প্রচণ্ড খরায় ব্যাহত হচ্ছে আমনের উৎপাদন
প্রচণ্ড খরার কারণে ব্যাহত হচ্ছে দেশের চাল উৎপাদনের দ্বিতীয় বৃহত্তম আমন মৌসুমের চাষাবাদ। বৃষ্টি না থাকায় কৃষকরা ধান রোপণ করতে পারছেন না, নষ্ট হচ্ছে বীজতলা। কোথাও কোথাও কৃষকরা বাড়তি খরচ করে সেচ পাম্পের মাধ্যমেই ধান রোপণ শুরু করেছেন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, এবারের আমন মৌসুমে ৫৯.৩৩৫ লাখ হেক্টর জমিতে ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা থেকে প্রতি বছরই দেশের খাদ্যশস্যের মজুদে দেড় কোটি টনের মত চাল যোগ হয়। অথচ জুলাই মাস শেষ হয়ে এলেও এখন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১২.৮২ শতাংশ জমিতে ধান চাষাবাদ হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই অবস্থা চলতে থাকলে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হতে পারে। গত বছরও একই অবস্থা তৈরি হয়েছিল, যেখানে সারাদেশের বেশিরভাগ কৃষকই সেচ পাম্পের মাধ্যমে ধান রোপণ করে।
জানা যায়, এবারে শুষ্ক মৌসুমের কারণে বীজতলা তৈরির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, তার চেয়ে ৬% শতাংশ কম বীজতলা তৈরি করা হয়েছে। কৃষকরা বলছেন, প্রচণ্ড তাপের কারণে বীজতলাতেই অনেক চারা নষ্ট হতে শুরু করেছে। রোদে পুড়ে ধানের চারা হলুদ হয়ে যাচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুমের প্রতিদিনের প্রতিবেদন থেকে জুলাইয়ের আবহাওয়ার একটা ধারণা পাওয়া যায়। গত কয়েকদিন ধরেই প্রচণ্ড তাপমাত্রা রেকর্ডের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে কোথাও কোথাও তাপমাত্রার রেকর্ড হচ্ছে ৩৭.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারও বেশি। আবার সারাদেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও খুবই সামান্য।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এল নিনো কন্ডিশনের কারণে বৃষ্টিপাত কম হবে বলে প্রক্ষেপণ করা হচ্ছে। যা একদিকে ফসল রোপণ, অন্যদিকে উৎপাদনশীলতার উপরও প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এল নিনোর কারণে ভারতে, চীন সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশেই ফসলের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক পিএইডি গবেষক এবং আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশ টিবিএসের সাথে আলাপকালে জানান, এল নিনো কন্ডিশনের কারণে বাংলাদেশে মে, জুন, জুলাই এই তিন মাসে ২০-৩০ শতাংশ বৃষ্টিপাত কম হতে পারে।
আবহাওয়াবিদদের তথ্য বলছে, ২০২১ সাল পর্যন্ত গত ৩০ বছরে বাংলাদেশে জুলাই মাসের গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৪৯৬ মিলিমিটার। কিন্তু ২০২২ সালের জুলাই মাসে মোট বৃষ্টিপাত হয় মাত্র ২১১ মিলিমিটার (মি.মি.), যা ১৯৮১ সালের পর সর্বনিম্ন। ২০২১ সালের জুলাই মাসে বৃষ্টিপাত হয়েছিল ৪৭১ মিলিমিটার।
কৃষক ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, আমন ধানের চাষাবাদ বৃষ্টিনির্ভর হওয়ায় খরার কারণে নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও কৃষক জমিতে ধান রোপণ করতে পারছেন না। কোথাও কোথাও অবশ্য সেচ পাম্পের মাধ্যমে ধান রোপণের কাজ শুরু হলেও সেটা চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হলে দেশে সাধারণত জুলাই মাসের মধ্যেই আমন রোপণের কাজ শেষ হয়। কিন্তু জুলাই শেষ হতে চললেও এ বছর সারাদেশের কৃষি জমিগুলো এখনো ফাঁকা। এর প্রধান কারণ স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত নেই, যে পরিস্থিতি গত বছরও হয়েছে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে আমনের উৎপাদন কমে যেতে পারে।
কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কৃষকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সেচ পাম্প বসিয়ে আমন ধান রোপণ করতে। অনেক কৃষক সেটা শুরুও করলেও বেশিরভাগ কৃষকই অপেক্ষা করছে বৃষ্টির। ক্ষুদ্র এমন অনেক কৃষক রয়েছে যাদের সামর্থের অভাবেই অনীহা রয়েছে সেচ দিয়ে আমন রোপণে।
বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার দলগাছা গ্রামের কৃষক মনিরুজ্জামান মুনির বলেন, উপজেলার কৃষকেরা আষাঢ়ের ১৫ তারিখের পর ও শ্রাবণের ১৫ তারিখের মধ্যে সাধারণত আমন ধান রোপণ করেন। এবার শ্রাবণ মাসের প্রথম সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও পানির অভাবে জমি লাগাতে পারছেন না।
এই চিত্র বগুড়ার নয়, সারাদেশেরই। টিবিএসের বগুড়া প্রতিনিধি খুরশিদ আলম পুরো উত্তরাঞ্চলের চাষাবাদে এই অবস্থা বিরাজ করছে বলে জানান।
বগুড়ার উপজেলার কালিকাপুর গ্রামের কৃষক রাজু আহম্মেদ বলেন, এবার খরা চলায় বেশিরভাগ কৃষক এখন বাধ্য হয়ে বৈদ্যুতিক পাম্প ও শ্যালো মেশিন দিয়ে সেচের মাধ্যমে ধান রোপণের চেষ্টা করছেন।
তিনি বলেন, 'জমিতে পানি দেওয়ার জন্য বিঘা প্রতি গভীর নলকূপ মালিককে দিতে হবে ১ হাজার টাকা ও শ্যালো মেশিন মালিককে দিতে হবে ১৫০০ টাকা। এটি কৃষকের বাড়তি খরচ।
নন্দীগ্রাম উপজেলা কৃষি অফিসার আদনান বাবু বলেন, চলতি আমন মৌসুমে খরার প্রকোপ চলছে। আমন চাষের এখনও সময় আছে। তবে প্রচণ্ড রোদ অব্যাহত থাকলে কৃষকদের সেচ যন্ত্রের মাধ্যমে জমিতে পানি দিয়ে চাষ করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যেন তারা সেচ পাম্পের লাইনগুলোর সংযোগ চালু অবস্থায় রাখে। একই সঙ্গে কৃষক পর্যায়েও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যাতে তারা দ্রুত সেচ পাম্পের মাধ্যমে জমি তৈরি করে ধান রোপণের কাজ শেষ করে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সম্প্রসারণ উইংয়ের অতিরিক্ত সচিব রবীন্দ্র শ্রী বড়ুয়া বলেন, 'দুই বছর ধরে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা করছি আমনের সময়টাতে। এই অবস্থা আমাদের চাষাবাদের জন্য অবশ্যই উদ্বেগজনক।'
তিনি বলেন, 'আমরা কৃষকদেরকে নির্দেশনা দিয়েছি দ্রুত যাতে সেচের মাধ্যমে ধান লাগিয়ে ফেলে। গত বছরের মত এবারও ১৩-১৪ দিনের একটা সাপ্লিমেন্টারী সেচের ব্যবস্থার জন্য বিদ্যুতায়ন বোর্ডকেও সেচ পাম্পের লাইনগুলো সচল রাখতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।'
তিনি বলেন, ইতোমধ্যেই উত্তরাঞ্চলে সেচ পাম্প বসিয়ে ধান রোপণ শুরু করেছেন কৃষকরা। তবে সারাদেশে সেভাবে শুরু হয়নি।
গত বছর আমন মৌসুমে প্রায় দেড় কোটি টন চাল উৎপাদন হয়।
জানা যায়, গত বছরও প্রয়োজনীয় বৃষ্টির অভাবে সারাদেশে ৬ লাখের বেশি সেচ পাম্প ব্যবহার করতে হয়েছিল। বোরো মৌসুমে প্রতি বছর প্রায় ১৬ লাখ সেচ পাম্প ব্যবহার হয়, যার মধ্যে ৭৫-৮০ শতাংশই ডিজেলচালিত।