কৃষ্ণসাগরে গমের যুদ্ধ কি নতুন শস্যচুক্তির সাইড শো!
বিশ্ববাজারে প্রতিপক্ষের গম রপ্তানি বন্ধ করতে একে-অন্যের বন্দরগুলোয় হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া ও ইউক্রেন। ফলে গম নিয়ে কৃষ্ণসাগরের জলপথে লড়াই তীব্রতা পাচ্ছে। এতে বিশ্ববাজারে চড়তেই থাকবে শস্যটির দাম। আপাতদৃষ্টিতে এটা কোনো সুখবর নয়, কিন্তু এরমধ্যেই ক্ষীণ এক আশার আলোও দেখা যাচ্ছে। রপ্তানিতে বাধা যেহেতু দুই দেশের জন্যই ক্ষতি, এ সত্য উপলদ্ধি করেই হয়তো তারা নতুন শস্য চুক্তি সম্পাদনে আগ্রহী হবে।
গত ৪ আগস্ট নভোরুশিস্ক বন্দরে ড্রোন হামলা প্রমাণ করে গম বা তেলবাহী রুশ জাহাজে আক্রমণের সামর্থ্য আছে ইউক্রেনের। এর দুই দিন আগেই ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশে ইজমাইল বন্দরে বোমাবর্ষণ করা হয় – যেটি দানিয়ুব নদীর মোহনায় – ইউক্রেনের গম ও অন্যান্য শস্য রপ্তানির একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর।
এর আগে গত মাসে কৃষ্ণসাগর শস্যচুক্তি থেকে বেরিয়ে আসে রাশিয়া। ২০২২ সালের জুলাইয়ে তুরস্ক ও জাতিসংঘের মধ্যস্থতায়, এই চুক্তিতে সই করেছিল বিবাদমান দুই পক্ষ।
বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ গম রপ্তানিকারক ইউক্রেন। চুক্তির আওতায়, কিয়েভ ওদেসা বন্দর দিয়ে শস্য রপ্তানির সুযোগ পেয়েছিল।
কিন্তু চুক্তিটি অকার্যকর হওয়ায় দানিয়ুবের বন্দরগুলো ইউক্রেনের শস্য রপ্তানির বিকল্প মাধ্যমে হয়ে ওঠে। এগুলোর ওপর হামলা চলতে থাকলে– রাজস্ব আয়ের এক প্রধান উৎস হারাবে ইউক্রেন।
যুদ্ধ শুরুর আগে ২০২১ সালে শস্য রপ্তানির মাধ্যমে ২৮ বিলিয়ন ডলার আয় করে দেশটি, যা ছিল তাদের মোট রপ্তানির ৪১ শতাংশ।
অন্যদিকে, রাশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় গম রপ্তানিকারক। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের হিসাবমতে, ২০২২/২৩ মওসুমে রেকর্ড ৪ কোটি ৫৫ লাখ টন গম রপ্তানি করে রাশিয়া, এবছর সে রেকর্ডও ভাঙতে পারে।
সে তুলনায়, মাত্র ১ কোটি ৭০ লাখ টন গম রপ্তানি করেছে ইউক্রেন। যার সিংহভাগটাই সম্ভব হয় কৃষ্ণসাগর চুক্তির আওতায়। ফলে কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিক লেনদেনের একটি প্রধান বাজার- শিকাগো বোর্ড অভ ট্রেড- এ গমের দাম প্রায় ৪০ শতাংশ কমে (গত বছরের) অক্টোবর থেকে (চলতি বছরের) মে মাসের মধ্যে।
চুক্তি থেকে রাশিয়া যখন সরে যাওয়ার কথা বলছিল, সরবরাহ নিয়ে উদ্বেগে ওই সময়ে বিশ্ববাজারে গমের দাম কয়েকদিনের ব্যবধানে ১৭-২০ শতাংশ পর্যন্ত উল্লম্ফন করে, যদিও তা ছিল স্বল্পস্থায়ী। এরপর কমতে শুরু করলেও নভোরুশিস্ক বন্দরে ইউক্রেনের হামলার পর, গত সোমবার দাম আবার ২ শতাংশ বেড়ে যায়।
গত মাসে দানিয়ুব নদীর বন্দরগুলোর প্রথমবার হামলার ঘটনায় বুশেলপ্রতি দর সর্বোচ্চ ৭.৬০ ডলারে পৌঁছালেও- বাম্বার ফলনের প্রত্যাশায় এখনও তার চেয়ে কম ৬.৪৭ ডলারে রয়েছে। বর্তমানে এই দর রয়েছে যুদ্ধ-পূর্ব ২০২১ সালের অক্টোবর মাসের কাছাকাছি পর্যায়ে।
বাজার খুব আশাপ্রদ অবস্থানে থাকায়, রপ্তানিকারক দেশদুটির হয়তো একে-অপরের বন্দর ও শস্য রপ্তানি অবকাঠামোয় হামলা চালানোর যথেষ্ট কারণ আছে। বিশ্ববাজারে দাম চড়া হলে, আবারো চুক্তির জন্য আলোচনায় বসতে পারে দুই পক্ষ।
তাছাড়া, দানিয়ুবের বন্দরগুলো ইউক্রেনের প্রতিবেশী ন্যাটো সদস্য রোমানিয়ার সীমান্তের কাছাকাছি। কোনোভাবে ভুল করে রোমানিয়ার ভূখণ্ডে হামলা হলে– ন্যাটোর সংবিধান অনুযায়ী তা পুরো জোটের ওপর আক্রমণ বলে গণ্য করা হবে। ফলে এটি মস্কোর জন্য বিপজ্জনক এক খেলা।
তবে এটাও ঠিক, নতুন চুক্তি করা যদি রাশিয়ার জন্য লাভজনক হয়– কেবল তাহলেই চুক্তি সম্পাদনের আশা করতে পারে ইউক্রেন। সে তুলনায়, প্রথম কৃষ্ণসাগর শস্যচুক্তি থেকে রাশিয়া সেভাবে উপকৃত হয়নি।
সেই লাভের সম্ভাবনা অনেকটাই নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন-সহ কিয়েভের পশ্চিমা মিত্রদের ওপর। চুক্তির বিনিময়ে বিশ্ববাজারে রাশিয়ার শস্যের চালান পৌঁছাবে– এমন গ্যারান্টি যদি তারা দেয়, তাহলে উৎসাহী হবে মস্কো।
বিশেষত, আন্তর্জাতিক লেনদেনের ব্যবস্থা সুইফট- এ যদি রাশিয়ার কৃষি ব্যাংকগুলোকে আবারো যুক্ত করে তারা, তাহলে সহজেই রপ্তানি আয় পাবে মস্কো। পুতিন আগে থেকেই এ দাবি জানিয়ে আসছেন। সুতরাং, বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে এই সামান্য ছাড় তারা চাইলে দিতে পারে।
তাছাড়া, এতদিনে মস্কো ও কিয়েভ উভয়েই হয়তো উপলদ্ধি করেছে – গুরুত্বপূর্ণ শস্য রপ্তানিকে রক্ষা করা তাদের অভিন্ন স্বার্থ।