কোরবানির ছুটা মাংসের হাট: প্রয়োজনে কেউ কিনছেন, কেউ বা বিক্রি করছেন
মৌসুমি দিনমজুর মো. আবু সাঈদ কয়েক ভাগ মাংস নিয়ে বসেছেন চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ে। সঙ্গে তার ছয় বছর বয়সী মাদ্রাসাপড়ুয়া ছেলে সিফাতুর রহমান শাওন। বৃহস্পতিবার (২৯ জুন) ইদুল আযহার দিনজুড়ে নগরীর খুলশী এলাকার তিনটি বাড়িতে কসাইয়ের কাজ করেছেন তিনি। ৪ হাজার টাকার পাশাপাশি প্রায় ১০ কেজি মাংস পেয়েছেন তিন বাড়ি থেকে। বিকালে মাংসগুলো তিন ভাগ করে বিক্রির জন্য বসেছেন এখানে।
আবু সাঈদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ছেলেকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়েছি। হাফেজি পড়াচ্ছি। এখানে খরচ আছে। তাই মাংস বিক্রির টাকাটুকু ছেলের পড়ার খরচের জন্য রেখে দেব। বিভিন্ন ক্লাবে বয়ের কাজ করি। কাজ না থাকলে রিকশাও চালাই। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যে হারে বেড়েছে, তাই মাংসগুলো বিক্রি করে দিচ্ছি।'
ভোলার আবু সাঈদ পরিবার নিয়ে বসবাস করেন খুলশীর ঝাউতলার একটি বস্তিতে। পরিবারের জন্য মাংস রেখেছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ক্লাবের মহাজন কিছু মাংস পাঠিয়েছেন। তা দিয়েই চলবে।'
আবু সাঈদের মতো নিম্ন-আয়ের মানুষেরা ঈদুল আযহার পাওয়া অতিরিক্ত মাংস বিক্রি করতে এসেছেন চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন মোড়ে। কেউ কেউ সামর্থ্যবানদের বাসাবাড়ি থেকে কোরবানির মাংস খুঁজে পেয়েছেন। কেউ বা কসাই বা সহযোগী হিসেবে কাজ করার বিনিময়ে পেয়েছেন কিছু মাংস। এসব মাংস বিক্রি করছেন তারা।
নগরীর জিইসি, দুই নম্বর গেট, মুরাদপুর, বহাদ্দারহাট, ওয়াসা, কাজির দেউরি, দেওয়ানহাট, চকবাজার, নতুন ব্রিজ, নিউ মার্কেট, একে খান, কর্নেলহাট, অক্সিজেনসহ শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে এসব ছুটা মাংস নিয়ে বসেছেন নিম্ন আয়ের মানুষেরা। আর প্রয়োজন অনুসারে মাংস কিনে নিচ্ছেন ক্রেতারা। এসব মোড় যেন অস্থায়ী মাংসের হাটে পরিণত হয়েছে।
কেজি দরে মানভেদে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকায় মাংস বিক্রি হচ্ছে এসব হাটে। আবার থলিতে করেও ভাগে ভাগে বিক্রি করছেন অনেকে। পরিমাণ অনুসারে ১২০০, ১৫০০, ১৮০০, ২৫০০, ৩৫০০ ও ৫০০০ হাজার টাকায় দর দিচ্ছেন বিক্রেতারা। দর কষাকষির পর তা কিনে নিচ্ছেন ক্রেতারা।
জিইসি মোড়ে ৫ হাজার টাকা এক ব্যাগ মাংসের দাম হাঁকাচ্ছেন দম্পতি বাদশা মিয়া ও রিমা আক্তার। নগরীর ঝাউতলা রেলগেটে বসবাসকারী এই দম্পতির মধ্যে স্বামী দিনমজুর ও স্ত্রী বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। নগরীর শেষপ্রান্ত কালুরঘাটের কর্ণফুলী নদীর পাড়ের বিভিন্ন বসতবাড়িতে মাংস খুঁজেছেন দিনভর। সারাদিনের পাওয়া মাংস দুই ভাগে বিক্রি করতে এনেছেন তারা। এক ভাগ সাড়ে ৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। এরপর শেষ ব্যাগের দাম হাঁকাচ্ছিলেন ৫ হাজারে।
বাদশা মিয়া ও রিমা আক্তার টিবিএসকে বলেন, 'বেশি মাংসের প্রয়োজন নেই। টাকা পেলে কিছু ঋণ পরিশোধ করতে পারব। অল্প কিছু মাংস রেখেছি খাওয়ার জন্য। বাকিগুলো বিক্রি করতে এনেছি।'
নগরীর ভ্রাম্যমাণ বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী গরীবুল্লাহ শাহ মাজারে বসবাস করেন বর্তমানে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তার পরিবার থাকে। মানুষের দান করা এক কেজির মতো গরুর মাংস দুই নম্বর গেট এলাকার সিএনজিচালক মো. শাহাজাহানের কাছে বিক্রি করছিলেন তিনি। শাহাজাহান বলেন, 'পরিবার নিয়ে বহাদ্দারহাটে থাকি। কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য নেই। তাই আজ সিএনজি নিয়ে বের হয়েছি। পরিবারের জন্য কিছু মাংস কিনেছি।'
মোহাম্মদ আলী বলেন, 'আমার এই শহরে কেউ নেই। রান্নার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই এক কেজির মতো মাংস ৬০০ টাকায় বিক্রি করেছি।'
সাত বছর বয়সী কন্যাকে নিয়ে বোনের ঘর নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী এলাকায় যাচ্ছিলেন মদিনা বেগম। পথিমধ্যে দুই নম্বর গেটে কিছু মাংস কিনতে দরদাম করছিলেন তিনি। মদিনা বলেন, 'আমিও কোরবানি দিতে পারিনি। আমার স্বামী চাকরি থেকে কিছু মাংস এনেছেন। আমার বোনের বাসায় যাচ্ছি। তাদের সামর্থ্য নেই। তাই ১,২০০ টাকা দিয়ে কিছু মাংস কিনছি বোনকে দেওয়ার জন্য।'
ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবাদত হিসেবে ধরা হয় কোরবানিকে। সামর্থ্যবানরা আল্লাহর নামে কোরবানি দেন। নিয়মানুযায়ী, কোরবানির পরশুর তিন ভাগের এক ভাগ মাংস দুস্থ-গরীবদের, এক ভাগ আত্মীয়স্বজনদের এবং নিজেদের জন্য বরাদ্দ রাখতে হয়। শহরের গরীব-দুস্থরা বাসাবাড়িতে গিয়ে মাংস খুঁজে নেন।
চট্টগ্রাম জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এবার চট্টগ্রামে ছোট বড় ৩,০০০ খামারে প্রস্তুত করা হয়েছিল ৫০ হাজার কোরবানিযোগ্য পশু।