আমের রাজত্ব দেশি জাতে, ৩৮ বছরের প্রতিষ্ঠানের গবেষণা ‘দায়সারা’
সরকারি হিসাবে দেশের ২২টি জেলায় বাণিজ্যিকভাবে চাষ হলেও ৬০ শতাংশ আম উৎপাদন হয় উত্তরবঙ্গের চার জেলার। সম্ভাবনাময় কৃষি খাতে বিকশিত করতে যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। ৩৮ বছর ধরে চলছে আমের জাত উন্নয়নে গবেষণা। তবে এখনও দেশীয় জাতকে চ্যালেঞ্জ করার মতো নতুন কোনো আমের ধরন উদ্ভাবন করা যায়নি। ফলে এখনও আমের রাজত্ব দেশি জাতের হাতেই; স্বাদ, উৎপাদন কিংবা বাজারের চাহিদারে বিচারেও।
আম এই উপমহাদেশে চাষ হয়ে আসছে প্রায় চার হাজার বছর আগে থেকে। এখন পৃথিবীর অন্তত ১০০টি দেশে বাণিজ্যিকভাবে আম চাষ হচ্ছে। দিন যত যাচ্ছে, আমের চাহিদা তত বাড়ছে। বাড়ছে কৃষি উদ্যোক্তা, উৎপাদনও। কৃষি বিভাগ বলছে, দেশে উৎপাদিত আমের ৬০ ভাগ হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ রাজশাহী ও নাটোরে। এই চার জেলার মধ্যে ইতিহাস ও ঐতিহ্য কিংবা উৎপাদনের বিচারে আমের আঁতুড়ঘর বলা হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জকে। এ কারণে জাত, স্বাদ, গুনাগুণ কিংবা বাজারমুখী আম বিকাশের স্বার্থে এ জেলায় গবেষণা কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
দেশে প্রায় ৮০০ জাতের আম হয়। এর মধ্যে শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জেই প্রায় ৩৫০ ধরনের জাতের আমের চাষ হয়। গুরুত্বের বিচারে ১৯৮৫ সালে বিশ্বরোডের পাশে প্রায় ৩০ একর জমিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। এখন এই গবেষণা কেন্দ্রের নাম পরিবর্তন হয়ে আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র হয়েছে। কেন্দ্রটি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের একটি প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট তিনটি হাইব্রিড, ১৮টি উন্নত জাতের আম উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে ১৪টি চাঁপাইনবাবগঞ্জের এই গবেষণা কেন্দ্র থেকে হয়েছে। অন্যগুলো হয়েছে রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রসহ অন্যান্য স্থান থেকে। দেশে আমের নতুন জাত উদ্ভাবন শুরু হয় মূলত ১৯৯৩ সাল থেকে।
প্রাচীনতম ফল হওয়ার কারণে স্বাদে বিভিন্ন রকম ছিল। এর মধ্যে কোনোটি মিষ্টি, টক, আঁটি বড়, আঁটি ছোট, আঁটি চ্যাপ্টা, শাঁস আঁশযুক্ত, আঁশ ছাড়া। কিন্তু সাধারণ মানুষের পছন্দ ছিল আঁশহীন সুমিষ্ট, রঙিন ও সুঘ্রাণসমৃদ্ধ আম। বিজ্ঞানীরা ভালো মানের আম উদ্ভাবনের লক্ষ্যে গবেষণা করেন। আম উদ্ভাবন প্রক্রিয়া সাধারণত চার ধরনের। এগুলো হলো হাইব্রিডাইজেশন, ইনট্রোডিউস, সিলেকশন ও মিউটেশন।
আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রে এখনো আম গবেষণার উপরই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। এখনও এখানে অন্তত ৬০ প্রজাতির আম নিয়ে গবেষণা চলছে। এখান থেকে মুজিববর্ষ উপলক্ষে বারি-১৩, ১৬, ১৭ ও ১৮ জাতের আম উদ্ভাবন করা হয়েছে। তবে কৃষক পর্যায়ে এখানে গবেষণালব্ধ কোনো জাত ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়নি।
আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণাকেন্দ্র বলছে, বর্তমানে বারি-১১ ও ১২ জাতের আমের জাত কৃষকের কাছে দেওয়া হচ্ছে। মাতৃ জাতের জন্য নার্সারিতে দিতে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। একই গাছে বারি-১১ জাতের আম বছরে তিনবার পাওয়া যায়। অনেক বেশি মিষ্টি হয়। উৎপাদন হয় মার্চ-এপ্রিলে। এই আম আগস্ট-সেপ্টেম্বরেও পাওয়া যায়। ফল শেষ হলে ফের মুকুল আসে। কৃষকের জন্য এই জাতের আম খুব কার্যকর হবে।
