শীর্ষ জনসংখ্যার দেশ ভারতের এই রাজ্য কেন আরও শিশুর জন্য মরিয়া!
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি রাজ্য সিকিম। তিন দিকে নেপাল, ভুটান ও তিব্বতের সীমান্ত দিয়ে ঘেরা এই রাজ্যটি হিমালয়েরও অংশ। বিশ্বের অনেক ভ্রমণপ্রেমীদের কাছেই সিকিম এক স্বর্গের মতো। এখানে রয়েছে ভারতের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা, আবার স্মোকি ব্ল্যাক কার্ডামম (এক ধরনের কালো এলাচ) উৎপাদনের ক্ষেত্রেও বিশ্বে সবার শীর্ষে আছে সিকিম। কিন্তু সিকিমে যার ঘাটতি রয়েছে, তা হলো 'মানুষ'। দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় সিকিমের জনসংখ্যাই সবচেয়ে কম এবং সিকিমে জন্মহারও সর্বনিম্ন।
বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশ ভারত যখন জনসংখ্যার চাপ সামলাতে ব্যস্ত, তখন এমনটা শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও এটাই সত্যি। জন্মহার সর্বনিম্ন হওয়ার কারণেই বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠী, ধর্ম ও ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে সিকিমে যে অনন্য সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ভবিষ্যতে সেটি টিকে থাকা নিয়ে উদ্বিগ্ন রাজ্যের নেতারা। এমন পরিস্থিতিতে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন তারা।
বর্তমানে ১.৪ বিলিয়ন জনসংখ্যার দেশ ভারতে দিন দিন জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে এবং ধারণা করা হচ্ছে, দ্রুতই এটি বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশে পরিণত হবে। কিন্তু এর ঠিক বিপরীতে, সিকিমের পরিস্থিতি এতটাই শোচনীয় যে স্থানীয় সরকার রাজ্যের বাসিন্দাদের টাকা দিচ্ছে সন্তান নেওয়ার জন্য।
রাজ্যের এমন উদ্যোগ ভারতের জনতাত্ত্বিক বাস্তবতাকে প্রকাশ করে, যা প্রায়ই দেশটির মোট জনসংখ্যা নিয়ে আলোচনার আড়ালে চাপা পড়ে যায়। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য বিদ্যমান। দেশটির উত্তরাঞ্চলের স্বল্পোন্নত কিছু রাজ্য এ সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ভারতের অন্যান্য অংশ- বিশেষ করে দক্ষিণে, যেখানে আয় বেশি এবং নারীরা শিক্ষিত; সেগুলো অনেকটা পূর্ব এশিয়া বা পশ্চিম ইউরোপের মতো মনে হয়। এ অঞ্চলগুলোতে বয়স্ক জনসংখ্যা কমে আসছে বা আগামী বছরগুলোতে কমবে।
কিন্তু কর্তৃপক্ষ বলছে, সিকিমে জন্মহার হ্রাস পাওয়ার কারণ ভিন্ন: অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার অভাব থাকায় প্রায়ই নারী-পুরুষেরা রাজ্যের বাইরেও কাজের সন্ধানে যায়; ফলে তাদের বিয়ে করতেও দেরি হয়ে যায়।
প্রথাগতভাবে ভারতের অন্যান্য গ্রামীণ অঞ্চলের চেয়ে সিকিমে নারীদের স্বাধীনতা বেশি। অন্য গ্রামীণ অঞ্চলগুলোতে বেশিরভাগ নারীই ঘরের কাজ এবং সন্তান লালন-পালনের পেছনে সময় ব্যয় করেন। কিন্তু সিকিমে তরুণরা আগেভাগে বিয়ে করা ও সন্তান জন্মদানের চেয়ে ক্যারিয়ারকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। ভারতে জাতীয় পর্যায়ে শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণের হার গড়ে ২৯ শতাংশ, কিন্তু শুধু সিকিমে তা ৫৯ শতাংশ।
রাজ্যের কর্মকর্তারা চান, জুটিরা অন্তত তিনটি সন্তান নিক। সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সিকিমের নারীরা তাদের প্রজনন বছরে গড়ে ১.১ হারে সন্তান নিচ্ছেন। জাতীয় পর্যায়ে গড়ে ২ এবং অভিবাসন ছাড়াই স্থিতিশীল জনসংখ্যা বজায় রাখার জন্য ২.১ হারের চেয়েও এটি কম। রাজ্যের কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের নিজস্ব জরিপে উঠে এসেছে যে এই হার মাত্র ০.৮৯ শতাংশ।
