গাজীপুর সিটি নির্বাচনে আমেরিকার নতুন ভিসা নীতির প্রভাব?
অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে গেল গাজীপুরের মেয়র নির্বাচনে। জায়েদা খাতুন নামে তুলনামূলক অপরিচিত প্রার্থী এ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। ১৬ হাজারের কিছু বেশি ভোট পেয়ে বিজয়ী হওয়া জায়েদা খাতুন সাবেক মেয়র (বরখাস্ত) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমের মা।
প্রাক্তন এই মেয়রকে নিয়ে বিভিন্ন সময় নানান নাটকের জন্ম দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কথিত এক কথোপকথন প্রকাশিত হওয়ায় তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। কিছু সময় পরে তাকে আবার দলে ফিরিয়েও নেওয়া হয়। কিন্তু, নির্বাচনের আগে চূড়ান্তভাবে তাকে আর আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। জাহাঙ্গীর আলম তখন নিজে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেন। দলের সিদ্ধান্ত না মেনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর গত ১৪ মে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলী জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয়। এবং একই সময়ে তার মা জায়েদা খাতুনের মনোনয়নপত্রও জমা দেওয়া হয়।
জাহাঙ্গীর সম্ভবত আগেই অনুমান করেছিলেন যে, তার মনোনয়নপত্র বাতিল করে দেওয়া হবে অথবা তিনি ঋণখেলাপি এ কারণে মনোনয়ন বাতিল হয়ে যেতে পারে সে আশঙ্কাও ছিল। ঘটনা সেভাবেই ঘটতে শুরু করল: প্রাথমিকভাবে মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ার পর জাহাঙ্গীর নির্বাচন কমিশনে আপিল করলেন এবং আদালতেও গেলেন। কিন্তু তিনি সফল হতে না পারায় শেষে মায়ের পক্ষেই নির্বাচনে অংশ নেওয়া ছাড়া তার আর পথ রইল না।
গাজীপুরের নির্বাচনের প্রচারণার মাঠে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আজমত উল্লাহর পক্ষে সরকারি দলের নানান গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে চষে বেড়াতে দেখা গেছে। ধারণা করা হচ্ছিল, নির্বাচন মোটামুটিভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন একটি নির্বাচন হবে, কারণ প্রার্থী জায়েদা খাতুন মোটেই পরিচিত নন, তার সন্তানের বিরুদ্ধে সরকারি দল এবং সরকার সমর্থিত গণমাধ্যমের অভিযোগের ছড়াছড়ি- কাজেই এই নির্বাচন যে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে তা কেউই আশা করেননি।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে যখন ভোট গ্রহণ শুরু হয়, তখন প্রায় সব ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। তেমন কোন বহিরাগত হস্তক্ষেপও লক্ষ করা যায়নি। নির্বাচন স্বাভাবিকভাবেই হয়েছে। জাল ভোট কিংবা ভোটকেন্দ্র দখলের কোন চেষ্টা লক্ষ করা যায়নি দিনের শুরুতে। সে কারণে আশা করা যাচ্ছিল যে শেষপর্যন্ত হয়তো একটি স্বাভাবিক নির্বাচন হবে। দিনশেষেও তাই লক্ষ করা গেল। ভোটকেন্দ্রগুলোতে স্বাভাবিক ভোটগ্রহণ শেষ করে ফলাফল গণনার শুরুতেই দেখা যাচ্ছিল জাহাঙ্গীরের মা জায়েদা খাতুন তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ।
ফলাফল গণনা শেষে দুই প্রার্থীর ভোট প্রাপ্তির সংখ্যা ছিল প্রায় চার লক্ষ চল্লিশ হাজার। আর জায়েদা খাতুন ১৬ হাজারের কিছু বেশি ভোটের ব্যবধানে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। যা ৪৮০টি ভোটকেন্দ্রের বেসরকারিভাবে প্রকাশিত ফলাফল।
