‘লেখক হওয়া মানে একটি সত্যকে জানা’: মিলান কুন্ডেরা — উদ্ধৃতিতে লেখকের জীবন
৯৪ বছর বয়সে মারা গেছেন চেক সাহিত্যিক মিলান কুন্ডেরা। তার সাহিত্যিকজীবনে বিভিন্ন সাক্ষাৎকার আর লেখা থেকে নেওয়া কিছু স্মরণীয় উদ্ধৃতি উল্লেখ করা হলো এখানে।
লেখক হওয়া প্রসঙ্গে
ছোটবেলায় হাফপ্যান্ট পরার বয়সে আমি অলৌকিক এক মলমের স্বপ্ন দেখতাম — যে মলম শরীরে মাখলে অদৃশ্য হতে পারব। তারপর বয়স বাড়ল, লেখালেখি শুরু করলাম, সফল হওয়ার আকাঙ্ক্ষা জাগল। এখন আমি সফল হয়েছি, আর এখনো আমি সেই মলমটা চাই, অদৃশ্য হওয়ার মলম।
একজনের লেখকের জন্য একাধিক দেশে বাস করার অভিজ্ঞতাটক একটা বড় আশীর্বাদ। দুনিয়াটাকে কেবল তখনই বুঝতে পারবেন, যদি এটাকে বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে দেখেন।
লাফেবল লাভস-এর (১৯৫৯-এ লিখেছিলাম) প্রথম গল্পের পর মনে বিশ্বাস গেঁথে গিয়েছিল — এবার 'নিজেকে খুঁজে পেয়েছি'। গদ্য লেখা শুরু করলাম, হয়ে উঠলাম একজন ঔপন্যাসিক — এর বাইরে আমি আর কিছু নইও। তারপর থেকে আমার নান্দনিকবোধ কোনো রূপান্তর দেখেনি; এটার বিবর্তন ঘটে, আপনার ভাষায় বলতে গেলে, সমান্তরালভাবে।
৪৫ বছর অব্দি চেকোস্লোভাকিয়ায় বাস করেছি। বয়স যখন ৩০ ছিল, তখন থেকেই আমার লেখকজীবনের প্রকৃত ক্যারিয়ারের শুরু। সেদিক থেকে দেখলে, আমি দিব্যি বলতে পারি যে আমার সৃষ্টিশীল জীবনেে বড় অংশের উন্মোচন হবে ফ্রান্সে। যতটুকু মনে করা হয়, তার চেয়ে বেশি পরিমাণে আমি ফ্রান্সের সঙ্গে জড়িয়ে গেছি।
লেখক হওয়া মানে সত্যের বয়ান দেওয়া নয়, এর অর্থ হলো সত্যকে আবিষ্কার করা।
উপন্যাস প্রসঙ্গে
সবকিছুর উত্তর যখন হাতের নাগালে তৈরি করা থাকে, তখন তা মানুষের মধ্যে নির্বুদ্ধিতার জন্ম দেওয়ার কারণ হয়। আর সবকিছুকে প্রশ্ন করার মাধ্যমে উপন্যাসের প্রজ্ঞালাভ ঘটে।
একটা উপন্যাস কোনো কিছুকে প্রমাণ করে না; উপন্যাস অনুসন্ধান করে আর প্রশ্ন উত্থাপন করে। আমি জানি না আমার জাতি বিলীন হয়ে যাবে কি না, আমি এও জানি না আমার চরিত্রগুলোর মধ্যে কোনটি সঠিক। আমি গল্প তৈরি করি, একটাকে আরেকটার সামনে দাঁড় করাই, আর এসব উপায়ে আমি প্রশ্ন করি।
আমার কাছে মনে হয় ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে উপন্যাসের গুরুত্ব অনেক বেশি; উপন্যাস ছাড়া একটা ইউরোপীয় মানুষকে ভাবাই যায় না, তাকে তৈরি করেছে এ উপন্যাসই। শতশত বছর ধরে এ মানুষেরা সবার আগে উপন্যাসটাই পড়েছে। অ্যাডভেঞ্চারের প্রতি ভালোবাসার ব্যাপারটা ইউরোপীয়দের একান্ত কাছের, অ্যাডভেঞ্চারকে গুণ হিসেবে দেখা হয়। আপনি যদি বলেন, 'আমার সারাটা জীবন কাটল অ্যাডভেঞ্চার ছাড়া,' তাহলে সেটাকে ব্যর্থ বই আর কি বলা যাবে, তা-ই না? এই উপন্যাসই আমাদেরকে অ্যাডভেঞ্চারের এমন কদর করতে গড়ে দিয়েছে মানসিকভাবে।
মহান ঔপন্যাসিক চারজন: কাফকা, ব্রক, মুসিল, গমব্রোভিচ। আমি তাদেরকে ডাকি মধ্য ইউরোপের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিকদের 'চার মহারথী' হিসেবে।
যৌনতা প্রসঙ্গে
আজকাল যখন যৌনতা আর ট্যাবু নয়, তখন নিছক বর্ণনা, নিছক যৌন স্বীকারোক্তি একদম একঘেয়ে হয়ে উঠেছে। লরেন্স, এমনকি হেনরি মিলারের অশ্লীলতার ভাবমূর্ছনাও কেমন সেকেলে ঠেকায়!
উপন্যাসের লেখকদের নয়, বরং উপন্যাসের ভেতরে থাকা যৌনতা নিয়ে আমাদের আগ্রহ হওয়া উচিত। সব বিখ্যাত উপন্যাস, সব নিখাদ উপন্যাসই উভকামী। এ কথার অর্থ হচ্ছে এগুলো দুনিয়ার নারী ও পুরুষ উভয় দর্শনকে প্রকাশ করে। আর লেখকেরা, যারা বাস্তবে অবস্থান করেন, তাদের যৌনতা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়।
মধ্য ইউরোপ প্রসঙ্গে
এর সীমান্ত আঁকতে যাওয়াটা অনর্থক হবে। মধ্য ইউরোপ কোনো রাষ্ট্র নয়; এটা একটা সংস্কৃতি বা একখানা নিয়তি।
সত্যি কথা বলতে কী, একজন হাঙ্গেরিয়ান, একজন চেক বা পোলের কাছে ইউরোপের অর্থ কী? কয়েক হাজার বছর ধরে তাদের জাতিরা ইউরোপের রোমান ক্রিস্টিয়ানিটিসমৃদ্ধ অংশে বাস করে এসেছে। তারা ইতিহাসের প্রতিটি পরতে অংশ নিয়েছে। তাদের কাছে ইউরোপের কোনো ভৌগোলিক অর্থ নেই, বরং ইউরোপ তাদের জন্য একটি আধ্যাত্মিক ধারণা।
রাশিয়া নয়, কমিউনিজম হচ্ছে কোনো জাতিকে তাদের সত্তা থেকে বঞ্চিত করার কুশীলব।
স্টালিনিস্ট সন্ত্রাসের সময় আমি রসবোধের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলাম … তখন স্বীকৃতির বিশ্বাসযোগ্য লক্ষণ ছিল এই রসবোধটুকু। তারপর থেকে ক্ষয়িঞ্চু রসবোধের কোনো দুনিয়ার কথা ভাবতে গেলেই ভয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।