ওষুধ কোম্পানির উপহার সামগ্রীর ঠিকানা যখন নীলক্ষেতের ফুটপাত
সাদামাটা এক দিনে নিউ মার্কেট এলাকার কাছাকাছি ঢাকার যানজটের মধ্যে উদ্দেশ্যহীন হাঁটাহাঁটি করছিলাম। নীলক্ষেত বইয়ের বাজারে পৌঁছেই ফুটপাতের দোকানগুলো ঘুরে দেখতে লাগলাম।
আকর্ষণীয় কিছু দেখতে পাব, তেমন আশা ছিল না—অন্তত ঢাকার অন্যান্য ফুটপাথতের দোকানের চেয়ে আলাদা কিছু দেখার আশা করিনি। তবে অদ্ভুত কয়েকটা দোকানের দেখা পাওয়ার পর আমার ধারণা বদলে গেল।
প্রথম যে জিনিসটি আমার নজর কাড়ল, সেটি একটি নেসক্যাফে কফির জার। তার ঠিক পাশেই বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের লাল-সবুজ জার্সি। আর ঠিক তার পাশে ছোট ফুটবলের মতো দেখতে একটি টুলবক্স।
এ আবার কোন ধরনের ফুটপাতের দোকান যেখানে জার্সি আর কফি একসাথে বিক্রি হয়?
নীলক্ষেতের ফুটপাতে আমি বহুবার হেঁটেছি—কখনো একা, কখনো অন্যদের সঙ্গে। কিন্তু এই প্রথম এসব দোকান আমার চোখে পড়ল।
ফুটপাতের এরকম আরও ২০টির বেশি দোকান দেখলাম। চা, বিস্কুট, ক্রোকারিজ, রান্নাঘরের তৈজসপত্র, বিছানার চাদর, ম্যাট, ম্যানিকিউর সেট, টেবিল ল্যাম্প, প্রসাধন সামগ্রী, স্কাল ক্যাপ, থার্মাল ফ্লাস্কসহ আরও অনেক আইটেম বিক্রি হয় সেগুলোতে।
একটা জিনিস এই সবগুলো পণ্যেই আছে—বাংলাদেশের বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির লোগো ও চিহ্ন। বিশেষ করে রেডিয়েন্ট, হেলথকেয়ার, পপুলার, জিস্কা, ইউনিমেড অ্যান্ড ইউনিহেলথ, নিপ্রোর লোগো চোখে পড়ে বেশি।
বাংলাদেশের ডাক্তার ও ওষুধ কোম্পানির মধ্যে উপহার দেওয়ার সংস্কৃতি সবারই জানা। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অভ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ-এর (বিআইডিএস) ২০১৯ সালের রিপোর্ট অনুসারে, এই প্রতিষ্ঠানগুলো মাঝে মাঝে ডাক্তারদের পারিবারিক ছুটি কাটাতে যাওয়ার খরচও দেয়। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ নিতে ডাক্তারদের বিদেশে যাওয়ার খরচ দেয় কিংবা প্রেসক্রিপশনে তাদের ওষুধ লিখতে রাজি করানোর জন্য উপহার পাঠায়।
বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো বিপণনের পেছনে বছরে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করে, যা বাংলাদেশে ওষুধের উচ্চমূল্যের অন্যতম প্রধান কারণ। বিআইডিএসের রিপোর্টে আরও উঠে এসেছে, শুধু ২০১৮ সালেই এই কোম্পানিগুলো তাদের টার্নওভারের ২৯.৬ শতাংশ বিপণনে ব্যয় করেছিল; ওই বছর ওষুধের বাজার ছিল ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার।
স্বাধীনতা চিকিৎসা পরিষদের (স্বাচিপ) সাবেক সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বেসিক সায়েন্স অ্যান্ড প্যারাক্লিনিক্যাল সায়েন্স অনুষদের সাবেক ডিন ড. ইকবাল আরসালান বলেন, 'ডাক্তাররা ওষুধ কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে যেসব উপহার পান, তা সাধারণত ওষুধ বিক্রি থেকে আসে। তাই মূলত রোগীরাই এসব উপহারের দাম শোধ করে।'
ডিয়েন্ট, হেলথকেয়ার, ইনসেপ্টা, নাভানা ও ফার্মাসিউটিক্যাল আইএসসিসহ বেশ কয়েকটি ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। কিন্তু কোম্পানির কর্মকর্তারা হয় কল কেটে দিয়েছেন, নইলে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তো, এই উপহারগুলোর ঠাঁই ফুটপাতের দোকানে হয় কীভাবে?
