খোলা আকাশের নিচে বৃদ্ধ দম্পতির অনিশ্চিত যাত্রা
মেঘনা পাড়ে পড়ে থাকা খালি ভিটার সামান্য অংশের দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে চোখের পানি মুছছেন বৃদ্ধা জানোয়ারা বেগম। পাশে বৃদ্ধ স্বামী মজিবুল হকের চোখে টলমল করছে বুকফাটা কষ্টের জল। এ বয়সে এত কষ্ট কীভাবে সইবেন? কে কাকে সান্ত্বনা দেবেন?
বুধবারের ঘূর্ণিঝড় আম্পানে তাদের মাথা গোঁজার ঠাইঁটুকুও কেড়ে নিয়েছে। গত দুদিন ধরে তারা খোলা আকাশের নিচে। রাত্রিযাপন করছেন সুপারি বাগানে। এখন অনিশ্চিত গন্তব্যে পা বাড়িয়েছেন অসহায় এ দম্পতি। শুধু মজিবুল হক দম্পতিই না, গ্রামের বহু মানুষই এখন অসহায় নিরুপায়।
শুক্রবার সকালে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার চর ফলকন ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের ফলকন গ্রামে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। মজিবুল হক একই গ্রামের মৃত আনার আহমদের ছেলে। সন্তান এবং সহায় সম্বলহীন এ বৃদ্ধ দম্পতিকে দেখার মতো কেউ নেই তাদের পাশে।
বুধবারের ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে মেঘনার সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস এবং নদীর তীব্র ঢেউয়ে কবলে পড়ে ভেঙ্গে গেছে এলাকার অন্তত ২০-৩০ বসতঘর। শুধু ফলকনই না, কমলনগর এবং রামগতি উপজেলার ৩৩ কিলোমিটার এলাকার মেঘনাপাড়ের প্রায় সবখানে বেড়েছে নদী ভাঙ্গন। নদীপাড়ের বহু ঘরবাড়ি স্থানান্তর শুরু হয়েছে।
চোখের পানি মুছতে মুছতে বৃদ্ধ মজিবুল হক জানান, তাদের ছোট ঝুপঁড়ি ঘর থেকে মেঘনার দূরত্ব ছিল ১৫-২০ মিটার। মে মাসের শুরুতে কালবৈশাখী ঝড়ে একবার উড়িয়ে নিয়েছে। পরে গ্রামবাসীর সহযোগিতায় কয়েক হাত পিছিয়ে আবার ঘর তুলে কোনো রকম ঘুমাতেন। বুধবার বিকেলে বৃদ্ধা জানোয়ারা খাতুন যখন ঝুঁপড়ির সামনে বসে সন্ধ্যার খাবার রান্না করছিলেন, ঠিক তখনই হঠাৎ মেঘনার ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় ঘরসহ পাতিলের ভাত।
ভয়ে কাপঁতে কাপঁতে অন্যের বাড়িতে উঠে কোনোমতে এ যাত্রা প্রাণে বাঁচেন। ঝড়ে ঘর নিয়ে যাওয়ার পর হেঁটে এক কিলোমিটার দূরের ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে রাত্রিযাপন করেছিলেন এই প্রবীণ দম্পতি। সারাদিনের রোজার পর আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে রাতে কোনো খাবারও পাননি। ঝড় কমে যাওয়ার পর ভোর রাতে এক প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে সামান্য কিছু খাবার খেয়ে আবার রোজা রেখেছিলেন। কিন্ত সকালে লাঠিভর করে বহু কষ্টে ফিরে দেখেন, তাদের ঝুপঁড়ি নেই, কোনো মালামালও নেই। ঝড় থেমে যাওয়ার দুদিন পরেও তাদের খোঁজ নেওয়ার জন্য আসেনি কেউ।
মজিবুল হক দম্পতির মতো শামছুল হক (৭০), খায়ের (৬০), মান্নানসহ (৫৫) বহু পরিবারে ঘর মেঘনার জলোচ্ছ্বাস আর ঢেউয়ে ভেঙ্গে দিয়ে গেছে। একরাতেই ভেঙ্গে গেছে প্রায় ৫০০ ফুট প্রস্থের জায়গা। কয়েক কিলোমিটারব্যাপী একই দৃশ্য। এখন প্রতিদিনই জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে ঘরবাড়ি। সামনে পুরো বর্ষায় কীভাবে বাঁচবেন, সেটা ভেবে শুধু চোখের পানি ফেলছে নদী পাড়ের মানুষ।
মজিবুল হক জানায়, যুবক বয়সে নদীতে মাছ ধরতেন। বাড়ি ছিল বর্তমান এলাকা থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পশ্চিমে, নেয়ামতপুরে। কিন্ত মেঘনায় প্রথম সেই বাড়ি হারিয়েছেন। পরে ১০ কিলোমিটার পূর্বে এসে আবার বসতি স্থাপন করেন। কিন্ত মেঘনা সেখানেও হানা দেয়। এবার কোনো সহায় সম্পত্তি না থাকায় চর ফলকন গ্রামের এলাকার খায়ের মানবিক কারণে মজিবুল হক দম্পতিকে তাদের বাড়িতে ঘর তুলে জায়গা দিয়েছিলেন।
এখানেও মেঘনা হানা দিয়েছে তিনবার। যে খায়ের তাদের থাকতে দিয়েছেন, আম্পান সে খায়েরকেও ভিখারী বানিয়ে গেছে। এখন খায়েরের চোখে মুখেও অসহায়ত্বের চাপ। কোথায় যাবেন পরিবার পরিজন নিয়ে?
বুধবার সকালেও নারিকেল গাছের ডাব পেড়ে খেয়েছেন বৃদ্ধ শামছুল হক। কিন্ত রাতে নারিকেল গাছসহ তার ঘর নিয়ে গেছে আম্পান। এক ছেলে নদীতে মাছ ধরে কোনোমতে সংসার চালায়। তার ঘাড়ে চার মেয়ে, নাতি-নাতনিসহ প্রায় ১০ জন। কোনো সহায় সম্পত্তি নেই। অন্য ব্যবস্থা না পেয়ে এখন এক মসজিদের জায়গায় বাৎসরিক দুই হাজার ভাড়ার চুক্তিতে ঘর তুলছেন থাকার জন্য।
নদী পাড়ে এভাবে শত শত পরিবারকে দেখা গেছে ঘর ভাঙার কাজে।
কমলনগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ বাপ্পী জানান, আমরা স্থানীয় চেয়ারম্যানদেরকে বলেছি আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তথ্য দিতে। কিন্ত তারা এখনো কোনো তথ্য আমাদের জানায়নি। এখন আপনার থেকে জানার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।