পাসপোর্ট-আতঙ্কে ‘হাওয়ালদার সাহাব গুলি খা লিয়া’
দৃশ্যপট ১
দেশভাগের পর কেটে গেছে বছর দু-তিন। এত দিন বাদে ভারত ও পাকিস্তানের সরকার স্থির করল, এবার দুই দেশের পাগলদেরও ভাগাভাগি হবে। হিন্দু পাগলরা যাবে ভারতে, মুসলিমরা যাবে পাকিস্তানে।
লাহোরের মানসিক হাসপাতালের পাগল বিষাণ সিং। হিন্দু বলে হুকুম হলো তাকে ভারতে যেতে হবে। কিন্তু বিষাণ সিংয়ের বাড়ি যে পাকিস্তানের টোবা টেক সিং-এ! তাই সে টোবা টেক সিং ছাড়া অন্য কোথাও যেতে নারাজ।
অন্যদিকে রাষ্ট্রও তো বিষাণ সিংকে নিস্তার দিতে নারাজ। তাই একদিন তাকে ধরে-বেঁধে নিয়ে যাওয়া হলো ভারতে চালান দিতে। কিন্তু বিষাণ সিং যাবে না কিছুতেই। তাই দুই দেশের কাঁটাতারের বেড়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইল স্থির... এক পা-ও এগোল না। অবশেষে ভোরের দিকে সেই জায়গাতেই পড়ে মারা গেল এই দেশবিহীন পাগল। এক দিকে এক কাঁটাতারের ওপাশে হিন্দুস্তান, আরেক দিকে একটা কাঁটাতারের এপাশে পাকিস্তান।
দৃশ্যপট ২
১৯৫২ সাল। আশ্বিনের এক শেষরাত। রাজশাহী জেলা গোয়েন্দা বিভাগের ডিআইওআইয়ের বাসভবন। সহসা ভোররাতের প্রশান্ত নীরবতা বিদীর্ণ হয়ে গেল দুটি গুলির আওয়াজে। শব্দটা এসেছে ডিআইওআই এ মুহাম্মদের ব্যক্তিগত রক্ষীর কক্ষ থেকে।
বাড়ির সবাই হুড়মুড় করে ছুটে গেল ঘটনাস্থলে। গিয়ে দেখে, নিজে বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে পরপর দুটো গুলি করে আত্মহত্যা করেছেন সুবেদার এইচ সি আলমগীর খান।
সবাই বিভ্রান্ত—আলমগীর খানের মতো একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ কেন হুট করে আত্মহত্যা করবেন? খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, কারণ 'পাসপোর্ট'—আরেকটু স্পষ্ট করে বললে পাসপোর্ট-আতঙ্ক।
অনেক পাঠকই নিশ্চয় ধরে ফেলেছেন, প্রথম দৃশ্যপটটি নেওয়া হয়েছে সাদাত হাসান মান্টোর বিখ্যাত গল্প 'টোবা টেক সিং' থেকে। তবে দ্বিতীয় দৃশ্যপটটি কোত্থেকে নেওয়া হয়েছে, তা অনেক ভেবেও ধরতে পারছেন না নিশ্চয়? না পারারই কথা। কারণ, দুটো মৃত্যুর ধরন ও কারণ প্রায় একই হলেও একটা কল্পিত, আরেকটি বাস্তব।
হ্যাঁ, দ্বিতীয় ঘটনাটি বাস্তব, ঘটেছে এই পূর্ব বাংলায়। মর্মান্তিক এই ঘটনা চাপা পড়ে ছিল ৭০ বছর। গত ডিসেম্বরে আগারগাঁওয়ের জাতীয় আর্কাইভে একটি কাজে গিয়ে পুরোনো নথিপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে পেয়ে যাই এ ঘটনার ফাইল।
