্ল্যাগশিপ ব্র্যান্ডের মাধ্যমে কাজ করে—প্রাকৃতিক স্বাস্থ্যসেবা পণ্যের প্রধান ব্র্যান্ড হিসেবে ডাবর; প্রিমিয়াম পারসোনাল কেয়ারের জন্য ভাটিকা; হজমের জন্য হজমোলা; ফলের রস ও পানীয়ের জন্য রিয়েল; এবং ব্লিচ ও স্কিনকেয়ার পণ্যের জন্য ফেম। কোম্পানিটির আয়ুর্বেদিক পণ্য ১০০টিরও বেশি দেশে ৬.৭ মিলিয়নেরও বেশি রিটেইল আউটলেটে পাওয়া যায়।
বর্মণ পরিবার ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, কখনও কখনও বড় ব্যবসার বৃহত্তর কল্যাণের জন্য সম্পূর্ণ ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ থেকে ব্যবসায়িক পরিবারের বিচ্ছিন্ন হওয়া ভাল।