দেশের মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থায় নতুন যুগের শুরু
অর্থের চেয়ে মেধাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে অবশেষে বাংলাদেশে মেডিকেল কলেজ ভর্তি প্রক্রিয়ায় এক উল্লেখযোগ্য নীতিগত পরিবর্তন এসেছে।
সরকারি মেডিকেল কলেজে বিদ্যমান ভর্তি পদ্ধতির মতোই বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর জন্যও সরকার অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু করেছে। সেইসঙ্গে ভর্তি ফিও নির্ধারণ করে দিয়েছে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার টাকা।
নতুন এই ডিজিটাইজড সিস্টেমের অধীনে, প্রাইভেট মেডিকেল কলেজের ভর্তিতে এখন প্রার্থীদের মেধা এবং কলেজ পছন্দের তালিকাকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। সরকারের এই সিদ্ধান্তটি আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং মেধাভিত্তিক মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
এই নীতি পরিবর্তনের মূল লক্ষ্য হলো, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর অতিরিক্ত ভর্তি ফি আদায় বন্ধ করা।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিজিএমই) মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ টিটু মিয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "প্রাইভেট মেডিকেল কলেজেও যাতে মেধার মূল্যায়ন হয়, সেজন্য আমরা অটোমেশন বাস্তবায়নে কাজ করছি। যার সিরিয়াল ৭ হাজার সে যদি প্রাইভেট মেডিকেলে ভর্তি হতে না পেরে ৭০ হাজার সিরিয়ালের কেউ শুধু টাকার জোরে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়, সেটা আসলে ঠিক নয়।"
"আমরা আশা করছি, এটি বাস্তবায়ন করা গেলে প্রাইভেট মেডিকেল এডুকেশনে অনিয়ম কমবে," যোগ করেন তিনি।
গত ১০ মার্চ দেশের মেডিকেল কলেজগুলোতে এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেতে ওই পরীক্ষায় অংশ নেয় ১ লাখ ৩৫ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী।
এরমধ্যে উচ্চ নম্বর পেয়ে মেধা তালিকার প্রথম দিকে থাকা কিছু শিক্ষার্থী সরকারি মেডিকেল কজেলগুলোতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়।
এই প্রার্থীদের মধ্যে, মোটামুটি ৪৯,০০০ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় ন্যূনতম পাশ নম্বর ৪০ পেয়েছে। আগে এই ন্যূনতম নম্বর নিয়েই ২০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত ফি দিয়ে দেশের নামীদামী বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেতো শিক্ষার্থীরা। আর যারা উচ্চ নম্বর পেয়েও মেধা তালিকায় সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেতো না এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে বেসরকারি মেডিকেল কলেজেও ভর্তি হতে পারতো না, তারা মেডিকেল শিক্ষার সুযোগ থেকেই বঞ্চিত হতো।
মূলত এসব কারণেই মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থায় নতুন নীতি নিয়ে এসেছে সরকার। ভর্তি প্রক্রিয়া চলাকালীন মেধা এবং একাডেমিক পারফরম্যান্সের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বিদ্যমান ভারসাম্যহীনতা দূর করাই এই নীতির উদ্দেশ্য।
ভর্তি অনিয়ম বন্ধে অটোমেশন
এ বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিজিএমই) মেডিকেল কলেজে ভর্তি ইচ্ছুকদের জন্য তাদের মেধাতালিকা ও পছন্দ অনুযায়ী বেসরকারি মেডিকেল কলেজ নির্ধারণ করে দিয়েছে।
গত ২২ জুন ডিজিএমই'র জারি করা এক সার্কুলারে বলা হয়, সাম্প্রতিক এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা আগামী ৩ থেকে ৯ জুলাই পর্যন্ত তাদের পূর্ব নির্ধারিত পছন্দ অনুযায়ী বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে।
ডিজিএমইর তথ্য অনুযায়ী, দেশে অনুমোদিত বেসরকারি মেডিকেল কলেজ আছে ৬৬টি। এতে মোট আসন সংখ্যা ৬,২০৮টি। এরমধ্যে দেশি শিক্ষার্থীদের জন্য আসন রয়েছে ৩,৩৩২টি ও বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ২,৫৫১টি।
দেশি শিক্ষার্থীদের ৩,৩৩২টি আসনের বিপরীতে অনলাইনে আবেদন পড়েছিল ৬,৩৫৪টি। এরমধ্যে মেধা ও প্রার্থীর পছন্দ অনুযায়ী ৩,৩৩২ জনকে আসন বরাদ্দ করে এসএমএস দিয়েছে ডিজিএমই।
এরইমধ্যে ডিজিএমইর ওয়েবসাইটে শিক্ষার্থীদের মেডিকেল কলেজের নাম, রোল নম্বর প্রকাশ করা হয়েছে।
সেখানে দেখা গেছে, হোলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ, ইব্রাহীম মেডিকেল কলেজ, বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজসহ বেশ কয়েকটি মেডিকেল কলেজে ৬২-৭১ নম্বর পেয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে শিক্ষার্থীরা।
এবার ৪০-৪৫ নম্বর পেয়ে বেসরকারি মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুবই কম।
নতুন নীতির প্রশংসা করছেন বিশেষজ্ঞরা
শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডাঃ কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "অটোমেশন ভর্তি প্রক্রিয়া শতভাগ বাস্তবায়ন করা গেলে এটি শিক্ষার্থীদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ হবে। মেডিকেল সায়েন্স পড়ার জন্য দুটি জিনিস দরকার- এক, মেধা এবং দুই, অর্থ। সরকারি মেডিকেলে মেধা থাকলেই পড়া যায়। আর এতোদিন পর্যন্ত প্রাইভেট মেডিকেলে শুধু অর্থ থাকলেই পড়া যেতো। কিন্তু এখন এটি পরিবর্তন হতে যাচ্ছে।"
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস এর সাবেক উপাচার্য ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক লিয়াকত আলী টিবিএসকে বলেন, "প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে অটোমেশন প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থী ভর্তি একটি ভালো উদ্যোগ। কারণ নূন্যতম মান না থাকলে যে ডাক্তার তৈরি হবে, সে মানুষকে ভালোভাবে চিকিৎসা দিতে পারবেনা। প্রাইভেট মেডিকেল কলেজগুলোকে ঢালাওভাবে ছাত্র ভর্তির অনুমতি দিয়ে মেডিকেল শিক্ষার মান নিচে নামিয়ে ফেলা হয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "এখন আমাদের যে হারে ডাক্তার বের হচ্ছে, তাদের বাইরে এক্সপোর্ট করার মত মানসম্মত হতে হবে। আমাদের দেশে মার্কেট সার্ভে নেই; এখন যত ডাক্তার তৈরি হচ্ছে তাদের পাবলিক সেক্টরে জায়গা দেওয়ার সুযোগ কম। প্রাইভেট সেক্টরেও সুযোগ কম। তাই তাদের বাইরে এক্সপোর্ট করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য ডাক্তার তৈরি করতে হলে মেডিকেল ভর্তিতে এবং শিক্ষায় যে মান লাগবে, তা অর্জন করতে হবে।"
"ভর্তিতে ডিজিলাইজেশনের কারণে যদি মানহীন মেডিকেল কলেজে সিট খালি থাকে, তাও এটি বাস্তবায়ন করতে হবে। ভালো মেডিকেল কলেজে ছাত্রের ঘাটতি হবেনা। চাইনিজ রেস্টুরেন্টের মত মেডিকেল শিক্ষাকেও ব্যবসা মনে করে যারা মেডিকেল কলেজ খুলেছে, তাদের এখন মান উন্নয়ন করতে হবে; নয়তো ছিটকে পড়তে হবে," যোগ করেন তিনি।
অধ্যাপক লিয়াকত আলী বলেন, "বেশিরভাগ প্রাইভেট হাসপাতালের মালিক ক্ষমতাধর। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যেন তাদের সাথে কোনো কম্প্রোমাইজ না করে, কারণ এটি মানুষের জীবন-মরণের সঙ্গে জড়িত।"
বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে এবার ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার।
এটিকেও ভালো উদ্যোগ বলছেন বিশেষজ্ঞরা। আগে ফি নির্ধারিত না থাকায় একেক কলেজ একেক রকম ফি নিতো। কোনো মেডিকেল কলেজ ১৬ লাখ, আবার কোনো মেডিকেল কলেজ নিতো ২০ লাখ। এছাড়া, অনেক অদৃশ্য লেনদেনও ছিল এখানে। কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ৪০-৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ভর্তি ফি রাখতো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শেষবর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, "আগে স্কোরের পাশাপাশি প্রাইভেট মেডিকেলে ভর্তি হতে ডোনেশন দিতে হতো। ভর্তির সময় সিট খালি থাকলেও মেডিকেল কলেজগুলো বলতো সিট খালি নাই। তখন যাদের সিরিয়াল একটু দূরে তাদের ডোনেশন দিয়ে ভর্তি হতে হতো।"
প্রাইভেট মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের বিরোধীতাকে নাকচ করেছে ডিজিএমই
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তিতে অটোমেশন বাতিলের দাবিতে গত ১৫ জুন হাইকোর্টে রিট করেছিল ১২ শিক্ষার্থী। হাইকোর্ট স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরকে সেই রিট ৭ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেয়।
গত ২৫ জুন স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর সেই রিট খারিজ করে দিয়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী মেধার ভিত্তিতে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি করার কথা থাকলেও সরকার নির্ধারিত ভর্তি ফির চেয়ে দেড় থেকে দুইগুণ টাকা বেশি নেওয়া হতো।
অনিয়ম রোধ ও অতিরিক্ত অর্থ আদায় বন্ধের লক্ষ্যে গত বছর ২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষে মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস ভর্তি মেধা ও পছন্দের ভিত্তিতে ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বেসরকারি মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুরোধে তা স্থগিত করা হয়।
বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরেই এই অটোমেশন প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করে আসছেন।
এখন তারা বিষয়টি মেনে নিয়েছেন কি না জানতে চাইলে ডাঃ টিটু মিয়া বলেন, "যখন অটোমেশনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তখন সেই কমিটিতে প্রাইভেট মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মালিকরাও ছিলেন। এই প্রক্রিয়া গত বছর চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তারা এক বছর সময় নিয়েছিলেন। এখন আমরা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নির্দেশে এটি বাস্তবায়ন করছি। মেধা ও পছন্দের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পাবে।"