শস্যচুক্তি স্থগিত করেছে মস্কো, এটি ভাল খবর নয়
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গমের দাম বেড়ে টনপ্রতি ৩৮০ ডলারে পৌঁছেছে; ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার উত্তাপ শুধু রাজনৈতিক অঙ্গনেই নয়, ছড়িয়েছে বিশ্বব্যাপী গমের বাজারেও।
বিশ্বের মোট গম উৎপাদনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই হয় এই দুই দেশে। তাই গমের বাজারে অস্থিরতা তৈরির পর জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় কৃষ্ণসাগর শস্য চুক্তি সইয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয় রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে; চুক্তিতে সম্মতও হয় দুই দেশ। ফলস্বরূপ, টনপ্রতি গমের দাম ১০০ ডলারের চেয়েও বেশি কমে ২৬০ ডলারে এসে ঠেকে।
কিন্তু সম্প্রতি রাশিয়ার শস্যচুক্তি স্থগিত করার খবরে আবারও নতুন করে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে গমের বাজারে। শিকাগো বোর্ড অব ট্রেড অনুযায়ী, স্থগিতের ঘোষণার পর সোমবারেই (১৭ জুলাই) প্রতি বুশেল (২৭ কেজি সমতুল্য) গমের দাম ৩ শতাংশ বেড়ে ৬.৮১ মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে।
বিশ্ববাজারে এই মূল্যবৃদ্ধি বাংলাদেশি ভোক্তাদেরও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে; কারণ এর ফলে দেশের বাজারেও গমের দাম বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশে মোট বার্ষিক গমের চাহিদার ৬৫ শতাংশই পূরণ হয় রাশিয়া, ইউক্রেন এবং ভারত থেকে আমদানি করা গমের মাধ্যমে।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে বাংলাদেশে গমের চাহিদাও দিন দিন বাড়ছে। শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৯৯০ সালে দেশে গমের চাহিদা ছিল মাত্র ৩ লাখ টন।
বর্তমানে দেশে ২ কেজির একটি আটার প্যাকেটের দাম ব্র্যান্ডভেদে ১২০-১৪০ টাকা; যা যুদ্ধ শুরুর আগে ৮০-১০০ টাকার মধ্যে ছিল।
রাশিয়ার শস্যচুক্তি প্রত্যাহাররের নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের ওপর পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও অন্যতম বৃহত্তম গম আমদানিকারক আবুল বাশার চৌধুরী সোমবার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, গম সংগ্রহের প্রধান উৎস (রাশিয়া, ইউক্রেন) ব্যাহত হলে সরবরাহ ঘাটতি তৈরি হবে, এতে দাম বৃদ্ধি পাবে।
তিনি জানান, সম্প্রতি ইউক্রেন থেকে গমের একটি চালান চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছেছে। তবে দেশে উৎপাদন ভালো হওয়ায় গমের দাম কিছুটা কমেছে, ফলে তিনি আমদানি আদেশ দেননি।
কিন্তু এখন নতুন পরিস্থিতি বিবেচনায় দাম বাড়তে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।
রাশিয়া থেকে গম আমদানি করতে পারলে বাংলাদেশ বড় কোনো সমস্যায় পড়বে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমানে এক ডজনের কম ব্যাংক রাশিয়া থেকে আমদানির জন্য এলসি খুলছে।
রাশিয়ার ওপর চলমান নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও অনেক দেশ সেখান থেকে আমদানি চালিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে আবুল বাশার চৌধুরী আরও বলেন, "যদি আরও ব্যাংক রাশিয়া থেকে আমদানির জন্য এলসি খোলে, তাহলে কোনো ঘাটতিই হবে না।"
ইস্তাম্বুলের জয়েন্ট কো-অর্ডিনেশন সেন্টারের মতে, গত বছরের জুলাইয়ে চালু হওয়া 'ব্ল্যাক সি গ্রেইন ইনিশিয়েটিভ'-এর মাধ্যমে ইউক্রেনের তিন বন্দর ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী ৩২.৯ মিলিয়ন টন শস্য এবং অন্যান্য খাদ্য পণ্য রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হয়। এই রপ্তানি পণ্যের অর্ধেকেরও বেশি যায় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে।
যদিও সর্বশেষ মে মাসে ৬০ দিনের জন্য নবায়ন করা হয়েছিল চুক্তিটি; তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইউক্রেন থেকে আসা খাদ্যপণ্যের পরিমাণ এবং জাহাজের সংখ্যা, উভয়ই হ্রাস পেয়েছে। অভিযোগ তোলা হয়েছে, রাশিয়ার বাধার কারণে কমে গেছে জাহাজের সংখ্যা।
সিটি গ্রুপের কর্পোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা জানান, তাদের গম মূলত কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা হয়।
তা সত্ত্বেও, রাশিয়ার শস্যচুক্তি স্থগিতের ঘোষণায় ৩-৪ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। এটি চলমান ডলার সংকট ও সরবরাহ ঘাটতির কারণে বাজারে ইতোমধ্যে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলোকে আরও উস্কে দিয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন খাদ্য পরিকল্পনা ও পর্যবেক্ষণ ইউনিটের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের ২৫ জুন পর্যন্ত সরকার ৬.৮ লাখ টন গম আমদানি করেছে, আর বেসরকারি খাত আমদানি হয়েছে ৩০.৭৩ লাখ টন। এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বছর শেষে দেশে মোট গম আমদানি আনুমানিক ৩৮ লাখ টনে পৌঁছবে; যদিও আগের বছর আমদানি হয়েছিল ৪০ লাখ টনের বেশি।
২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ৫৩ লাখ টনেরও বেশি গম আমদানি হয়েছিল; ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ ছিল আরও বেশি, প্রায় ৬৫ লাখ টন।
দেশে প্রধান গম আমদানিকারকদের মধ্যে রয়েছে- সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রি, বসুন্ধরা গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, বিএসএম গ্রুপ, আবুল খায়ের গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ এবং নাবিল গ্রুপ।
বসুন্ধরা গ্রুপের সাপ্লাই চেইন ডিভিশনের চিফ অপারেটিং অফিসার আবদুস শুকুর কৃষ্ণসাগর শস্য চুক্তি স্থগিতে হতাশা প্রকাশ করেন; কারণ কোম্পানিটি মূলত রাশিয়া এবং ইউক্রেন থেকেই গম আমদানি করে থাকে।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সোমবার শস্যচুক্তি থেকে সরে আসার ঘোষণা দেয় রাশিয়া। একই দিন ভোরে ক্রিমিয়া সেতুতে হামলার পর পরই এই ঘোষণা আসে। যদিও রাশিয়া বলছে, এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে হামলার ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই।
গত সপ্তাহে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন জানান, রাশিয়ার সাথে সম্পর্কিত চুক্তির অংশগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। তাই তিনি এতে রুশ অংশগ্রহণ স্থগিত করার কথা ভাবছেন এবং শর্ত পূরণ হলে রাশিয়া আবারও চুক্তিতে ফিরে আসবে।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বলেন, "কৃষ্ণসাগর চুক্তি আজ স্থগিত করা হয়েছে।"
"দুর্ভাগ্যবশত, এই চুক্তির রাশিয়া সঙ্গে সম্পর্কিত অংশটি এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি, এ কারণেই চুক্তিটি স্থগিত করা হয়েছে," যোগ করেন তিনি।