ভারতে মরিয়া কিডনি বিক্রেতারা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন ফেসবুকে
দুই মেয়ের মা সুরাইয়া কয়েক মাস আগে এক দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন। লাখ পাঁচেক রুপি ঋণও রয়েছে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম এ নারীর। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের এক সকালে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, নিজের একটা কিডনি বিক্রি করে দেবেন।
ভারতে কিডনি বিক্রি অবৈধ — এ কথা সুরাইয়ার জানা ছিল। মোবাইলটা নিয়ে ফেসবুকে ঢুকে তিনি 'কিডনি' আর 'সেল' (বিক্রি) শব্দদুটো লিখে অনুসন্ধান করলেন। কয়েক ডজন পেজ খুঁজে পেলেন — তার মধ্যে একটাতে সুরাইয়া নিজের ফোন নাম্বার দিয়ে জানিয়ে রাখলেন তিনি একটি কিডনি বিক্রি করতে চান।
দিনকয়েক বাদে ডা. স্যান্ডি পরিচয় দিয়ে জনৈক ব্যক্তি ফোন করে সুরাইয়াকে জানালেন, দিল্লির কাছে গাজিয়াবাদের গিত্র মেডিকেল সেন্টার তার একটি কিডনি দশ লাখ রুপি দিয়ে কিনতে ইচ্ছুক। তাকে স্রেফ একটা ফর্ম পূরণ করতে হবে আর ডোনার কার্ডের জন্য আট হাজার রুপি দিতে হবে।
ডোনার কার্ড পেলেই কেবল সুরাইয়া কিডনি বিক্রি করতে পারবেন। ওই আট হাজার রুপি দেওয়ার কিছুদিন আগেই সুরাইয়া মোহন ফাউন্ডেশন নামক আরেকটি প্রতিষ্ঠানের খোঁজ পান। অলাভজনক এ প্রতিষ্ঠানটি অঙ্গদানে মানুষকে উৎসাহ দেয় এবং যারা মৃত্যুর পরে অঙ্গদান করতে চান, তাদেরকে ডোনার কার্ড সরবরাহ করে।
সেখানে যোগাযোগ করার পর সুরাইয়াকে জানানো হলো, 'ডোনার কার্ডের জন্য কোনো অর্থ দিতে হয় না। আপনি অল্পের জন্য প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন।'
ব্রিটেনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডা. সুনিল শ্রফ ১৯৯৭ সালে মোহন ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। এটি যখন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, তখন তামিলনাড়ুতে বছরে ২০টির মতো অঙ্গদানের ঘটনা ঘটতো। এখন কেরালা, অন্ধ্র প্রদেশ, কর্ণাটক, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র ও গুজরাটে বছরে ১৪০ থেকে ১৮০টি অঙ্গদান করা হয়।
কিন্তু সেই সঙ্গে বেড়েছে স্ক্যাম তথা প্রতারণাও। এমনকি অনেকে এ ফাউন্ডেশনের নাম ব্যবহার করেও প্রতারণা শুরু করেছে। মোহন ফাউন্ডেশন সুরাইয়াকে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে পরামর্শ দিয়েছিল। প্রথমে ইতস্তত করলেও পরে ফাউন্ডেশনের সহায়তায় চেন্নাই পুলিশের কাছে যান এ মা।
'আমি পুলিশের কাছে এ ঘটনা জানিয়েছি কারণ আমি চাই আর যারা এ ধরনের ভুল করতে যাচ্ছেন, তারা যেন সেটা থেকে বেঁচে যান,' বলেন সুরাইয়া।
ভারতে ফেসবুক অনেক জনপ্রিয়। গত দশকে এটি দেশটিতে জিনিসপত্র ক্রয়বিক্রয়ের একটি মার্কেটপ্লেসেও পরিণত হয়েছে। আর এখানে আজকাল হরহামেশাই মানব-অঙ্গ ক্রয়-বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখা মেলে।
২০০৪ সালের পর থেকে ভারতে কিডনিবিক্রি হু-হু করে বেড়ে যাওয়ার কথা জানা যায়। ওই সময় কিডনি ক্রয়বিক্রির বাজার এতটাই দ্রুত বেড়েছিল যে, ভিলিভাক্কম নামক একটি জেলার নামই বদলে 'কিডনিভাক্কম' হয়ে যায় লোকমুখে।
২০২০ সালে কোভিডের সময় অনেকের চাকরি চলে যায়। আয়হীন এসব মানুষের অনেকেই কিডনি বিক্রি করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। তখন ভারতের ফেসবুকে কিডনি বেচাকেনার অনেকগুলো পেজ আর গ্রুপের জন্ম হয়। বিভিন্ন চিকিৎসক ও হাসপাতালের নাম ব্যবহার করে জালিয়াতেরা মানুষের কাছ থেকে কিডনি কেনার কথা বলে প্রতারণা শুরু করে।
