চট্টগ্রামের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আগ্রহী জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার দুই প্রতিষ্ঠান
বন্দরনগরী চট্টগ্রামে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য জাপানের একটি ও দক্ষিণ কোরিয়ার একটি, মোট দুটি প্রতিষ্ঠান প্রস্তাব জমা দিয়েছে।
তবে কোন কোম্পানিকে প্রকল্পটি দেওয়া হবে সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি সিটি কর্পোরেশন। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনার পর বিষয়টি নির্ধারণ করা হবে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এ বিষয়ে কর্পোরেশনের হাতে অনেক প্রস্তাব রয়েছে।
"এরমধ্য থেকে আমরা সেরা বিকল্পটি বাছাই করছি। এরজন্য চট্টগ্রাম ও ঢাকার প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেওয়া হবে," বলেন তিনি।
সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম নগরীতে প্রতিদিন প্রায় ২,১০০ টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এসব বর্জ্য মানুষের ঘরবাড়ি থেকে সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে পৌঁছায় দুটি ল্যান্ডফিলে (ভাগাড়)। কিন্তু এসব বর্জ্যের যথাযথ ব্যবস্থাপনায় নিঃশেষ না করায় আবর্জনার ভাগাড় দুটির (ল্যান্ডফিল) উচ্চতা বাড়ছে। তাই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্প বাস্তাবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে চসিক।
চসিকের তথ্যমতে, জাপানের 'জেএফই ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন' বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পূর্ণাঙ্গ সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ২০২২ সালের মার্চ মাসে প্রস্তাব দেয় চসিককে। ২০২২ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত একটি সমীক্ষা চালানো হয়। গত ২৬ জানুয়ারি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় চসিককে লেটার অফ ইন্টেন্ট (এলওআই) অনুমোদন ও জেএফই'র সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের অনুমতি দেয়।
অন্যদিকে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রকল্প নিতে আগ্রহী দক্ষিণ কোরিয়ার 'দ্য কোরিয়া এনভারনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড টেকনোলজি ইনিস্টিটিউট' (কেইআইটিআই)-এর আমন্ত্রণে চলতি বছরের ১০ থেকে ১৬ জানুয়ারি দেশটি সফর করেন চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, চসিকের প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম ও প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবুল হাশেমসহ একটি প্রতিনিধি দল।
ওইসময় চসিককে একটি প্রজেক্ট কন্সেপ্ট প্রপোজল (পিসিপি)-এর খসড়া হস্তান্তর করে সংস্থাটি। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ঢাকার কোরিয়ান দূতাবাসে প্রকল্প প্রস্তাব জমা দেওয়ার শর্ত ছিল।
গত ২৫ জানুয়ারি মন্ত্রণালয়কে জানায় চসিক। তবে এ বিষয়ে এখনো কোনো সম্মতি আসেনি মন্ত্রণালয় থেকে।
মন্ত্রণালয় থেকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে চসিকের কাছে সুস্পষ্ট মতামত চাওয়া হয়েছে। এছাড়া, কেইআইটিআই এবং বিশ্ব ব্যাংকের যৌথ কৌশলগত সহযোগিতায় প্রি–ফিজিবিলিট স্টাডির প্রয়োজন আছে কি না সে বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়।
দুই কোম্পানির প্রস্তাব
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জেএফই ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশনের সমীক্ষা শেষে এক সেমিনারের মাধ্যমে ফলাফল তুলে ধরে।
