থ্রেডস কি ইলন মাস্কের টুইটার থেকে বেশি অর্থ আয় করতে পারবে?
টেসলা প্রতিষ্ঠাতা ধনকুবের ইলন মাস্ক ও মেটা সিইও মার্ক জুকারবার্গ বেশ কয়েকদিন ধরে বদ্ধ খাঁচায় একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ইচ্ছা প্রকাশ করে হাসি-ঠাট্টা করছেন। শেষমেশ এ লড়াই হবে কি-না, তা সম্পর্কে এখনো নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি। কিন্তু ব্যবসার ক্ষেত্রে ইতোমধ্যেই এ দুই ধনকুবের লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছেন। খবর বিবিসির।
টুইটারের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ইতোমধ্যেই জাকারবার্গ উন্মুক্ত করেছে টেক্সটভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম 'থ্রেডস'। নতুন এ প্ল্যাটফর্মটিতে ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে ৩০ মিলিয়ন ব্যবহারকারী যুক্ত হয়েছে। এতে করে টুইটারের জন্য মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে নতুন এ অ্যাপটি।
যদিও বর্তমানে টুইটারের ব্যবহারকারীর সংখ্যা 'থ্রেডস' এর চেয়ে বহুগুণে বেশি। তবে বিশ্লেষকদের ধারণা, নতুন এ প্ল্যাটফর্মটি মেটার অন্তর্ভুক্ত ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও ওয়াটসঅ্যাপের মতো জায়ান্ট প্ল্যাটফর্মগুলো থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা পাবে।
আর মেটার এই প্ল্যাটফর্মগুলোতে রয়েছে প্রায় ৩ বিলিয়নের মতো ব্যবহারকারী। ফলে 'থ্রেডস' এর ক্ষেত্রে নতুন ব্যবহারকারী ও বিজ্ঞাপন পেতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না বলে ধারণা বহু বিশ্লেষকের।
জাকারবার্গের প্রতিষ্ঠান মেটা গত বছরেও প্রায় ১১৭ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করেছে। বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে বেশ সফল ইতিহাস। কিন্তু মাস্ক আবার এক্ষেত্রে একটু ভিন্ন। তিনি তার প্রতিষ্ঠিত বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলার ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনকে ততটা গুরুত্ব দেয়নি। একইভাবে টুইটারের অর্থায়নের ক্ষেত্রেও মাস্ক বিজ্ঞাপনের দিকে না ঝুঁকে বরং বিকল্প উপায়ে অর্থ যোগাড়ের চেষ্টা করছেন।
জাকারবার্গ জানান, প্রাথমিকভাবে 'থ্রেডস' এ কোনো বিজ্ঞাপন থাকবে না। একইসাথে বিধি-নিষেধ না রেখে ব্যবহারকারীদের যত ইচ্ছা ততো টেক্সট-ভিত্তিক পোস্ট দেখার সুযোগ দেওয়া হবে।
জাকারবার্গ বলেন, "থ্রেডস এর ক্ষেত্রে আমাদের কৌশল অন্য ব্যবসায়িক পণ্যগুলোর মতোই হবে। প্রথমে পণ্যটিকে ভালোভাবে ব্যবহারকারীদের নিকট তুলে ধরতে হবে। এরপর দেখতে হবে আমরা এক বিলিয়ন ব্যবহারকারী যুক্ত করতে পারি কি-না। এটা করতে সমর্থ হলেই আমরা মনিটাইজেশন করার কথা চিন্তা করব।"
তবে কিব্যানস ক্যাপিটাল মার্কেটস এর ইকুইটি রিসার্চ অ্যানালিস্ট জাস্টিন প্যাটারসন মনে করেন, বর্তমানে আয়ের প্রবণতা ততটা না থাকলেও শেষ পর্যন্ত মেটার সার্বিক আয়ে 'থ্রেডস' এক থেকে পাঁচ শতাংশ যুক্ত করতে পারে। সবচেয়ে ইতিবাচকভাবে চিন্তা করলে সেটি ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি হতে পারে।