কিডনি কি আদতেই কেনা-বেচা হয় তা অস্পষ্ট। কারণ এ প্রতারকেরা অনেক সময় কেবল ভুয়া ডোনার কার্ড আর রেজিস্ট্রেশন ফি-এর কথা বলে পয়সা হাতিয়ে নেয়।
ফেসবুকের পেজগুলোতে 'অর্থের বিনিময়ে কিডনি' চেয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। লাখ থেকে কয়েক কোটি রুপি অফার করা হয় কিডনির জন্য। বিভিন্ন হাসপাতালের নামের সঙ্গে অনেক চিকিৎসকের ছবি দেওয়া হয় বিজ্ঞাপনগুলোতে। বলা বাহুল্য, হাসপাতাল বা চিকিৎসক — কেউই এসব বিজ্ঞাপনের অস্তিত্ব সম্পর্কে সাধারণত কিছু জানেন না।
আর এসব বিজ্ঞাপনের মন্তব্যের ঘরে অসংখ্য মানুষ নিজেদের কিডনি বিক্রির আগ্রহ দেখান। গ্লোবাল কিডনি কোম্পানি নামক একটি কিডনি ক্রয়ের পেজের বিজ্ঞাপনে একজন আগ্রহী বিক্রেতা কিডনির দাম সম্পর্কে জানতে চাইলে, তাকে বলা হয়, 'দয়া করে একটি দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আমাদেরকে ইনবক্সে মেসেজ করুন।'
এসব পেজের পাশপাশি ফেসবুকে অনেকগুলো উন্মুক্ত গ্রুপও তৈরি হয়েছে কিডনি বেচাকেনাকে কেন্দ্র করে। এসব গ্রুপে ভারতীয়দের পাশাপাশি আফ্রিকা, এশিয়া, মধ্য প্রাচ্যের অন্যান্য দেশের মানুষজনও কিডনি ক্রয়-বিক্রয় নিয়ে পোস্ট করেন।
কিডনি প্রতারকদের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হাসপাতালের নামের মধ্যে রয়েছে চেন্নাইয়ের অ্যাপোলো হসপিটালস। এটির অপারেশনস বিভাগের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আল জাজিরাকে জানান, তাদের হাসপাতালের নাম ব্যবহার করে প্রতারণার বিষয়ে তারা অবগত নন।
একই তথ্য জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী স্বাস্থ্য সংগঠন ন্যাশনাল কিডনি ফাউন্ডেশন (এনকেএফ)। এটির যোগাযোগ বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট পল ম্যকগি জানিয়েছেন, তারা এনকেএফ-এর ওয়েবসাইটে বিভিন্ন ভাষায় লিখে দেবেন যে তারা কোনো প্রকার ডোনার কার্ড বিক্রি করেন না।
তামিলনাড়ুর ৩৫ বছরের কার্তিক ফেসবুকে একটি কিডনিদাতা পেজের পরিচালক। তার সঙ্গে কথা হয় আল জাজিরার। তিনি জানান, ২০১৭ সালে তিনি আর্থিক সমস্যায় পড়ার পর কিডনি বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষে প্রতারকের পাল্লায় পড়ে তাকে অর্থ গচ্চা দিতে হয়।
ওই অভিজ্ঞতার পর নিজেই ফেসবুকে পাবলিক গ্রুপ খুলে কিডনির দুনিয়ায় যুক্ত হন তিনি। তার গ্রুপের পোস্টে তিনি দাবি করেন, তার সঙ্গে বিভিন্ন হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের যোগাযোগ রয়েছে।
কার্তিক দাবি করেছেন, কমিশনের বদলে তিনি কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য একাধিক পক্ষের মধ্যে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, কিডনি বিক্রি যে অবৈধ এবং কিডনি কেবল দান করা যায় — এসব বিষয়ে তিনি অবগত।
তবে নিজের দাবির পক্ষে তিনি আল জাজিরাকে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি।
ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা প্ল্যাটফর্মস জানিয়েছে, মানব অঙ্গ চোরাচালান ও প্রতারণার বিরুদ্ধে এটির স্পষ্ট নিয়মকানুন আছে এবং এ ধরনের জালিয়াতি রোধ করতে এটি সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। আল জাজিরার চিহ্নিত করা কিডনি বিক্রির কিছু পেজ বন্ধ করার ব্যবস্থা করেছে মেটা।