এইচ সি আলমগীরের আত্মহত্যার ঘটনায় যাবার আগে উপমহাদেশে পাসপোর্টের প্রচলনের গোড়ার কথাটা জেনে নেওয়া যাক। দেশভাগের আগে ছিল না কোনো পাসপোর্ট-ভিসার বালাই। মানুষ ঢাকা থেকে কলকাতা-লাহোর পর্যন্ত যাতায়াত করতে পারত বিনা বাধায়।
কিন্তু দেশভাগের কয়েক বছর পর চালু হলো পাসপোর্ট। আগের মতো অবাধে ঢাকা-কলকাতা-লাহোর যাতায়াতের সুযোগ রইল না। এতে বিপাকে পড়ল সাধারণ মানুষ। এ বিপাকের একটি খণ্ডচিত্র উঠে এসেছে সাহিত্যিক তারাপদ রায়ের 'হাসতে হাসতে আমেরিকায়' লেখায়। লেখাটির অংশবিশেষ এখানে তুলে দেওয়া প্রাসঙ্গিক:
'...উনিশশো বাহান্ন সালের অক্টোবরে লক্ষ্মীপুজোর দুয়েকদিন পর পাসপোর্ট চালু হলো। অনেকদিন হলো "পাসপোর্ট হবে, পাসপোর্ট হবে" কথাটা চলছিল, দুয়েকবার হবে হবে করে তারিখ ঠিক করেও পিছিয়ে গিয়েছিল। সর্বশেষের তারিখটা পড়েছিল অক্টোবরের তৃতীয় বা চতুর্থ সপ্তাহে।
'কেউ বিশ্বাস করেনি, সত্যিই শেষপর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে, যে দুই দেশ সেদিন পর্যন্ত এক দেশ ছিল, এমন একটা কড়াকড়ি, বিধিবদ্ধ যাতায়াত ব্যবস্থা চালু হবে।
'গড়িমসি করে দিন কাটছিল। পাসপোর্ট-ভিসা চালু হওয়ার তারিখটাকে আমরা তেমন গুরুত্ব দিইনি, কারণ ব্যাপারটা অকল্পনীয়। যেমন, পাঁচ বছর আগে দেশভাগের ব্যাপারটা, আমার বাপ-কাকারা তা নিয়ে মাথাই ঘামাননি, যেন এরকম কিছু ঘটতে পারে না।
'তখনও আমার ঠাকুরমার এক শাশুড়ি বেঁচে ছিলেন। তিনি খুব সম্ভব আমার ঠাকুরদার এক জ্ঞাতিকাকার স্ত্রী। আমার ঠাকুরমা যথাসম্ভব উপেক্ষা করতেন, আবার ভয়ও পেতেন সেই বড়ো ঠাকুরমাকে।
'আমি কলকাতায় কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে বড়ো ঠাকুরমা আমাকে বলতেন, "তোর সঙ্গে আমি কলকাতায় যাব। দক্ষিণেশ্বরে যাব, কালীঘাটে যাব, তারকেশ্বরে যাব, শ্রীরামপুরে গোঁসাই বাড়িতে আমার মামার বাড়ি। সেখানে আমাকে নামিয়ে দিবি। তারপর তোকে আর কিছু করতে হবে না।"
'পাসপোর্ট হওয়ার কথা উঠতে বড়ো ঠাকুরমাকে সে কথা বলতে তিনি অবশ্য পাসপোর্ট কী বুঝতে পারলেন না। তিনি বললেন, "সিরাজগঞ্জ গিয়ে টিকিট কিনে রেলগাড়িতে উঠব, শেয়ালদায় নামব। টিকিট কেটে যাব, পাছপুট লাগবে কেন?" আমি বোঝালাম, "পাসপোর্ট হল ছাড়পত্র। এই ছাড়পত্র নিয়ে প্রত্যেককে যেতে হবে।"
'বুড়ি কিছুই বুঝলেন না, তখন কানেও কম শোনেন, অনেকক্ষণ ভেবেচিন্তে তারপর গজগজ করতে লাগলেন, "কলকাতায় কি ছারপোকা কম পড়েছে যে সকলকে একটা করে ছারপোকা নিয়ে যেতে হবে?"'
