১০ বছর ধরে নথিপত্রেই ঘুরপাক খাচ্ছে বগুড়ার বিশেষায়িত শিল্প পার্ক
ব্যবসাবান্ধব বগুড়ায় চাহিদার বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)-এর পাশাপাশি বৃহৎ পরিসরে আরেকটি 'বিশেষায়িত' শিল্প পার্ক হওয়ার কথা ১০ বছর আগে। কিন্তু তা ঘুরপাক খাচ্ছে নথিপত্রেই। ফলে এ খাতে ব্যবসায়ীদের অন্তত ৪ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আটকে আছে।
বিসিক বলছে, এই প্রকল্প সকারের সবুজ পাতাভুক্তের তালিকায় উঠেছে। নতুন শিল্প পার্ক হলে লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। সেখান থেকে সরকার অন্তত হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পাবে।
১৯৬০ সালে বগুড়ার ফুলবাড়ি এলাকায় সাড়ে ১৪ একর জমিতে প্রথম গড়ে তোলা হয় বিসিক শিল্প নগরী। ওইসময় সবগুলো প্লটই বিক্রি হয়ে যায়। এরপর চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮০ সালে দ্বিতীয় দফায় আরও প্রায় ১৫ একর জমি সম্প্রসারণ করা হলে ওইবারও সব প্লট বরাদ্দ হয়ে যায়।
পরে ব্যবসা সম্প্রারণের পাশাপাশি উদ্যোক্তা বাড়লেও আর বাড়ানো সম্ভব হয়নি বিসিকের জায়গা। ফলে শিল্প উদ্যোক্তাদের চাহিদার প্রেক্ষাপটে জেলায় দ্বিতীয় শিল্পনগরী প্রতিষ্ঠার বিষয়টি উঠে আসে। ১০ বছর আগে প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়। কিন্তু তা আলোর মুখ দেখেনি।
বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি বলছে, বগুড়া শিল্প নগরী হিসেবে পরিচিতি পায় ৬০ এর দশকে। তখন এখানে কটন স্পিনিং মিল, সিগারেটের কারখানা, ম্যাচ ফ্যাক্টরি ও সিরামিকসহ বড় অনেক কলকারখানা গড়ে ওঠে। সেখানে এখন বগুড়া শহরের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অন্তত দেড় হাজার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কল-কারখানা যুক্ত হয়েছে। এর বাইরে বগুড়ার বিভিন্ন উপজেলায়ও আবাদি জমিতেও কলকারখানা হচ্ছে।
বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহসভাপতি মাহফুজুল ইসলাম রাজ বলেন, "ভৌগোলিক কারণে বগুড়ার অবস্থান উত্তরবঙ্গের কেন্দ্রে। ঢাকা-চট্টগ্রামের সাথে যোগাযোগও ভালো। এই কারণে বগুড়ায় কলকারখানা গড়ে ওঠা স্বাভাবিক। এই প্রবণতা আরও বাড়বে। ব্যবসায়ীরা হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে বসে আছে, কিন্তু বিনিয়োগের যথাযথ জায়গা পাচ্ছেন না। এই মুহূর্তে বগুড়ায় দ্বিতীয় শিল্প পার্কের বিকল্প নেই।"
বগুড়ায় আরেকটি শিল্প পার্কের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত অর্থনৈতিক শুমারি প্রতিবেদনে। এই সংস্থার তথ্য বলছে, স্বাধীনতার আগে বগুড়ায় মাত্র ১ হাজার ৫৪২টি শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল। আর ২০১৫ সালের মধ্যে জেলায় কুটির, মাঝারি এবং বৃহৎ ধরনের কলকারখানার সংখ্যা ১ লাখ ২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
জেলায় পাঁচ ধরনের শিল্প-কলকারখানায় ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৭৫১ নারী-পুরুষ স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজের সুযোগ পেয়েছেন। ২০০০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বগুড়ায় জুট মিল, পেপার মিল, রাইস ব্র্যান অয়েল মিল, টাইলস্ কারখানা, ওষুধ কারখানা, সেচযন্ত্র প্রস্তুতকারক ইন্ডাস্ট্রি এবং যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারক লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেটাল ইন্ডাস্ট্রির মতো শিল্প গড়ে উঠেছে বিচ্ছিনভাবে। এ অবস্থায় শহর ও এর আশেপাশে এলাকার পাশাপাশি বিভিন্ন উপজেলায় অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে কল-কারখানা।