সত্যিকার অর্থেই এই ফলাফল দেশের মানুষের কাছে একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা। কারণ জাহাঙ্গীর আলম ব্যক্তিগতভাবে যে খুব জনপ্রিয় বা তুমুল জনসমর্থিত ব্যক্তি তা নন। অন্যদিকে বিজয়ী প্রার্থী তার মা জায়েদা খাতুনও একেবারেই অপরিচিত একজন। গাজীপুরের মতোন শিল্প-প্রধান অঞ্চলে তার মায়ের এই বিজয় দেশের মানুষের কাছে অবিশ্বাস্য হওয়াটা স্বাভাবিক ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এনিয়ে একটি নতুন কথা ছড়িয়ে পড়েছে: তাহলো যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি প্রসঙ্গ। গত বুধবার দিবাগত রাতে, বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত যেন হয়, সে জন্য নতুন একটি ভিসা নীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু না হলে তার জন্য দায়ী ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের এই নীতির আওতায় ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ দেওয়া হবে। বুধবার (২৪ মে) নিজের টুইটার হ্যান্ডেল থেকে এই ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন।
ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস ব্লিঙ্কেনের বিবৃতি তুলে ধরে জানায়, যাদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে তাদের মধ্যে বর্তমান ও প্রাক্তন বাংলাদেশি কর্মকর্তা/কর্মচারী, সরকারপন্থি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং আইন প্রয়োগকারী ,বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র গত ৩ মে, ২০২৩ তারিখে বাংলাদেশ সরকারকে এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলা হচ্ছে এই ভিসা নিষেধাজ্ঞাই গাজীপুরের নির্বাচনকে নিরপেক্ষ নির্বাচনে পরিণত করেছে। এর প্রভাবেই স্থানীয় প্রশাসন নির্বাচনকে নিরপেক্ষ রাখতে বাধ্য হয়েছে!
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই মতামত কতটা সত্য- তা এখনই বলার সময় হয়নি। সামনের আরো দুটি মেয়র নির্বাচন কীভাবে সম্পন্ন হয় তাও দেখার বিষয়। বরিশাল এবং সিলেটের নির্বাচনের পরেই বোঝা যাবে প্রকৃত অর্থে আমাদের ভোট ব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘদিন যে অবিশ্বাস এবং অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছিল– তা থেকে জাতি বেরিয়ে আসলো কিনা? দেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে ভোট ব্যবস্থা গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করল কিনা? অতীতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে এখন যে সংবিধান পরিপন্থী আন্দোলন করছে – তারা সেই দাবি থেকে তারা সরে আসবেন কিনা? গাজীপুরের নির্বাচন তাদের আন্দোলনের উপর সেই প্রভাব ফেলবে কিনা ? এসবই আজকের প্রশ্ন।
এই নির্বাচনের ফলাফল সরকারি দলকেও অনেক কিছু হয়তো নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে। ভাবার বিষয়, একজন একেবারেই অপরিচিত নারীর কাছে সরকারি দলের প্রার্থীর পরাজয় কি বাতা দেয়? অর্থনৈতিক উন্নয়ন সব সময় জনসমর্থন অর্জন করে না। বর্তমানের উচ্চ মূল্যস্ফীতি এই ফলাফলকে প্রভাবিত করল কিনা তাও এক প্রশ্ন।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল- গত কয়েক বছরের স্থানীয় সরকারসহ নানান নির্বাচনে ভোটার অনুপস্থিতির যে মাত্রা ছিল, হঠাৎ করে সেই অবস্থা কীভাবে বদলে গেল গাজীপুরের এবারের নিবার্চনে। ৪৮ শতাংশ ভোটার ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়েছিলেন।
সদ্য-ঘোষিত মার্কিন নতুন ভিসা নীতি বাংলাদেশের ওপর কতখানি প্রভাব বিস্তার করল আসলে? উল্লেখেযাগ্য কী আছে নতুন ভিসা নীতিতে?
মার্কিনীদের এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা অতীত বহু দেশে দেখা গেছে। যেমন- গুজরাট দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল তখনকার মার্কিন সরকার। পরবর্তীকালে কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছাড়াই কখন সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছিল- তা গণমাধ্যম কোনোদিন জানতে পারেনি। ফলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এ ধরনের নীতি কতোটা স্থায়ী ও কার্যকর হয় - সে দিকটিই আগামী দিনে পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে। আর তারপরেই নির্বাচনে প্রভাব পড়ছে কিনা -- তেমন মতামত দেওয়া যৌক্তিকও হবে।