আমি মোহাম্মদ শাহেদ নামে একজন স্নাতক শেষ বর্ষের এক ছাত্রের দোকানে পণ্য দেখছিলাম। তিনি ২০১৯ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন। শাহেদ তার চাচার সঙ্গে নীলক্ষেত ঘুরতে এসে দেখেছিলেন এরকম দোকানে বেডশিট থেকে শুরু করে ছোট ব্লেন্ডার ও ইউনিভার্সাল রিমোট পর্যন্ত নানা রকমের পণ্য বিক্রি হয়।
ব্যাপার দেখে শাহেদের চাচা আবদুর রহমানকে আগ্রহী করে তোলেন। ডাক্তারদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। তাই তিনি শাহেদকে বলেন, তিনি যদি এসব উপহার সামগ্রী সোর্স করে দিতে পারেন, তাহলে শাহেদ দোকান চালাতে পারবেন কি না। সেই থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন শাহেদ।
ওপরে বলা ছোট ফুটবলের মতো দেখতে প্লাস্টিকের টুলবক্সটি তুলে নিলাম আমি। শাহেদ বললেন, ওটার দাম পড়বে ৮০০ টাকা। আরেকজন ক্রেতা একটি ছোট বৈদ্যুতিক চার্জার ফ্যানের দাম জিজ্ঞেস করলেন। শাহেদ জানালেন, ফ্যানটার দাম পড়বে ১ হাজার ২০০ টাকা। কিছুক্ষণ দরাদরি করার পর ওটা ৯০০ টাকায় বিক্রি করলেন শাহেদ।
আমি শাহেদের কাছে জানতে চাইলাম, আইটেমগুলির দাম একটু বেশি নিচ্ছেন কি না। তিনি বিব্রত হাসি দিয়ে খানিকটা আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে বললেন, 'হয়তো। কিন্তু আমরা এসব আইটেম অনেক দামে কিনি, কারণ বেশিরভাগই ইউনিক। এগুলো আপনি যেখানে-সেখানে পাবেন না।'
কিন্তু এই দোকানগুলো ডাক্তারদের কাছ থেকে এসব পণ্য সোর্স করে কীভাবে? এসব পণ্য কি তারা পাইকারি বা আলাদা আলাদা কেনেন? প্রায় সবকটা পণ্যেই 'বিক্রির জন্য নয়' কথাটি লেখা থাকে—তাহলে এসবের দাম তারা কীভাবে নির্ধারণ করেন? এসব প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে।
দুর্ভাগ্যবশত শাহেদ আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না, কারণ পণ্যগুলো সোর্স করেন তার চাচা। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে অন্যান্য দোকান ঘুরে দেখতে যাই।
পরের দোকানে একটা সুন্দর ম্যানিকিউর সেট দেখতে পেলাম। এখানকার দোকানদার হাওলাদার নামের একজন মিশুক বৃদ্ধ। তিনি আগেই শাহেদের সঙ্গে আমার কথোপকথন শুনেছেন। তাই আমি তার দোকানের সামনে থেমে ম্যানিকিউর সেটটি হাতে নিতেই তিনি জানালেন, সব দোকানদারই তাদের নিজেদের মতো করে পণ্য সোর্স ও সেগুলোর দাম ঠিক করেন।
উদাহরণস্বরূপ, বেশ কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে চুক্তি করা আছে তার। ডাক্তাররা যেসব উপহার সামগ্রী বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, ওই ব্যক্তিরা সেগুলো হাওলাদারের কাছে নিয়ে আসেন। আমি হাওলাদারকে জিজ্ঞেস করলাম, ওই ব্যক্তিদের সঙ্গে আমাকে কথা বলিয়ে দিতে পারবেন কি না।