সিকিমে জন্মহার বৃদ্ধির জন্য সরকার ত্রিমুখী কৌশল গ্রহণ করেছে। রাজ্যের যেসব নাগরিক এখনও 'রিপ্রোডাকটিভ এইজ' এর মধ্যেই রয়েছেন কিন্তু নিঃসন্তান,গত বছরের আগস্ট থেকে তাদেরকে ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন চিকিৎসার জন্য টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে সরকার। যেসব জুটির ঘরে এক সন্তান রয়েছে, তারা যদি আরেকটি সন্তান নেন তাহলে তাদেরকে মাসে ৮০ ডলার করে দেওয়ারও প্রস্তাব দিয়েছে সরকার। সরকারি চাকরিজীবিরা যদি বেশি সন্তান নেন, তাহলে তাদের বেতন-ভাতা বাড়ানো এবং বছরব্যাপী মাতৃত্বকালীন ছুটি, এমনকি বেবিসিটার দেওয়ার মতো লোভনীয় প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে।
সিকিমের প্রধান জাতিগোষ্ঠীগুলো: যাদের বেশিরভাগই হিন্দু নেপালি, লেপচা এবং ভুটিয়া (যাদের অধিকাংশই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী); সবগুলো সম্প্রদায়ের মধ্যেই জন্মহার হ্রাস পাওয়ায় অনেকগুলো ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
"হয় তাদের সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে, আর নাহয় লোকজনকে সন্তান নিতে হবে", বলেন পপুলেশন ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়া'র একজন কর্মকর্তা অলোক বাজপেয়ী।
মানুষের সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্তের পেছনে যে সামাজিক বিষয়গুলো চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে, সেগুলো পরিবর্তন করা সরকারের পক্ষে খুবই কঠিন। কিন্তু যারা সন্তান চেয়েও পারছেন না, আই.ভি.এফ তাদেরকে সহায়তা করবে বলে মনে করছে সিকিম সরকার।
সিকিম সরকারের তত্ত্বাবধানে একটি প্রোগ্রাম পরিচালনা করা হচ্ছে, যেখানে প্রথমবার আই.ভি.এফ চিকিৎসা নেওয়ার প্রচেষ্টায় ৩৬০০ ডলার এবং দ্বিতীয় দফায় চেষ্টা করলে ১৮০০ ডলার দেওয়া হবে।
কিন্তু সরকার আই.ভি.এফ চিকিৎসার মাধ্যমে সন্তান নেওয়ার সুযোগ দিলেও, এরই মধ্যে গুজব ছড়িয়েছে যে এই পদ্ধতিতে থেরাপির মাধ্যমে শিশুর জন্ম হয় এবং শিশুদেরকে প্লাস্টিকের বাক্সে জন্ম দেওয়া হয় কিংবা জেনেটিকভাবে শিশুরা আসলে অন্য কারো সন্তান।
সিকিমের মূখ্যমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা শঙ্কর দেও ধাকাল বলেন, "আমরা শুধু যে ভ্রান্ত ধারণা ও গুজবের সঙ্গে লড়াই করছি তা-ই নয়, আমরা নিজেদের জীবনধারণের উপায়, অভ্যাস-রীতিও টিকিয়ে রাখারও চেষ্টা করছি।"
এদিকে নতুন এই নীতি প্রবর্তনের পর থেকে একশোরও বেশি জুটি আই.ভি.এফ চিকিৎসা নিয়েছেন, আরও অনেকেই আবেদন করছেন। মানুষ যাতে এই পদ্ধতি সম্পর্কে আরও জানতে পারে গণমাধ্যমের ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে, সেজন্যেও টাকা খরচ করছে সরকার।
৪০ বছর বয়সী অর্পণা ছেত্রি একজন সরকারি চাকরিজীবি। সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকের এই বাসিন্দা জানান, তিনি দ্বিতীয়বার আই.ভি.এফ পদ্ধতির মধ্য দিয়ে গিয়ে সন্তান জন্ম দিয়েছেন। এখন তার মেয়ের বয়স ছয় মাস এবং তিনি পুরো এক বছরের মাতৃত্বকালীন ছুটিতে আছেন।
তিনি জানালেন, আই.ভি.এফ সম্পর্কে মানুষের কত ভ্রান্ত ধারণা আছে তা তিনি নিজেই টের পেয়েছেন। "মানুষ আমাকে জিজ্ঞেস করতো, তোমার কি ইনজেকশন নেওয়ার পর বাচ্চা হয়েছে? কিন্তু আমি কীভাবে তাদের বুঝাবো যে এটা আমারই সন্তান? সে নয় মাস আমার গর্ভে ছিল, কোনো ফ্রিজে নয়!" বলেন অর্পণা।
তবে সন্তান নেওয়ার জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধাও পেয়েছেন অর্পণা। নগদ টাকাসহ পুরো এক বছরের মাতৃত্বকালীন ছুটি তো আছেই।
আরেক জুটি, যোগেশ ও রুপা শর্মাও এই পদ্ধতি বেছে নিয়েছেন। পাঁচবার ব্যর্থ হওয়ার পর সরকারি খরচে রূপা আই.ভি.এফ চিকিৎসা নিয়েছেন। যোগেশ জানান, তিনি এই চিকিৎসা গ্রহণের জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে এটা নিয়ে খোলামেলা আলাপ করতে চান।
"নিঃসন্তান থাকা খুবই পীড়াদায়ক এবং একাকীত্বে ভোগায়। যেহেতু আমাদের এ অঞ্চলের জনসংখ্যা কমছে, তাই একমাত্র বিজ্ঞানই পারে আমাদের সাহায্য করতে", বলেন যোগেশ শর্মা।