ফিরে যাওয়া যাক ১৯৫২ সালের রাজশাহীর সুবেদার আলমগীর খানের আত্মহত্যায়। দেশভাগের পর আলমগীর ও তার পরিবারের সদস্যরা পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু তার শ্বশুরবাড়ি পড়েছিল ভারতে।
তাই আলমগীরের মনে ভয় জেঁকে বসেছিল, তিনি ও তার স্ত্রী-সন্তানেরা হয়তো কখনো ভারতে ঢুকতে পারবেন না। ভারতে রেখে আসা তাদের সহায়-সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত হবে।
এইচ পি লাভক্রাফট লিখেছেন, 'মানুষের সবচেয়ে প্রাচীন ও শক্তিশালী আবেগ হলো ভয়। আর সবচেয়ে প্রাচীন ও সবচেয়ে শক্তিশালী ভয় হলো অজানার আতঙ্ক।' তার এই কথার যথার্থ প্রতিফলন দেখা গেল আলমগীরের ঘটনায়। পাসপোর্ট কী জিনিস, এটা কী কাজে আসে, এটা না থাকলে কী পরিণতি হতে পারে—এসব নিয়ে আগে কখনো ভাবেননি তিনি, ভাবার সুযোগ বা প্রয়োজনও পড়েননি। জানেনও না এ জিনিস কেন এত দরকারি। তাই যখন হুট করে বলা হলো, সদ্য জন্ম নেওয়া পাকিস্তান থেকে ভারতে যেতে পাসপোর্ট লাগবে—তখন স্বাভাবিকভাবেই তার মনে জন্ম নিল অজানা পরিণতির ভয়।
আর সেই আতঙ্কই তাকে কুরে কুরে খেতে লাগল। একসময় তা হয়ে উঠল প্রাণসংহারী। তীব্র মানসিক যন্ত্রণা সইতে না পেরে অবশেষে এক ভোর রাতে নিজের বুকে গুলি করে আত্মহত্যা করলেন আলমগীর খান। নিজেকে মুক্তি দিলেন সমস্ত দুশ্চিন্তা থেকে। কাঁটাতারের বেড়ায় বিভক্ত দেশ ছেড়ে পাড়ি জমালেন সীমান্তবিহীন অজানা এক দেশে। যেখানে প্রয়োজন পড়বে না কোনো পাসপোর্ট-ভিসার।
আলমগীর খানের আত্মহত্যা নিয়ে পুলিশ বিশদে তদন্ত করে সিদ্ধান্তে আসে তিনি পাসপোর্ট-সংক্রান্ত দুশ্চিন্তার কারণেই আত্মহত্যা করেছেন। সেই তদন্তের প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিক চিঠির মাধ্যমে জানানো রাজশাহীর পুলিশ সুপারিনটেনডেন্টকে। ইংরেজিতে লেখা ওই চিঠির বাংলা অনুবাদ এ রকম:
স্যার,
যথাবিহিত সম্মানপূর্বক জানাচ্ছি যে আমার রক্ষী এইচসি আলমগীর খান নিম্নোক্ত পরিস্থিতিতে আত্মহত্যা করেছেন। ৩.১০.১৯৫২ তারিখে সকাল ছয়টায় আমার এসপির সঙ্গে মফস্বলে যাওয়ার কথা ছিল, তাই আমি ভোর ৪টায় ঘুম থেকে উঠি। বিছানায় শোয়া অবস্থায়ই সহসা শুনতে পেলাম নিচতলার আমার ব্যক্তিগত রক্ষীর কক্ষ থেকে দুটো শব্দ ভেসে এল। এইচসি আলমগীর খান, জিসি আব্দুল মজিদ ও জিসি আব্দুল হালিম (মৃতের শ্যালক) সেখানে ঘুমাচ্ছিলেন।
আমি সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে আমার কক্ষের বারান্দায়, রক্ষীদের কক্ষের ওপরে দাঁড়ালাম' তারপর বারান্দা দিয়ে দৌড়ানোর সময় লক্ষ করলাম, রক্ষীদের কামরার বাতি জ্বালানো (দক্ষিণ দিকের খোলা জানালা দিয়ে আলোর ঝলকানি আসছিল)। এর পরপরই আমি রক্ষীদের কক্ষ থেকে পিজি আব্দুল মজিদের চিৎকার-চেঁচামেচির আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি পিজি আব্দুল মজিদকে ভেতরে ডেকে জানতে চাইলাম, কী হয়েছে। তিনি কান্নারুদ্ধ কণ্ঠে উত্তর দিলেন—'হাওয়ালদার সাহেব গুলি খা লিয়া।' অর্থাৎ এইচসি গুলি করে আত্মহত্যা করেছেন।
