গাজীপুরে পরাজয়ের পর বাকি চার সিটিতে সতর্ক আওয়ামী লীগ
গাজীপুর সিটি নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের আজমত উল্লাহ খানের পরাজয়ের পর বাকি চার সিটি নির্বাচনে সতর্কমূলক পলিসি গ্রহণ করছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ।
বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট সিটি নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর জয়লাভ নিশ্চিত করতে, গাজীপুরের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে।
গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ প্রার্থী আজমত উল্লাহর পরাজয় এবং সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুনের জয় নিয়ে নানান আলোচনা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের এই পরাজয় দলের জন্য সতর্কবার্তা কি না, সেই আলোচনাও চলছে একইসঙ্গে।
আর এই কাটাছেঁড়া ও আলোচনার বিষয়ও আওয়ামী লীগ। কারণ আওয়ামী লীগের সাবেক মেয়রের মায়ের কাছেই হেরেছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী আজমত উল্লাহ। ফল ঘোষণার পর বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের ছেলে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, "নৌকা জিতেছে, ব্যক্তি হেরেছে।"
যদিও ক্ষমতাসীন দলের এক কেন্দ্রীয় নেতা বলছেন, বিএনপি-জামায়াতের ভোটে জায়েদা খাতুন জিতেছেন। তবে আরেক নেতা বলেছেন, আওয়ামীগের একটি শক্তিশালী গ্রুপের কারণেই গাজীপুরে আজমত উল্লাহ খানকে পরাজিত করেছে বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও তৃণমূলের একাধিক নেতা বলেন, ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে আরেকটি 'আওয়ামী লীগ' জন্ম নিয়েছে। প্রথমেই দলে ঢুকে, এরপর নিজেদের ভিত শক্ত করে পদ-পদবি বাগিয়েছে স্বার্থান্বেষী একদল লোক। তারা আর্থিকভাবে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তারাই দলের ভেতরে দল, ঘরের ভেতর ঘর তৈরি করা শুরু করে এবং এখন তারা সংখ্যায়ও অনেক বেশি হয়ে উঠেছে।
নৌকার পরাজয় 'লজ্জার'
এসব দিক বিবেচনা করে এখন বাকি চার সিটি নির্বাচনে নতুন পলিসি গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা।
এ পরিপ্রেক্ষিতে রোববার বঙ্গবন্ধু এভিনিউ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আওয়ামী লীগের ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ মহানগর শাখা ও সহযোগী সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করবে আওয়ামী লীগের সেক্রেটারিয়েট।
দলের একজন সিনিয়র নেতা জানান, পরবর্তী নির্বাচনের সম্ভাব্য কৌশলগুলো বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে থাকবে।
দলের আরেকজন সিনিয়র নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, গাজীপুরে আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরের মাকে জয়লাভ করাতে গোপনে কাজ করেছে। আবার অনেকেই নিরব ছিলেন। এই পরিস্থিতি বরিশাল ও সিলেটে হতে পারে বলে মনে করছে দলটি।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বরিশালে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে সরাসরি কাজ না করলেও তার ভাগ্নে মেয়র সেরনিয়াবাত সাদেক আবদুল্লাহর একটি শক্তিশালী গ্রুপ গোপনে কাজ করছে।
তিনি বলেন, এছাড়াও সিলেটে নৌকা প্রতীকের লন্ডন প্রবাসী প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামানের বিপক্ষে আওয়ামী লীগের একটি অংশ কাজ করছে। হঠাৎ করে প্রবাসী আনোয়ারুজ্জামান মেয়র পদে দলের মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়টি স্থানীয় অনেক নেতাই মেনে নিতে পারছেন না।
কেন্দ্র থেকে এসব হিসেব-নিকেশ করে কীভাবে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর জয় নিশ্চিত করা যায়, সেটি নিয়েই আওয়ামী লীগের কেন্দ্র ও স্থানীয় নেতারা কাজ করছে।
গাজীপুরের অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার জন্য বরিশাল ও সিলেটে কেমন পলিসি নেওয়া হচ্ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে ওই সিনিয়র নেতা বলেন, ইতোমধ্যে বাকি চারটি সিটি কর্পোরশেন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্র পৃথক সমন্বয় কমিটি করেছে। যেগুলোর দায়িত্বে রয়েছেন কেন্দ্রের জেষ্ঠ নেতারা।