তবে গবেষণা কেন্দ্রের উদ্ভাবন নিয়ে চাষীদের ভাষ্য ভিন্ন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ম্যাংগো ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব আহসান হাবীব বলেন, গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারি জাত নিয়ে ব্যস্ত। আমের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, প্রযুক্তি দক্ষতা বৃদ্ধিতে তাদের কোনো কাজ নেই। কিছু জাতের চাহিদা থাকলেও তাদের বারি-১৬, ১১-এর চাহিদা কম। ভালো কোয়ালিটি করতে পারেনি। দেশীয় কোয়ালিটির ধারে-কাছেও যেতে পারেনি।'
তিনি আরও বলেন, 'বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন তারা লেট ভ্যারাইটি উদ্ভাবন করেছেন। এটির দামও বেশি হয়। অথচ তাদের উদ্ভাবনের অনেক আগেই কৃষকদের হাত ধরে বিদেশি জাতের আম ব্যানানা আম চলে আসছে। গৌড়মতি পিওর দেশি জাত। লেট ভ্যারাইটি। বিদেশি জাতের কাটিমন আম লেট ভ্যারাইটি। তাহলে গবেষণা কেন্দ্রের কাজ কী? তারা দায়সারা গবেষণা করে। যুগোপযোগী আম উৎপাদনের মাধ্যমে বাজার তৈরিতে ব্যর্থ তরা। পরে বাধ্য হয়ে আমরা আমকেন্দ্রিক বাইপ্রডাক্ট তৈরির পরিকল্পনা করছি।'
সরকারের এই গবেষণা কেন্দ্র নিয়ে অনেকটা হতাশার সুরে কথা বললেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়শেনের সাধারণ সম্পাদক মুনজের আলম মানিকও। ঢাকায় উচ্চ বেতনের চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তা হওয়া মুনজের বহুমুখী পরিসংখ্যান দিয়ে করে বলেন, 'এখানকার বিজ্ঞানীরা আসলে কৃষকবান্ধব কোনো গবেষণা করতে পারেননি। যে দু-একটি জাত নিয়ে তারা গবেষণা করেছেন, কয়েক বছর পরে সেখানে ভয়াবহ ধস নামবে। গবেষণার মাধ্যমে বাণিজ্যিক ধাঁচের আমের জাত খুবই জরুরি ছিল। আমের খোসা, আঁটি, আঁটির মধ্যে থেকেও অনেক ধরনের পণ্য হতে পারে, সেই বিষয়েও অনেকের ধারণা নেই। অথচ এগুলো নিয়ে অনেক কাজ করার সুযোগ আছে। এসব কিছু করা গেলে শুধু আমকে কেন্দ্র করে জেলায় অন্তত ৪০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।'
রাজশাহীর আম চাষী ও গণমাধ্যমকর্মী তানজিমুল হক বলেন, আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের গবেষণালব্ধ ১৮ টি জাতের মধ্যে মাত্র দু-একটি কৃষক পর্যায়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অথচ তারা প্রায় ৪০ বছর ধরে গবেষণা জারি রেখেছে। রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনের জন্য গবেষণা জোরদার করা উচিত। হাইব্রিড আম দেশীয় জাতের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না।
দেশে ২২ জেলায় বাণিজ্যিকভাবে এখন আম উৎপাদন হচ্ছে জানিয়ে আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মো. মোখলেসুর রহমান বলেন, 'সত্য কথা বলতে আমাদের দেশীয় জাতকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কোনো গবেষণালব্ধ আম এখনও উদ্ভাবন হয়নি। এ কারণে আমাদের বাজারে এখনও দেশি জাতের আম রাজত্ব করছে। তার মধ্যে ল্যাংড়া, খিরসাপাত, ফজলি কিংবা লক্ষণভোগ অন্যতম। রপ্তানিযোগ্য কিংবা বাজারমুখী আমের বিষয়টি মাথায় রেখে এখন গবেষণা চলছে। গবেষকরা এখন আগাম কিংবা লেট ভ্যারাইটি উৎপাদনের জন্য গবেষণা চালাচ্ছেন।'
তিনি আরও বলেন, 'তবে নতুন জাতের আম গবেষণা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। একটি নতুন জাতের জন্য সাত বছর পর্যন্ত কাজ করতে হয়।'
৪ জেলায় ৮ হাজার ৬৭ কোটি টাকার আম উৎপাদন
এবার চার জেলায় ১১ লাখ ৫২ হাজার ৫০৬ টম আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ। অঙ্কের হিসাবে গত আট বছরের ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণ আম উৎপাদন হচ্ছে চার জেলায়। গড়ে প্রতি হেক্টরে ফলানো হয়েছে ১২ দশমিক ৪ টন আম। গড়ে প্রতি কেজি আমের মূল্য ৭০ টাকা ধরলে এর পরিমাণ হয় ৮ হাজার ৬৭ কোটি টাকার উপরে।
এবার ১ হাজার টন আম রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। গত বছর রপ্তানি হয়েছে ২২৩ টন। তার আগের বছর রপ্তানি হয়েছে ৯২ টন। তবে এই বিদেশমুখী চাহিদার পুরোটাই এথনিক বাজারে যায় বলে কৃষকরা জানিয়েছেন। তার মধ্যে বেশি চাহিদা আছে দেশীয় প্রজাতির ল্যাংড়া, খিরসাপাত আমের।