বেসরকারি খাতকে জ্বালানি তেল পরিশোধন, বিপণনের সুযোগ দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার
বিদ্যমান নীতিতে এক বড় পরিবর্তনের মাধ্যমে, জ্বালানি তেলের ওপর নিজের একক নিয়ন্ত্রণের অবসান করতে চলেছে সরকার। এ লক্ষ্যে বেসরকারিখাতের জন্য অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি, পরিশোধন, মজুদ, বিতরণ ও বিপণন উন্মুক্ত করার খসড়া প্রণয়ন করেছে।
এই উদ্যোগের আওতায়, বেসরকারিখাতের বিনিয়োগে উৎপাদিত জ্বালানি তেলের বিপণন শুরুর প্রথম পাঁচ বছরে অর্ধেকেরও বেশি ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন, জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল কিনে নেবে রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)।
এজন্য নীতিমালার খসড়া প্রণয়ন করেছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, যার একটি কপি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডও দেখেছে।
খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, বেসরকারি রিফাইনারিতে উৎপাদিত ডিজেল, অকটেন, পেট্রোল, জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল বিপণন শুরুর প্রথম ৩ বছর – মোট উৎপাদিত জ্বালানি তেলের ৬০ শতাংশ সরকার-নির্ধারিত মূল্যে বিপিসিকে সরবরাহ করতে হবে।
বাকি ৪০ শতাংশ জ্বালানি তেল নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ও নিজস্ব নিবন্ধিত বিপণন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিক্রি করতে পারবে। তবে বিক্রয় নেটওয়ার্কের স্বল্পতার কারণে কোন বেসরকারি রিফাইনারি ৪০ শতাংশ তেল বিক্রি করতে না পারলে– এর যেকোন পরিমাণ বিপিসির কাছে বিক্রি করতে পারবে।
পরবর্তী ২ বছরে বেসরকারি রিফাইনারিগুলো তাদের উৎপাদিত তেলের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিক্রি করতে পারবে। জ্বালানি তেলের আকর্ষণীয় ব্যবসায় বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততার প্রথম ৫ বছর পর উৎপাদিত জ্বালানির কত অংশ তারা বিপিসিকে সরবরাহ করতে হবে – তা পর্যালোচনা করে ঠিক করা হবে।
খসড়াটি চূড়ান্ত করতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সভাপতিত্বে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সভা ডাকা হয়েছে।
খসড়া নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, বিপিসির চাহিদা না থাকলে বা নিজস্ব বিপনন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিক্রির পর উদ্বৃত্ত জ্বালানি তেল ব্যবসায়ীরা বিদেশে রপ্তানি করতে পারবে।
বেসরকারি উদ্যোক্তারা তাদের উৎপাদিত জ্বালানি তেল বিক্রি করতে দেশব্যাপী সড়ক, মহাসড়ক, উপজেলা ও মেট্রোপলিটন এলাকাগুলোয় পেট্রল পাম্প স্থাপন করতে পারবেন। এসব পেট্রল পাম্পে সরকার নির্ধারিত খুচরা মূল্যে জ্বালানি তেল বিক্রি করা যাবে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে কোন বেসরকারি কোম্পানি জ্বালানি তেল আমদানি ও রিফাইনারি স্থাপনের অনুমোদন চেয়ে আবেদন করেছে কি-না, এমন প্রশ্নে বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (অপারেশন) মো. জাকির হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'আমি নতুন যোগদান করেছি। ফলে এ বিষয়ে কোন কিছু জানা নেই।'
তবে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অন্য একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে টিবিএসকে বলেন, বসুন্ধরা গ্রুপ, পারটেক্স গ্রুপ, টিকে গ্রুপ ও এলিট গ্রুপসহ বেসরকারিখাতের কয়েকটি বৃহৎ কোম্পানি অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি ও পরিশোধন করতে রিফাইনারি স্থাপনের অনুমোদন চেয়ে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে।
বসুন্ধরা গ্রুপের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, 'এই প্রজেক্ট নিয়ে আমরা খুবই সিরিয়াস। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে অয়েল রিফাইনারি স্থাপনের জন্য আমরা ২০০ একর জমি কিনেছি, যা হবে দেশের সর্ববৃহৎ পরিশোধনাগার।'
তবে বৈশ্বিক ও দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন প্রতিকূলতা প্রকল্পটির অগ্রগতি ব্যাহত করছে। এরপরেও সরকার লাইসেন্স দেওয়ার আগেই বসুন্ধরা গ্রুপ প্রকল্পটি সম্পন্ন করতে পারবে বলে জানান তিনি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই সরকার জ্বালানি তেলের সরবরাহ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিপিসি এককভাবে এ কাজ পরিচালনা করছে।
অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে ১৯৬৮ সালে স্থাপিত দেশের একমাত্র জ্বালানি তেল পরিশোধন কোম্পানি- ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরিশোধন করছে বিপিসি।
এই রিফাইনারির বছরে পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন, যা দিয়ে দেশের মোট চাহিদার ২০ শতাংশ মেটানো যায়। দেশের জ্বালানি তেলের চাহিদার বাকি ৮০ শতাংশ পরিশোধিত তেল আমদানির মাধ্যমে মেটানো হয়।
সক্ষমতা বাড়াতে প্রায় ২৩,০০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ইস্টার্ন রিফাইনারি ইউনিট-২ স্থাপনের প্রকল্প নিচ্ছে বিপিসি, যা ২০২৭ সালে নির্মাণ সম্পন্ন হবে। এটি হলে আরও ৩০ লাখ টন ক্রুড অয়েল পরিশোধন করা সম্ভব হবে।
জ্বালানি বিভাগ জ্বালানি তেল সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিচ্ছে। মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরবরাহ ব্যাহত হয়ে জ্বালানি বাজার যখন অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছিল– তখন এর গুরুত্ব আরও বেশি উপলদ্ধি করে।
বেসরকারি খাতকে যুক্ত করে জ্বালানি পরিশোধনের মিলিত সক্ষমতা গড়ে– লাভবান হয়েছে প্রতিবেশী ভারত। অব্যাহত জ্বালানি সংকট থেকে শিক্ষা নিয়ে, পরিশোধন সক্ষমতা বাড়ানোর একই রকম উদ্যোগ জোরালো করছে পাকিস্তান।
জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন আইন- ২০১৬ এবং ন্যাশনাল এনার্জি পলিসি- ১৯৯৬ এর মতো বিভিন্ন আইন ও বিধিমালায় প্রদত্ত ক্ষমতা ও নির্দেশনা মোতাবেক বেসরকারি পর্যায়ে রিফাইনারি স্থাপনের নীতিমালার খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে।
২০১৩ সাল থেকে সরকার জ্বালানি তেলে কোনো ভর্তুকি দেয়নি, এবং আইএমএফ থেকে নেওয়া ঋণের শর্ত অনুযায়ী, ২০২৬ সাল থেকে এই ধারা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করেছে।
বিদ্যুৎখাতে সরকারের ভর্তুকি প্রদান চলমান থাকায় রেন্টাল ও কুইট রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বিদ্যুৎ বিভাগ পুর্নভরণ করছে। গত অর্থবছর এখাতে ৩০,০০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে, যার বড় অংশই পেয়েছে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল প্ল্যান্টগুলো।
এই প্রেক্ষাপটে, নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় জ্বালানি তেল বিপণনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিপিসিকে লিটারে ১ টাকা হারে সার্ভিস চার্জ দেবে।
বেসরকারি উদ্যোক্তাদের যোগ্যতার শর্ত:
খসড়া নীতিমালায় বেসরকারি উদ্যোক্তাদের আবশ্যিক যোগ্যতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, উদ্যোক্তাদের জ্বালানি পণ্য খাতের বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
এছাড়া, বেসরকারি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের গত ৫ বছরের মধ্যে যেকোন ৩ বছরে প্রতিবছর টার্নওভার কমপক্ষে ৫,০০০ কোটি টাকা বা সমমূল্যের মার্কিন ডলারে হতে হবে। বেসরকারি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানকে দেশে নিজস্ব কিংবা যৌথ মালিকানায় বার্ষিক কমপক্ষে ১৫ লাখ টন ক্ষমতাসম্পন্ন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিশোধন বা প্রক্রিয়াকরণের ক্ষমতাসম্পন্ন রিফাইনারি স্থাপন করতে হবে।
তবে বেসরকারি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান বা তার কোন পরিচালক ঋণখেলাপি হতে পারবে না।
খসড়া নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, বেসরকারিখাতে রিফাইনারি স্থাপনের জন্য কমপক্ষে ৮০ একর জমি থাকতে হবে এবং রিফাইনারির অপারেশন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ন্যূনতম ২ লাখ টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন স্টোরেজ সুবিধা থাকতে হবে।
রিফাইনারি স্থাপনের চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়ার পর, বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরুর আগে নিরাপত্তা গ্যারান্টি হিসেবে বিপিসির অনুকূলে বেসরকারি উদ্যোক্তাকে ২৫০ কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি দিতে হবে।
অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির পর নিজস্ব মালিকানায় বা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় লাইটারেজ জাহাজ, কোস্টাল ট্যাঙ্কার ও ট্যাংকলরি থাকতে হবে।