অপর্যাপ্ত অবকাঠামো নিয়েও যশোরের নওয়াপাড়া নৌ-বন্দরে পণ্য আমদানির হার বৃদ্ধি
যশোরের নওয়াপাড়া নৌ-বন্দরে জাহাজে পণ্য আমদানির হার বেড়েছে। গেল ২০২২-২৩ অর্থবছরে জাহাজে পণ্য এসেছে অন্য বছরের তুলনায় বেশি। গেল বছরে এক হাজার ৫৮৪টি জাহাজে পণ্য এসেছে ৬ লাখ ৯২ হাজার ৩১৩ মেট্রিক টন, যা থেকে সরকার রাজস্ব আদায় করেছে ২ কোটি ৪২ লাখ ২২ হাজার ৮৭৫ টাকা।
এর আগে বন্দরটিতে ২০২১-২২ অর্থবছরে এক হাজার ৩৭৫টি জাহাজে পণ্য এসেছে ৫ লাখ ৯০ হাজার ২২০ মেট্রিক টন। সরকার রাজস্ব আদায় করেছে ২ কোটি ৪০ লাখ ৮২ হাজার ৬৪৪ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে এক হাজার ২০৫টি জাহাজে পণ্য এসেছে ৫ লাখ ৩৮ হাজার ৯২০ মেট্রিক টন। রাজস্ব আয় হয়েছে ২ কোটি ৩৪ লাখ ৪২ হাজার ৩০০ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দুই হাজার ৩০০ জাহাজে ১১ লাখ ৫০ হাজার ৩০০ মেট্রিক টন পণ্য এসেছিল। এই বন্দর দিয়ে মূলত সার, সিমেন্ট, কয়লা, গমসহ বিভিন্ন পণ্য এসে থাকে।
এদিকে নওয়াপাড়া নৌ-বন্দরে গড়া ৮টি জেটি ও একটি পল্টুন কাজে আসছেনা। পণ্য আমদানির পর খালাস করার জন্য এগুলো নির্মাণ করেছিল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ব্যবসায়ীরা এসব জেটি ব্যবহার করছেন না। তারা বলছেন, নদীর তীর থেকে জেটি ও পল্টুন অনেক দূরে হওয়ার কারণে শ্রম খরচ ও সময় বেশি লাগে। এজন্য তারা গাইডল নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন।
জানা গেছে, ২০০৪ সালের এপ্রিলে ঘোষণা দেওয়া হয় যশোরের অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়ায় নদীবন্দর স্থাপনের। ২০০৭ সালের মে মাসে শুরু হয় এর কার্যক্রম। ভৈরব নদের চেঙ্গুটিয়া থেকে ভাটপাড়া ফেরিঘাট পর্যন্ত প্রায় সাড়ে বারো কিলোমিটার দীর্ঘ সীমানা নির্ধারণ করা হয় নদীবন্দরটির। স্থাপন করা হয় ছয়টি পন্টুন। আয় হতে থাকে রাজস্ব। সময়ের সাথে বেড়েছে রাজস্ব আয়। কিন্তু এতটুকুও বাড়েনি নদীবন্দরের উন্নয়ন কাজ।
নওয়াপাড়ার কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, সড়ক, রেল ও নদীপথে ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে নওয়াপাড়ায় ব্যাপক প্রসার ঘটে সার, খাদ্যশস্য ও সিমেন্ট ব্যবসার। নওয়াপাড়া পরিণত হয় দেশের অন্যতম বড় বিপণন কেন্দ্রে। আমদানি করা সার ও খাদ্যশস্য চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে বড় জাহাজ থেকে খালাসের পর তা ছোট বার্জ ও কার্গোতে করে নদীপথে নওয়াপাড়া বন্দরে আনা হয়। ভৈরব নদে প্রতিদিন অর্ধশতাধিক বার্জ ও কার্গো থেকে পণ্য উঠানো-নামানো হতো। এছাড়া ভারত থেকে স্থলপথে যে সব পণ্য আমদানি করা হয় তার বেশিরভাগ রেলের ওয়াগনে করে দর্শনা স্থলবন্দর হয়ে নওয়াপাড়ায় আনা হয়। এ সব পণ্য সড়ক ও নদী পথে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।
ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, প্রয়োজনীয় স্থাপনা নির্মাণ, ওয়্যারহাউজের সুবিধাদি বৃদ্ধি, নদী ভাঙ্গন রোধে কী-ওয়াল নির্মাণ, মালামাল ওঠানামার জন্য আরসিসি সিঁড়ি নির্মাণ এবং মালবাহী ট্রাকের জন্য পার্কিং ইয়ার্ড নির্মাণ করেনি বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দরটি আধুনিকায়নের ক্ষেত্রেও নেওয়া হচ্ছে না কোনো প্রকল্প। সরকার এ বন্দর থেকে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করলেও তারা সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন।
সার ও খাদ্যশস্য আমদানিকারক আদিত্য মজুমদার বলেন, "নদের ভাঙ্গন রোধে কী-ওয়াল এবং বার্জ ও কার্গো থেকে মালামাল ওঠানো-নামানোর জন্য প্রয়োজনীয় সিঁড়ি, সড়ক ও মালবাহী ট্রাকের জন্য পার্কিং ইয়াড না থাকায় প্রতিনিয়ত ভীষণ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। আমরা নিজেদের ঘাটও নিজেরাই তৈরি করে নিচ্ছি।"
নওয়াপাড়া নদীবন্দরে পণ্য আমদানি বোঝাই জাহাজের হার বাড়লেও উন্নয়ন হচ্ছে না। শুধু ট্যাক্স দিয়েই যাচ্ছি। কোনো প্রকার সুবিধা পাচ্ছি না।"
নওয়াপাড়া সার ও খাদ্যশস্য ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহ জালাল হোসেন বলেন, "ভৈরব নদকে ঘিরে নওয়াপাড়ার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। আমরা ঠিকমতো ট্যাক্স দিচ্ছি। কিন্তু নদীবন্দরের কোনো উন্নয়ন হচ্ছে না। এখানে ছোট জাহাজ আসলেও ঘাটে ভিড়তে পারে না। এজন্য আমরা গাইডল নির্মাণের দাবি করেছিলাম। কিন্তু তা করা হয়নি।"
বন্দর সূত্র জানায়, নদের দুই তীরভূমির পরিমাণ ৫১ দশমিক ৫৫ একর। এর বেশিরভাগ জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে পাট, সার, সিমেন্ট, চাল, ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র এবং বিভিন্ন রকম ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ঘাট-গুদাম।
যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি ও আমদানিকারক মিজানুর রহমান খান বলেন, "প্রতিবছর এই বন্দরটিতে পণ্য আমদানি বাড়ছে, কিন্তু সেই অনুযায়ী ব্যবসায়ীরা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না। নদী খনন করে এর পরিধি ও সুবিধা বাড়ানো প্রয়োজন। তাহলে যশোর অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা বন্দরটি ব্যবহারে আগ্রহ বেশি দেখাবে।"
এ ব্যাপারে নওয়াপাড়া নৌ-বন্দরের উপপরিচালক মাসুদ পারভেজ বলেন, "৪৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বন্দরের ৩৭ কিলোমিটারে ৩০ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিংয়ের কাজ করা হয়েছে গত বছর। এখন সরকার বছরে প্রায় ৪ কোটি টাকার রাজস্ব আয় করছে বন্দরটি থেকে। ব্যবসায়ীরা যাতে সহজে জাহাজে পণ্য আনতে পারেন তার জন্য আমরা সব সময় কাজ করে যাচ্ছি।"