মেটার মতো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে অর্থের হিসেবে ৬ বিলিয়ন ডলার খুব বেশি নয়। কেননা প্রতিনিয়তই পরিবর্তনশীল প্রযুক্তিগত পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানটির একের পর এক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছে। একইসাথে প্রাইভেসিকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে মেটার বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও নানা শর্ত আরোপ করছে অ্যাপল।
তবে 'থ্রেডস' এর এ সম্ভাব্য আয় প্রতিদ্বন্দ্বী টুইটারের আয়ের কাছাকাছিই রয়েছে। মাস্ক টুইটারের মালিক হওয়ার আগে ২০২১ সালে প্ল্যাটফর্মটি বিজ্ঞাপন বাবদ ৪.৫ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে।
প্রথমদিকে মিলিয়ন মিলিয়ন ব্যবহারকারী যুক্ত করতে পারলেও স্থায়ীভাবে ঠিক কত সংখ্যক ব্যবহাকারী ধরে রাখতে পারবে সেটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আর এর ওপরই নির্ভর করছে প্ল্যাটফর্মটি আয় ও সর্বোপরি ভবিষ্যৎ।
অন্যদিকে গত বৃহস্পতিবার মাস্কের টুইটারের পক্ষ থেকে 'থ্রেডস' এর বিরুদ্ধে নকলের অভিযোগ এনে মামালার হুমকি দেওয়া হয়েছে। প্ল্যাটফর্মটির অভিযোগ, থ্রেডস তৈরি করতে 'পরিকল্পিত, ইচ্ছাকৃত এবং বেআইনিভাবে টুইটারের গোপনীয় ব্যবসায়িক কৌশল এবং অন্যান্য মেধাস্বত্ব' ব্যবহার করা হয়েছে।
তবে ইসাইডার ইনটিলিজেন্স অ্যানালিস্ট জ্যাসমিন এনবার্গ মনে করেন, টুইটারের সবচেয়ে বড় মাথাব্যাথার কারণ হচ্ছে এর বহু ব্যবহারকারী বিকল্প একটি প্ল্যাটফর্ম খুঁজছিল। এরই সুযোগ নিয়ে মেটা থ্রেডসকে টুইটারের তুলনায় আরও ইতিবাচক জায়গা বলে সকলের কাছে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। একইসাথে প্ল্যাটফর্মটিতে টুইটারের তুলনায় আরও সহজে সাইন-আপ করা যাচ্ছে।
শাকিরা, অপরাহ কিংবা খোলো কার্দাশিয়ানের মতো তারকারা ইতোমধ্যেই থ্রেডস এ যুক্ত হয়ে প্ল্যাটফর্মটি সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে আরেক তারকা সারাহ জেসিকা পার্কার প্ল্যাটফর্মটি সম্পর্কে বলেন, "পোস্ট করছি। আশাবাদী হয়েই।"
অ্যানালিস্ট জ্যাসমিন এনবার্গ মনে করেন, প্রথমদিকে অনেক ব্যবহারকারী যুক্ত করতে পারলেও থ্রেডস এর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে ভবিষ্যতে। নিয়মিত টুইটার ব্যবহার করা ব্যক্তি, যারা প্রথমেই থ্রেডস ব্যবহার করেনি, তাদের প্লাটফর্মটিতে যুক্ত করতে পারার সক্ষমতার ওপর অ্যাপটির সফলতা নির্ভর করছে।
ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল সম্পর্কিত কন্টেন্ট ইনস্টাগ্রামকে অনেকটা প্রাণবন্ত করে রাখে। এতে করে পণ্য বিপণনের বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোও প্লাটফর্মটিতে বিজ্ঞাপন দিতে আগ্রহী হয়। এমতবস্থায় ইনস্টাগ্রাম সংশ্লিষ্ট আরও একটি প্ল্যাটফর্ম ঠিক কতটা গ্রহণযোগ্য হবে সেটা স্পষ্ট নয়।