তিনি জানালেন, 'কেন যেন এই মানুষগুলো তাদের পরিচয় গোপন রাখেন। এই মানুষগুলোর বেশিরভাগই তাদের ফোন নম্বরও দেন না। মাঝে মাঝে তাদের সাথে যখন যোগাযোগ করতে পারি না, তখন আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গেটের সামনে গিয়ে পণ্য সংগ্রহ করি।'
হাওলাদার জানান, '১৯৯৫ সাল থেকে এই দোকানগুলো এখানে আছে। আগে এখানে এসব উপহার সামগ্রী বিক্রি করার মাত্র দুই-তিনটি দোকান ছিল। এখন দোকানের সংখ্যা ২০টির বেশি। আমাদের আইটেমের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে সেগুলোর বৈচিত্র্যও।'
তিনি জানান, যেসব পণ্যের চাহিদা সবচেয়ে বেশি, সেগুলো হলো বিছানার চাদর ও মানিব্যাগ। তবে তারা সারা বছরই মৌসুমী জিনিসপত্র বিক্রি করেন। এই যেমন, রমজানে খেজুর ও রুহ আফজা এবং বর্ষাকালে ছাতা বিক্রি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়।
হাওলাদারের সঙ্গে কথা বলার সময় দেখলাম পাশের দোকানে একজন ক্রেতা নেইল কাটারের সাথে লাগানো ছোট ম্যাগনিফাইং গ্লাস দেখছেন। তিনি এয়ার ফ্রেশনারের একটি ক্যান নিয়ে ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে লেবেলগুলো পড়লেন।
ওই ক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি নিয়মিত এসব দোকানে আসেন কিনা। তার নাম সিজার, কাজ করেন শান্তিনগরের পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্সে। তিনি উত্তর দিলেন, 'হ্যাঁ, নিয়মিত আসি। এই দোকানগুলোর সবকিছুই আমার ভালো লাগে।'
সিজারের মতে, সাধারণ দোকানের আইটেম এবং এই উপহারের আইটেমগুলোর মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, ওষুধ কোম্পানিগুলো ডাক্তারদের জন্য এসব আইটেম কাস্টমাইজ করে বলে এগুলোকে একটু অনন্য দেখায়।
'এই যেমন এটাই দেখুন, ম্যাগনিফাইং গ্লাসযুক্ত নেইল কাটার কিন্তু আপনি সব জায়গায় পাবেন না,' বললেন তিনি।
আমরা দোকানদারের কাছে ম্যাগনিফাইং গ্লাসের দাম জিজ্ঞেস করলাম। ৩৫০ টাকা শুনে সিজার জিনিসটা ফেরত দিলেন। সিজারকে জিজ্ঞেস করলাম, এই পণ্যগুলোর দাম তার কাছে বেশি মনে হয় কি না।
তিনি জবাব দিলেন, 'অবশ্যই দাম বেশি। রেগুলার বাজারে যদি একই জিনিস আরও ভালো দামে পাই, তাহলে আমি এখান থেকে এটা কিনব না। তবে আমার পছন্দের আইটেমটা যদি ইউনিক হয়, এবং জানি যে এর বিকল্প খুঁজে পাব না, তাহলে বেশি দামে হলেও আমি কিনি।'
ওই মুহূর্তে সিজারের একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দরকার ছিল। বাজারে অনেক ম্যাগনিফাইং গ্লাসই পাওয়া যায়, কিন্তু সেগুলো খুব একটা আকর্ষণীয় নয়। তিনি বলেন, 'এই ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা আমার পছন্দ হয়েছে। কিন্তু এটা দিয়ে আসলে আমার কাজ চলবে না। কাজ চললে এর দাম আরও বেশি হলেও আমি কিনতাম।'
যে উদ্দেশ্যহীন হাঁটাহাঁটি শুরু করেছিলাম, তার শেষ হলো ঢাকার ফুটপাতে অনন্য কিছু দোকান আবিষ্কারের মাধ্যমে। মাথাভর্তি তথ্য আর হাতে নেইল কাটার নিয়ে ম্যাগনিফাইং গ্লাস নিয়ে বাসায় ফিরলাম আমি।