নিখোঁজ টাইটানিক সাব: শব্দ উৎস খুঁজে বের করাই এখন লক্ষ্য
টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে গিয়ে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে পর্যটকবাহী সাবমেরিন হারিয়ে যাওয়ার এলাকা থেকে শব্দ শোনার কথা জানিয়েছে একটি উদ্ধারকারী দল। যুক্তরাষ্ট্রের কোস্ট গার্ডের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানায়, একটি কানাডিয়ান পি-থ্রি বিমান পানির নিচ থেকে শব্দ পেয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর বিশেষজ্ঞরা এটি বিশ্লেষণ করছেন। খবর বিবিসির
মঙ্গলবার এই শব্দ পাওয়ার পর উদ্ধারকারী দল 'এই শব্দের উৎস খুঁজতে' পানির নিচে তাদের রোবটিক অনুসন্ধান অভিযান নতুন স্থানে পরিচালনা করছেন। বুধবার বেশ কয়েকটি টুইটের মাধ্যমে এসব তথ্য জানিয়েছে কোস্ট গার্ড।
অনুসন্ধান অভিযানে নেতৃত্বদানকারী ইএস কোস্টগার্ডের রিয়ার অ্যাডমিরাল জন মাউজার বলেছেন, এই শব্দই আমাদের লক্ষ্য। আমাদের অনুসন্ধান প্রচেষ্টা এর উৎসের দিকেই নিবদ্ধ। তবে আমরা এই শব্দের উৎস কি, তা জানি না।
নতুন স্থানে আরওভি (রিমোটলি অপারেটেড ভেইক্যালস) অনুসন্ধানে এখনও কিছু পাওয়া যায়নি, তবে অনুসন্ধান চলতে থাকবে বলে জানিয়েছে কোস্ট গার্ড।
তবে কি ধরনের এবং কেমন মাত্রার শব্দ পাওয়া গেছে বা কিভাবে তারা এই শব্দ পেয়েছে তা বিস্তারিত জানায়নি কোস্ট গার্ড।
কর্তৃপক্ষ শব্দ পাওয়ার খবর আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করার এক ঘণ্টা আগেই খবরটি প্রথম জানায় মার্কিন গণমাধ্যমগুলো।
সিএনএন এবং রোলিং স্টোন ম্যাগাজিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সরকারি যোগাযোগের বরাত দিয়ে মঙ্গলবার দিনের শেষে জানায় যে, কানাডিয়ান বিমান সাবমেরিনটি হারিয়ে যাওয়ার এলাকায় ৩০ মিনিটের ব্যবধানে এক ধরনের শব্দ শুনতে পেয়েছে।
রোলিং স্টোন শব্দ পাওয়ার খবরটি প্রথম জানায়। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, সাবমেরিন নিখোঁজের এলাকায় মোতায়েন করা সোনার ব্যুয়ে এই শব্দ শনাক্ত করেছে এবং চার ঘণ্টা পর বাড়তি সোনার আরও শব্দ পেয়েছে ওই স্থান থেকে।
'টাইটান' নামক নিখোঁজ সাবমেরিনটি উদ্ধারে মঙ্গলবার তৃতীয় দিনের মতো উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে তল্লাশি চালিয়েছে উদ্ধারকারীরা।
২১ ফুট লম্বা, 'টাইটান' নামক ওই সাবমেরিনটি পানির নিচে ৯৬ ঘণ্টা পর্যন্ত থাকার মতো করে নির্মাণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে এটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। তাই সাবমেরিনে থাকা পাঁচ যাত্রীর হাতে আগামীকাল বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত সময় আছে টিকে থাকার। এমতাবস্থায়, সময়ের সাথে লড়াই করছেন উদ্ধারকারীরাও। একজন পাইলট এবং চারজন যাত্রী নিয়ে রবিবার এই ছোট আকৃতির সাবমেরিনটি আটলান্টিকের তলদেশে ডুব দেয়। কিন্তু এর এক ঘণ্টা ৪৫ মিনিট পরেই প্যারেন্ট জাহাজের সাথে সাবমেরিনটির যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, সাবমেরিনটি উদ্ধারের কাজে এরই মধ্যে যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এ ঘটনার প্রেক্ষিতে আবারও যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওশানগেট এক্সপেডিশনস নির্মিত এই সাবমেরিনের সেফটি ডিজাইন ও ডেভেলপমেন্ট নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
১৯১২ সালে যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন থেকে নিউইয়র্কের উদ্দেশে প্রথম যাত্রাতেই ভাসমান হিমশৈলের সঙ্গে ধাক্কা লেগে টাইটানিক ডুবে যায়। এই দুর্ঘটনায় জাহাজে থাকা ২ হাজার ২০০ যাত্রী ও ক্রুদের মধ্যে প্রায় দেড় হাজার জন নিহত হন। ১৯৮৫ সালে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার হয়।
টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ ম্যাসাচুসেটসের কেপ কড থেকে প্রায় ৯০০ মাইল (১৪৫০ কিলোমিটার) পূর্বে এবং সেন্ট জন'স, নিউফাউন্ডল্যান্ডের সেন্ট জন'স থেকে ৪০০ মাইল (৬৪৪ কিলোমিটার) দক্ষিণে অবস্থিত।
ইউএস কোস্ট গার্ড ক্যাপ্টেন জেমি ফ্রেডেরিক মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বলেন, মার্কিন ও কানাডিয়ান বিমান সমুদ্রে ৭৬০০ বর্গমাইলেরও বেশি অঞ্চল অনুসন্ধান করেছে, যে অঞ্চল কিনা যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট রাজ্যের চাইতেও বড়।
নিখোঁজ সাবমেরিন 'টাইটান' থেকে যেকোনো ধরনের শব্দ পাওয়ার আশায় কানাডিয়ান সেনাবাহিনী সোনার ব্যুয়ে ছেড়েছে সমুদ্রে। একটি রিমোট কন্ট্রোলড ডিপওয়াটার সাবমার্সিবলসহ একটি বাণিজ্যিক জাহাজও ঘটনাস্থলের কাছে অনুসন্ধানে কাজ করছে বলে জানান ফ্রেডেরিক।
এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর অনুরোধে আলাদাভাবে একটি ফরাসি রিসার্চ শিপ তাদের নিজস্ব ডিপ-সি ডাইভিং রোবট ভেসেলসহ রওনা দিয়েছে এই উদ্ধার অভিযানের অংশ হতে। বুধবার স্থানীয় সময় রাতেরবেলা তাদের এসে পৌঁছানোর কথা, জানায় ইফ্রেমেয়া গবেষণা ইনস্টিটিউট।
নিখোঁজ সাবমেরিন 'টাইটান'-এ থাকা যাত্রীদের মধ্যে ছিলেন ৫৮ বছর বয়সী ব্রিটিশ বিলিয়নিয়ার হ্যামিশ হার্ডিং, পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ী শাহজাদা দাউদ (৪৮) এবং তার ১৯ বছর বয়সী ছেলে সুলেমান; এরা দুজনেই ব্রিটিশ নাগরিক।
এছাড়াও, ফরাসি নৌবাহিনীর সাবেক কমান্ডার পল-অঁরি নারজিওলে এবং ওশানগেটের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী স্টকটন রাশও এই সাবমেরিনে ছিলেন বলে জানা গিয়েছে। যদিও কর্তৃপক্ষ এখনও যাত্রীদের পরিচয় নিশ্চিত করেনি।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টাইটান সাবমেরিনটি খুঁজে বের করা এবং যাত্রীদের বাঁচানো, উভয় ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য বাধার মুখোমুখি হচ্ছেন উদ্ধারকারীরা।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের একজন মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং অধ্যাপক অ্যালিস্টেয়ার গ্রেইগ বলেন, সাবমেরিনটি যদি মিড-ডাইভ ইমার্জেন্সি পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে থাকে, তাহলে পাইলট হয়তো ইতোমধ্যেই সাবমেরিনটি পানির উপরে ভাসিয়ে আনতে সাবমেরিন থেকে ভার কমানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় বিশাল আটলান্টিক মহাসাগরে ভ্যান-আকৃতির ছোট একটি সাবমেরিন খুঁজে বের করা খুবই চ্যালেঞ্জিং কাজ।
যেহেতু সাবমেরিনটি বাইরে থেকে খিল আটকানো (বোল্ট দিয়ে আটকানো), তাই পানিতে ভেসে উঠলেও, বাইরে থেকে দরজা না খুলে দিলে যাত্রীরা বের হতে পারবে না।
আর সাবমেরিনটি যদি 'ওশান ফ্লোর'-এ থাকে, তাহলে দুই মাইলের বেশি গভীরতায় চরমভাবাপন্ন অবস্থার কারণে এটি উদ্ধার করা আরও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ সমুদ্রের ১২৫০০ ফুট নিচে, যেখানে কোনো সূর্যের আলো প্রবেশ করে না। শুধুমাত্র বিশেষভাবে নির্মিত সরঞ্জাম নিয়ে গেলেই, পানির প্রচণ্ড চাপে পিষ্ট না হয়ে সেখানে প্রবেশ করা সম্ভব।
টাইটানিক বিশেষজ্ঞ টিম ম্যাটলিন বলেন, "এটা কিছুটা একজন নভোচারীর মহাকাশে যাওয়ার মতোই ব্যাপার। যদি সাবমেরিনটা 'সীবেড'-এ থাকে, তাহলে আমার মনে হয় খুব কম সংখ্যক সাবমেরিনই ওই পর্যন্ত গভীরে যেতে পারবে। তাই আমার মনে হয় সাব-টু-সাব উদ্ধার কার্যকরী করা প্রায় অসম্ভব।"