কৃষি জমি রক্ষা, পরিবেশের ভারসাম্য ফেরানোসহ বহুমুখী কারণ বিবেচনায় নিয়ে বগুড়া বিসিক দ্বিতীয় শিল্প পার্ক স্থাপনের কাজ শুরু করে ২০১৪ সালে। শহরের শাকপালা এলাকায় ১৫০ একর জমিতে এই পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই এলাকা মৌজা রেট বেশি এবং নিচু হওয়ার কারণে তা বাতিল করে বিসিক। এরপর ২০১৮ সালে বগুড়ার শহরের পশ্চিমে শাজাহানপুর উপজেলায় ৩০০ একর জমিতে দ্বিতীয় শিল্প পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এখানে ১ হাজার প্লট বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হবে জানানো হয়।
বিসিক বলছে, দ্বিতীয় শিল্প পার্ক হবে পরিবেশবান্ধব। এখানে নিজস্ব বিদ্যুৎ স্টেশন, ফায়ার সার্ভিসের ব্যবস্থা থাকবে। গ্যাসলাইন ও পুকুর থাকবে এই আধুনিক শিল্প পার্কে।
বগুড়া বিসিকের উপমহাব্যবস্থাপক একেএম মাহফুজুর রহমান বলেন, "বগুড়ায় আরেক শিল্প পার্ক খুবই জরুরি। আধুনিক এই পার্কে জোন ভিত্তিক শিল্প কল-কারখানা গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। এই কারণে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে কয়েক বছর আগেই।"
এ প্রকল্প কেন বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন না বলে উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা।
তবে ১০ বছর আগের কী কারণে আটকে আছে তা জানা গেলো বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের মহাব্যবস্থাপক (প্লানিং) ড. মো. ফরহাদ আহম্মেদের কথায়। তিনি বলেন, "এই প্রকল্প মাঝখানে সবুজ পাতা থেকে ছুটে গিয়েছিল। আবার সবুজ পাতাভুক্ত হয়েছে। বগুড়ার দ্বিতীয় শিল্প পার্ক নিয়ে আগে একটি সমীক্ষাও হয়েছিল। কিন্তু সে সমীক্ষা আর গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। ওই সময় করা সমীক্ষা দিয়ে এই উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) আর অ্যাপ্রুভ হবে না।"
তিনি আরও বলেন, "বগুড়ার দ্বিতীয় শিল্প পার্কের ওই প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছিল ২০১৮ সালে। পরে এই প্রকল্পের ডিপিপি ২০২২ সালে কনভার্ট করা হয়েছে। ২০২২ সালে তা রিশিডিউল হলো। সব মিলে ডিপিপি এখন রেডি আছে। সরকার কিছু ডিপিপি সফটয়্যারের মাধ্যমে সরাসরি অনলাইনে প্রস্তুতের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই সিদ্ধান্ত মতে বগুড়ার প্রকল্প অনলাইনে প্রায় উঠে গেছে।"
বিসিকের দেওয়া তথ্যমতে, বগুড়ার দ্বিতীয় শিল্পপার্কের জন্য আবার সমীক্ষার জন্য আরেকটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে কথাও হয়েছে। নতুনভাবে করা সমীক্ষায় এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট আসিসমেন্ট যুক্ত থাকবে। এটি অবশ্য কিছুটা সময় সাপেক্ষব্যাপার।
বিসিক কর্মকর্তা ড. ফরহাদ বলেন, "ডিপিপিতে ৩০০ একর জায়গায় এ শিল্প পার্ক করার প্রস্তাব দেওয়া আছে। এটি গ্রিন সিগন্যাল না পেলে আরেকটি ডিপিপি করা আছে। সেখানে ১৫৩ একর প্রস্তাব করা আছে। কোনো কারণে এই মুহূর্তে বড় প্রকল্প না হলে তখন ১৫৩ একরের এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে। এটির ডিপিপিও চূড়ান্ত করা আছে।"
বগুড়ায় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনে (বিসিক) বছরে অন্তত হাজার কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন হয়। বগুড়ায় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনে (বিসিক) বছরে অন্তত হাজার কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন হয়। এ থেকে গত বছর সরকার রাজস্ব পেয়েছে ১৬৪ কোটি টাকা।