সংস্থাটি জানায়, নগরীর দুটি বর্জ্যাগার বা ল্যান্ডফিল ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে উঠছে। নতুন ল্যান্ডফিলকে ঘিরে সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালনার প্রস্তাব করা হয়। নগরীতে দৈনিক উৎপাদিত বর্জ্য থেকে মাত্র এক হাজার টন ব্যবহার করে ১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় 'ইন্টিগ্রেটেড ওয়েস্ট ট্রিটমেন্ট' (কম্পোস্ট প্ল্যান্ট, ল্যান্ডফিল সাইট) প্রকল্পের আগ্রহ দেখায় জাপানের কোম্পানি। উৎপাদিত বর্জ্যের ফিজিক্যাল ও কেমিক্যাল গঠন, বর্জ্যে ক্যালোরিফিকের পরিমাণ (দহন মাত্রা), সংগ্রহ ও অপসারণের পরিমাণ এবং সর্বোপরি বর্জ্য ট্রিটমেন্টের যথাযথ টেকনোলজি নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়। পাশাপাশি বর্জ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি ও ল্যান্ডফিলের স্থান স্বল্পতা সমাধানে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে বলেও উল্লেখ করা হয়। উৎসস্থল থেকেই বর্জ্য পৃথকীকরণের ওপর জোর দেওয়া হয়।
এদিকে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দক্ষিণ কোরিয়ার 'দ্য কোরিয়া এনভারনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড টেকনোলজি ইনিস্টিটিউট' (কেইআইটিআই) প্রকল্পের আওতায় এমআরএফ (ম্যাটেরিয়াল রিকভারি ফ্যাসিলিটি) সুবিধা সৃষ্টি করতে চায়। এর মাধ্যমে সংগৃহীত প্লাস্টিক, পিচবোর্ড, কাগজ (সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, অফিসের কাগজ, মিশ্র কাগজ), কাঁচের বোতল এবং জার, অ্যালুমিনিয়াম এবং স্টিলের ক্যানসহ ধাতব পাত্র মেশিনের মাধ্যমে পৃথক করা হবে। এরপর সেগুলো 'ম্যাটেরিয়াল রিকভারি কারখানায় কম্প্যক্ট করে প্রয়োজন অনুসারে কাজে লাগানো হবে। ছোট আকৃতির বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট করা হবে।
এছাড়া, জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধির জন্য প্রচারণা এবং পরিচ্ছন্নকর্মীদের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রশিক্ষণ, সচেতনভাবে বর্জ্য সংগ্রহ করা, ডোর টু ডোর সংগ্রহের জন্য আধুনিক উপকরণ সরবরাহ করতে চায় সংস্থাটি।
প্রকল্পটির আওতায় আরেফিন নগরে স্যানিটারি ল্যান্ডফিলের উন্নয়ন প্রকল্প, একটি আবর্জনাগার বন্ধ করা, ফিকেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, ফুড ওয়েস্ট প্ল্যান্ট, এমআরএফ প্ল্যান্ট এবং বড় আকারের বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট করতে চায়। যুক্ত করতে চায় আধুনিক বর্জ্য পরিবহন ব্যবস্থা। বর্জ্য পরিবহনে কম্পেক্টর (বিশেষ যান) সরবরাহ করবে। সংগ্রহ পদ্ধতিও করা হবে উন্নত।
এছাড়া, ফুড ওয়েস্ট প্ল্যান্টে পরিচ্ছন্ন কর্মীদের সংগৃহীত সবজি (উচ্ছিষ্ট) এবং খাদ্য বর্জ্যকে দুইভাবে কাজে লাগানো হবে। এরমধ্যে একটি অংশ দিয়ে সার এবং অপর অংশ দিয়ে তৈরি করা হবে বায়োগ্যাস।
প্রকল্প বাস্তবায়নে কেইআইটিআই প্রথম ধাপে ১.৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দেবে চসিককে। এছাড়া, পুরো প্রকল্পের জন্য সহজ শর্তে ঋণ দেবে প্রতিষ্ঠানটি।
অন্যান্য প্রস্তাব
চীনের একটি কোম্পানিও চট্টগ্রাম নগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ৩০ একর জমি এবং ৩ হাজার টন বর্জ্য চাওয়া হয়েছে।
এছাড়া স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং সুইডেনভিত্তিক একটি কোম্পানি থেকেও প্রস্তাব পাওয়া গেছে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ছাড়াও, সিটি কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে কাজ ভাগ করে নেওয়ার কথা বিবেচনা করছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পুনর্ব্যবহার, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বায়োগ্যাস উৎপাদন একাধিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রতিযোগিতা তৈরি হবে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রাম সিটির সিইও শেখ মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, "সব প্রস্তাবই বিভিন্ন কম্পোনেন্টের জন্য জমি চাচ্ছে। কিন্তু তাদের বিশাল এলাকা দেওয়া তো সম্ভব না।"
তবে বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।