সঙ্গে সঙ্গে আমি নিচে নেমে রক্ষীদের কামরায় দৌড়ে গেলাম। দেখলাম, এইচসি মারা গেছেন। চিত হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন তিনি। শরীরে দুটি বুলেটের ক্ষত—একটি বাঁ বুকের ওপরের অংশে, অপরটি তার খানিক নিচেই। আর রিভলবারটা পড়ে আছে তার ডান হাতের পাশে। ডান হাতটা বিছানার ওপর পড়ে রয়েছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে জিসি আব্দুল মজিদকে পাঠালাম ওসি বিয়ালিয়াকে নিয়ে আসতে এবং এসপিকে ফোন করে খবরটি জানালাম।
এসপি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তার নির্দেশনায় অতিরিক্ত এসপির উপস্থিতিতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
মৃতের শ্যালক এবং অন্যান্য সূত্রকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তার আত্মহত্যার পেছনে কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ নির্ণয় করা যায়নি। তারা জানিয়েছেন, এইচসি আলমগীর কোনো পারিবারিক বা অন্য কোনো সমস্যায় ভুগছিলেন না। শুধু গত কয়েক দিন পাসপোর্ট চালু হওয়ার কারণে খুব বিভ্রান্ত ছিলেন। আমি নিজেও খেয়াল করেছি যে তিনি এই পাসপোর্টের বিষয়টি নিয়ে যখন-তখন যার সঙ্গে দেখা হচ্ছে, তার সঙ্গেই আলাপ করছেন। তার ধারণা ছিল, পাকিস্তানে থেকে গিয়ে পাকিস্তানি নাগরিকত্ব গ্রহণ করায় তাকে আর ভারতে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। তার স্ত্রীও স্বামীর দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করায় ভারতে প্রবেশ করতে পারবেন না এবং তাদের সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হবে।
তাকে পাসপোর্টের সব নিয়মই বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি সম্ভবত এসব নিয়মের ওপর তেমন একটা ভরসা করতে পারেননি। এই দুশ্চিন্তাতেই সম্ভবত বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। এবং এই চিন্তাই তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে, তিনি মারা গেলে আর তার পাকিস্তানি নাগরিকত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠবে না এবং তার স্ত্রী ও সন্তানেরা ভারতীয় নাগরিক হিসেবে সেখানকার সম্পত্তি ভোগ করতে পারবেন। তিনি কোনো চিঠি লিখে যাননি।
বিনীত,
এ. মুহাম্মদ
ডি.আই.ও.আই.
ডিসট্রিক্ট ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ,
রাজশাহী, ৮ নভেম্বর, ১৯৫২
ঘটনাটি পড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বুক চিরে। মনে পড়ে গেল রুশ লেখক আইজাক বাবেলের লেখা ছোটগল্প 'বুড়ো শ্লয়মি'র কথা। গল্পটি রাশিয়ার ইহুদিদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ নিয়ে। চিরকাল ধর্মকর্ম নিয়ে উদাসীন ইহুদি বুড়ো শ্লয়মিকে গল্পের শেষে দেখা যায় ধর্মান্তরিত করার নীরব প্রতিবাদ হিসেবেই ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করছে। নিজের প্রাণ দিয়েই সে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া জুলুমের বিরোধিতা করে গেল।
পূর্ব বাংলার 'হাওয়ালদার'ও যেন বুড়ো শ্লয়মি কিংবা টোবা টেক সিংয়েরই বাস্তব প্রতিরূপ। কলমের খোঁচায় ভাগ করে দেওয়া দেশকে ঘিরে পাসপোর্ট নামের একটি অজ্ঞাত জিনিস তাদের জীবনে আবির্ভূত হলো, যা তখনও তাদের বোধে ধরা দিচ্ছিল না—দেশ হারা ও অবাধ চলাচল রদ হয়ে যাওয়ায় দিশেহারা অবস্থাই চূড়ান্ত পরিণতি পেল রক্ষীর আত্মহননের মাধ্যমে।