চট্টগ্রাম ওয়াসা, ফায়ার সার্ভিসের সমন্বয়হীনতায় অব্যবহৃত পড়ে আছে ১৭৪টি ফায়ার হাইড্রেন্ট
দুই কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ওয়াসা) কর্তৃক চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় স্থাপিত প্রায় ১৭৪টি ফায়ার হাইড্রেন্ট অব্যবহৃত পড়ে আছে। ফায়ার সার্ভিসের অনীহা এবং দুই সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে অব্যবহৃত পড়ে আছে ফায়ার হাইড্রেন্টগুলো।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম ওয়াসা ২০২০ সালে ৩০টি ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করে ফায়ার সার্ভিসের কাছে সেগুলো হস্তান্তর করে। দুই বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এগুলোর একটিও এখন পর্যন্ত ব্যবহার করেনি ফায়ার সার্ভিস। অথচ ২০২২ সালেও ছোট-বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পানির জন্য বেগ পেতে হয়েছে চট্টগ্রাম নগরে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্ববধায়ক প্রকৌশলী (প্ল্যানিং এন্ড কনস্ট্রাকশন) মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "হাইড্রেন্ট স্থাপনের সময় আমরা ফায়ার সার্ভিসকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করেছি। ট্রায়াল রানের পর, প্রকল্পের কাজ শেষ করে আমরা হাইড্রেন্টগুলি ফায়ার সার্ভিসের কাছে হস্তান্তর করেছি।"
"কিন্তু তারা ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে না হয়তো। আমি মনে করি, সমন্বয়হীনতা দায়ী," বলেন তিনি।
তবে ৩০টি ফায়ার হাইড্রেন্ট বুঝিয়ে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে পরিষ্কার কিছু বলতে পারেননি ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক মো. আবদুল মালেক। কেন ব্যবহার হয়নি এ বিষয়েও সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি তিনি।
চট্টগ্রাম শহরে গত চার দশকে প্রায় ২৪ হাজার পুকুর, দীঘি, জলাশয় ও জলাধার বিলুপ্তি হয়েছে। এক সময় আগুন নেভাতে পানির উৎস ছিল এসব জলাধার। শহর এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে পানির উৎস নিয়ে বেগ পেতে হয় ফায়ার সার্ভিসকে। এর ফলে আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায়।
চট্টগ্রাম ওয়াসার তথ্যমতে, ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে হাইড্রেন্ট স্থাপনের জন্য শহরের ৮৬টি স্থান নির্ধারণ করে ফায়ার সার্ভিস। বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন ও পয়ঃনিষ্কাশন প্রকল্পের অধীনে ২০২০ সালে শহরে ৩০টি ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন সম্পন্ন হয়।
২০১৯ সালে রাজধানীতে কয়েকটি বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর চট্টগ্রামে ফায়ার হাইড্রেন্টের প্রয়োজনীয়তা আবারও সামনে আসে। পরে কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প-০২ এর অধীনে একটি প্যাকেজে আরও ১৪৪টি ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই প্রকল্পের অধীনে শহরে স্থাপিত ৭০০ কিলোমিটার পাইপলাইন নেটওয়ার্ক ও ৫৯টি ডিএমএ (ডিস্ট্রিক্ট মিটারিং এরিয়া) সিস্টেমের সঙ্গে সংযোগ করে ফায়ার হাইড্রেন্টগুলো বসানো হয়। প্রকল্পটির কাজও গত জুনে শেষ হয়েছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম টিবিএসকে বলেন, "আগের ৩০টি প্রকল্প শেষ হওয়ার পরই বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। নতুন ১৪৪টির কাজও সম্পন্ন। সেগুলোর মধ্যে অনেকগুলো তাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। পানি সরবরাহের জন্য ফায়ার সার্ভিস আমাদের কাছে কিছু কাপলিং (কনভার্টার) চেয়েছে। সেগুলোও তৈরির প্রক্রিয়া চলছে।"
ব্যবহারে অনাগ্রহী ফায়ার সার্ভিস
বাণিজ্য নগরী চট্টগ্রাম হলো বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবেশদ্বার। এই শহরে অনেক ভারী-হালকা, ছোট-বড় শিল্প কারখানা রয়েছে। তাই অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বেশি। এসব বিষয় মাথায় রেখে পানি সরবরাহের সঙ্গে ফায়ার হাইড্রেন্ট সংযোগ স্থাপন করে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ।
ওয়াসা কর্তৃপক্ষ ফায়ার হাইড্রেন্টগুলো কার্যকার ব্যবহারে চাহিদা অনুসারে কাপলিং (কনভার্টার) দিচ্ছে। তবুও ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে হাইড্রেন্ট ব্যবহারে অনাগ্রহের বিষয়টি উঠে আসে।
ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মো. আবদুল মালেক প্রতিবন্ধকতার কথা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, "সংকটের সময় রেশনিং পদ্ধতিতে পানি সরবরাহ করে ওয়াসা। কিন্তু অগ্নিকাণ্ডের সময়-স্থান ঠিক থাকে না। যখন-তখন, যেখানে-সেখানে সংঘটিত হতে পারে। যে এলাকায় অগ্নিকাণ্ড, সেখানে যদি তখন পানি না থাকে? পানির সরবরাহ না থাকলে ওয়াসা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের নম্বর দিয়েছে। কিন্তু অনেক সময় রাত ৩টায় আগুন লাগে। তখন যদি তারা ফোন রিসিভ না করে। এখানে দীর্ঘসূত্রিতার বিষয় রয়েছে।"
ওয়াসার প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বলেন, "উন্নত বিশ্বে এটি প্রচলিত রয়েছে। আমরা সেই আদলে কাজ করেছি। শুরু থেকেই ফায়ার সার্ভিসের মতামত নিয়ে হাইড্রেন্ট বসানো হয়েছে। ডিএমএ সিস্টেম চালুর পর পানি সরবরাহ ও পর্যবেক্ষণসহ সবকিছুই ডিজিটালাইজ করা হয়েছে। অ্যাপের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা হয়। পানি সরবরাহ চালু রাখা মুহূর্তের ব্যাপার।"
পানির খরচ কে বহন করবে- নির্ধারণ হয়নি সেটিও
এদিকে, হাইড্রেন্টে ব্যবহারে পানির বিল কে দেবে তা এখনও নির্ধারণ করা হয়নি। এ নিয়ে দুই সরকারি সংস্থার মধ্যে আলোচনা চলছে। সাধারণত, ফায়ার সার্ভিসের স্টেশনগুলোতে পানি সরবরাহ করে ওয়াসা। সেগুলোর বিল পরে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ পরিশোধ করে।
এ বিষয়ের ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বলেন, "পানির খরচের বিষয়টি বড় ইস্যু নয়। আমাদের কিছু স্ট্রিট হাইড্রেন্ট রয়েছে। এগুলোর জন্য সরকার বছরে একটা হিসাব করে অর্থ দেয়। ফায়ার সার্ভিস আগে ব্যবহার শুরু করুক। এরপর সেটি নিয়ে আলোচনা করা হবে।"
ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মো. আবদুল মালেক বলেন, "অগ্নিনির্বাপণ ও প্রতিরোধ আইন ২০০৩ অনুসারে অগ্নিনির্বাপণের সময় জরুরি মুহূর্তে যেকোনো উৎস থেকে বিনামূল্যে পানি ব্যবহার করবে ফায়ার সার্ভিস। সেক্ষেত্রে ফায়ার হাইড্রেন্টের ব্যয় বহন করতে হবে না।"