পোশাক কর্মী থেকে যেভাবে উদ্যোক্তা হলেন বেবি হাসান
১৯৮০-র দশকে স্কুলের গণ্ডি না পেরোতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় বেবি হাসানকে।
স্বামীর স্বল্প রোজগারে সংসার চলছিল না। তাই ১৯৮৪ সালে সানটেক্স নামক পোশাক কারখানায় কাজ নেন সদ্য বিবাহিত বেবি।
প্রথমে সাধারণ কর্মী হিসেবে যোগ দিলেও নিজের যোগ্যতা ও দক্ষতায় বেবি সাত বছরের মধ্যে হয়ে ওঠেন পোশাক কারখানার উৎপাদন পরিচালক (ওয়ার্কিং পার্টনার)।
পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে বেবি হাসান যোগ দেন বায়িং হাউজে। দীর্ঘদিন ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানের চট্টগ্রামের ইনচার্জ হিসেবে কাজ করেন।
কাজের সুবাদে ঢাকা-চট্টগ্রামের বেশিরভাগ পোশাক কারখানা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে বেবি হাসানের। তখন চাকরির পাশাপাশি স্বল্প পরিসরে নিজের ব্যবসা শুরু করেন।
বিশেষ করে অর্ডার বাতিল হওয়া পণ্যগুলো কম দামে কিনে নিয়ে বাইরে বিক্রি করতেন বেবি হাসান। চাকরি ও ব্যবসা দুটো একসঙ্গে চালানো কঠিন হলে ২০০২ সালে চাকরি ছেড়ে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে পুরোদমে ব্যবসা শুরু করেন তিনি।
দুই লাখ টাকা ব্যাংক ঋণ নিয়ে শুরু করা ব্যবসা পাঁচ বছর খুব ভালোই চলছিল। ওই সময় মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইউরোপে, বিশেষ করে ফ্রান্সে পণ্য শিপমেন্ট করত তাদের প্রতিষ্ঠান।
পরবর্তীতে ২০০৭ সালে এককভাবে ব্যবসা শুরু করেন বেবি হাসান। ওই সময় থেকেই ইউরোপের বাজারে পণ্য সরবরাহ করে আসছে তার প্রতিষ্ঠান 'বিএস অ্যাপারেলস'।
স্বাভাবিক সময়ে বছরে ২৫-৩০ কনটেইনার তৈরি পোশাক সরবরাহ করে আসছে বিএস অ্যাপারেলস। তবে চলমান দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংকটে অর্ডার কিছুটা কমে এসেছে।
দেশের বিভিন্ন কারখানায় তার প্রতিষ্ঠানের পণ্য তৈরি হয়।
তার এই কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত রয়েছেন ৮০ জনের বেশি কর্মী। বেবি হাসানের প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান বার্ষিক টার্নওভার ৫ কোটি টাকারও বেশি।
গত কয়েক বছর ধরে বিএস অ্যাপারেলসের প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বেবি হাসানের ছেলে সালাউদ্দিন চৌধুরী রাসেল।
এই নারী যে পোশাক কর্মী থেকে শুধু সফল উদ্যোক্তা হয়েছেন তা নয়, গত ৫ বছর ধরে পরিবারের সদস্যদের সবজি ও ফলের জোগান নিশ্চিত করেছে তার গড়ে তোলা ছাদ বাগান।
ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে সময় দেওয়ার পর বাসায় পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই ছুটে যান ছাদে। পরিচর্য়া করেন নিজের লাগানো গাছপালার, যেখানে সব রকমের সবজি ছাড়াও ৭০ ধরনের ফলজ ও ওষুধি গাছ রয়েছে ।
সংগ্রামী জীবন সম্পর্কে চাইলে বেবি হাসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, '১৯৯০-এর দশকে বায়িং হাউজে চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ ৫-৬ জন নারী কাজ করত। তখন বায়িং হাউজে নারীদের কাজ করা ছিল খুবই কঠিন। কারণ অর্ডার প্লেস করা, তৈরি শেষে পণ্য তুলে আনা, ইন্সপেকশন করা—এসব কাজে প্রচুর সময় দিতে হয়।
'ইয়ার ক্লোজিংয়ে দেখা যায়, একসঙ্গে ৩০-৪০ কারখানায় অর্ডার থাকে। একজন নারীকে প্রতিদিন কারখানাগুলো ভিজিট করে কাজের তদারকি করা খুবই কঠিন। এক পোশাক কারখানা থেকে আরেক কারখানা, এভাবে ভিজিট করতে করতে মধ্যরাত পর্য়ন্ত কাজ করতে হতো।'
বেবি হাসান বলেন, 'যখন চাকরি করি, তখন দুইটা ছোট বাচ্চা। অনেকসময় বাচ্চাদের অসুস্থ রেখেও কাজের জন্য ছুটে গিয়েছি। এতে বাচ্চা কিংবা পরিবারের কাছে ছোট হতে হয়েছে। কিন্তু আমি মনে করেছি, এটা আমার জব, এটা ঠিকমতো করতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমি দীর্ঘ ২০ বছর ধরে একই বায়ারকে পণ্য সরবরাহ করছি। মান ও কমিটমেন্টের কারণে এক বায়ারের সঙ্গে বিশ্বস্ততার সঙ্গে এত বছর কাজ করা সম্ভব। এই পথ চলতে অনেক বাধা এসেছে। কিন্তু সেই বাধা অতিক্রম করেছি।'
বেবি হাসান শুধুই নিজেই যে উদ্যোক্তা হয়েছেন তা নয়, নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে ব্যবসার শুরু থেকে বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন। ব্যবসা শুরুর পরপরই ২০০০ সালে ঢাকার ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের একটি সংগঠনের সদস্য হন তিনি।
পরবর্তীতে ২০০৭ সালে চিটাগাং উইম্যান চেম্বার প্রতিষ্ঠা হলে সংগঠনটির সদস্য হন তিনি। সংগঠনের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে যেমন দক্ষ করে তুলেছেন, পাশাপাশি নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতেও ভূমিকা রেখেছেন।