টুইটারের জনপ্রিয়তার অন্যতম প্রধান কারণ নিত্য নতুন সংবাদের খোরাক হিসেবে কাজ করা। কিন্তু থ্রেডস নিয়ে জাকারবার্গ যেন একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করছেন।
জাকারবার্গ জানান, জরিপে ব্যবহারকারীরা 'থ্রেডস' এ সংবাদের সংখ্যা কম পরিমাণে চেয়েছেন। একইসাথে প্ল্যাটফর্মটিতে থাকা কানাডার ব্যবহারকারীদের জন্য স্থানীয় সংবাদ ব্লক করে দেওয়ার কথা ভাবছে।
এ সম্পর্কে জ্যাসমিন এনবার্গ বলেন, "সংবাদ পছন্দ করা এবং অনুগত টুইটার ব্যবহারকারীদের প্ল্যাটফর্মটি ছেড়ে দেওয়ার কারণ নেই। তাই সুদূর ভবিষ্যতে গতি বজায় রাখাতে হলে মেটার পক্ষ থেকে থ্রেডসকে আকর্ষণীয় রাখতে হবে।"
অন্যদিকে থ্রেডস এ বিজ্ঞাপনদাতাদের আকৃষ্ট করতেও মেটার পক্ষ থেকে নানা চাহিদা পূরণ করতে হবে। এক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনদাতাদের বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। একইসাথে তাদের কাছে নিশ্চিত করতে হব যে, প্ল্যাটফর্মটিতে ভুল তথ্য ও গোপনীয়তার মতো সমস্যাগুলোর ঝুঁকিতে নেই।
মাস্কের অধীনে অর্থ আয় করতে সাম্প্রতিক সময়ে টুইটারকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। হুটহাট সব পরিবর্তনের কারণে বহু বিজ্ঞাপনদাতাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। যেমন, সম্প্রতি টুইটার ব্যবহারকারীদের পোস্ট দেখার সংখ্যা সীমিত করে দেওয়া বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বিশেষজ্ঞদের মতে, টুইটারের ব্যবসা কমে যাওয়ার ইতোমধ্যেই লাভবান হয়েছে জাকারবার্গের মেটা। কিন্তু বিজ্ঞাপনদাতাদের সাথে মেটার সম্পর্ক যে বিতর্কের বাইরে, এমনটা নয়।
বহু বছর ধরে মার্কেটারদের সাথে মেটা প্ল্যাটফর্মগুলোর ডেটার যথার্থতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। এমনকি ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা ভঙ্গ করা কিংবা ভুল তথ্যের পরিবেশনের কারণেও বহুবার সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন।
থ্রেডস উন্মুক্তের ফলে গত বুধবার মেটার শেয়ারমূল্য ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে করে অনেকটা আঁচ করা যাচ্ছে যে, 'থ্রেডস' এর মাধ্যমে জাকাবার্গের টুইটারকে টেক্কা দেওয়ার এ উদ্যোগে অনেকেই ভরসা করছেন। যদিও জাকারবার্গ এমন উদ্যোগ গ্রহণ করে বেশ কয়েকবার ব্যর্থও হয়েছেন; 'ফেসবুক ডেটিং' তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
এ সম্পর্কে এজিএল এডভাইজরির সিইও লু পাসকালিস বলেন, "টুইটারে যেভাবে একটি সংবাদ ছড়িয়ে পরে, 'থ্রেডস' এর জন্য অনুরূপ অবস্থার সৃষ্টি বেশ কঠিন হবে। তবে মাস্কের জন্য জাকারবার্গের প্ল্যাটফর্মটি একটি আগাম সতর্কতাবার্তা হতে পারে। এখন দেখার বিষয়, বিজ্ঞাপনে যেতে থ্রেডস এর ঠিক কত সময় লাগবে। নিজেদের সমস্যাগুলোর সমাধান করে টিকে থাকার জন্য টুইটারের কাছে ঠিক ততোটুকই সময় রয়েছে।"