বরিশাল ও সিলেটের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভাপতি শেখ হাসিনা নিজেই মনিটরিং করছেন। ইতোমধ্যে তিনি স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করছেন।
এছাড়াও আওয়ামী লীগের যেসব নেতা স্থানীয়ভাবে দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে গোপন ও প্রকাশ্যে কাজ করতে পারেন, তাদের তালিকা করা হয়েছে। সেই তালিকা অনুযায়ী দলের পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। তাদেরকে অপাতত দলের বৃহত্তর স্বার্থের কথা বুঝানো হচ্ছে, যদি এতে করে কাজ না হয়, তাদের বিরুদ্ধে নির্বাচনের আগেই চূড়ান্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে কেন্দ্র।
এছাড়া স্থানীয় বিভিন্ন ইউনিটের নেতাদেরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে কেন্দ্র থেকে। পাশাপাশি যেসব স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা ওয়ার্ড কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন, তারাও যাতে করে মেয়রের পক্ষে জোরালোভাবে কাজ করেন, সেই বিষয়টিও নিশ্চিত করার জন্য কাজ করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন এই কেন্দ্রীয় নেতা।
সিটি নির্বাচনকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে আওয়ামী লীগ
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুল আলম হানিফ টিবিএসকে বলেন, "আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে চলমান সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে আওয়ামী লীগ।"
"সেই চ্যালেঞ্জের অংশ হিসেবে বাকি চার সিটি নির্বাচনে দলের মেয়র প্রার্থীর বিজয় যেন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়, সে হিসেবেই পলিসি নেওয়া হয়েছে। বাকি চার সিটির আওয়ামী লীগের স্থানীয় গ্রুপিংয়ের বিষয়ে এখন বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। এই গ্রুপিং কমানোর জন্য দলের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রপ্ত সাংগাঠনিক সম্পাদকরা মাঠে কাজ করছেন," যোগ করেন তিনি।
দলের আরেকজন কেন্দ্রীয় নেতা জানান, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা পলিসি ও গাজীপুরের সুষ্ঠু নির্বাচনের কারণে বিএনপি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে বলেই ধরে নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
সে হিসেবে নির্বাচনে এমপি প্রার্থী বাছাইয়ে জোরালোভাবে কাজ করছে দল।
ওই নেতা বলেন, দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় পরিধি-পরিসর বাড়ছে, সেই সাথে দলের স্থানীয়ভাবে কোন্দলের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এইসব 'কোন্দলপূর্ণ এলাকা' চিহ্নিত করা হয়েছে কেন্দ্রীয়ভাবে।
তিনি বলেন, যারা দল ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছেন, জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন তাদেরকে এবার মনোনয়ন দেওয়া হবে না। লুটপাট-দুর্নীতির সঙ্গে যারা জড়িয়েছেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছেন- এ রকম যারা বর্তমান সংসদ সদস্য কিংবা মনোনয়ন প্রত্যাশী আছেন, তাদের সবার তালিকা করা হয়েছে।
আগামীতে আর কোনোভাবেই তাদের মনোনয়ন দেবে না আওয়ামী লীগ।
জাতীয় নির্বাচনে যোগ দেবে বিএনপি?
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মতিয়া চৌধুরী বলেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে অস্তিত্ব টিকে রাখতে হলে আগাম জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ করতেই হবে।
তিনি বলেন, "আমরাও ধরে নিয়েছি সংবিধান অনুসারে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে।"
"এছাড়াও সাম্প্রতিক বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসা পলিসি প্রকাশ করেছে, তাতে বিএনপিসহ সকল দল সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। তার মানে ধরেই নেওয়া যায় বিএনপি নির্বাচনে যাচ্ছে," যোগ করেন তিনি।
প্রবীণ এই নেতা আরও বলেন, "নির্বাচনটা এবার বেশ প্রতিদ্বন্দীতামূলক হবে। সে হিসেব করেই তুলনামূলক যোগ্য এমপি প্রার্থী দেবে দল। আওয়ামী লীগের মনোনয়নে প্রতি বারই পরিবর্তন হয়ে থাকে। এবারো তার ব্যতিক্রম হবে না। যারা দলের আস্থা হারিয়েছেন, দল কোনোভাবেই তাদের মনোনয়ন দেবে না। এটাই স্বাভাবিক।"