এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ময়লার ভাগাড় পরিণত হলো খেলার মাঠে
রাজধানীর বাউনিয়াবাঁধ এ ব্লক এলাকার শিশুদের একমাত্র খেলার মাঠটি এক সময় ছিল আবর্জনার ভাগাড়। অল্প বৃষ্টি হলেই সেখানে জমে যেত পানি, তৈরি হতো অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। বিশেষত, শিশুদের খেলার জন্য অনুপযোগী হওয়া ছাড়াও স্থানটি ছিল স্বাস্থ্যঝুঁকির অন্যতম উৎস।
তবে বর্তমানে ১২ লাখ টাকারও কম খরচে বাউনিয়াবাঁধ এলাকার প্রায় এই ১ বিঘা জায়গার উন্নয়ন করে শিশুদের খেলার উপযোগী মাঠ তৈরি করেছে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা।
এক সময় পরিত্যাক্ত ও ময়লার ভাগাড় হিসেবে পড়ে থাকা এ জায়গা এখন সারাদিনই পূর্ণ থাকে শিশুদের কোলাহলে। বিভিন্ন বয়সী মানুষ এসে সময় কাটাতে পারেন, আবার কেউ কেউ আসেন হাঁটার জন্যও।
সম্প্রতি সেভ দ্য চিলড্রেনের একটি প্রকল্পের আওতায় এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে বাউনিয়াবাঁধের এ ব্লক এলাকার শিশুদের জন্য খেলার মাঠসহ একটি গণপরিসর তৈরি করা হয়েছে। মাঠের চারিদিকে বসার জায়গা, শিশুদের খেলার সামগ্রী স্থাপন করা হয়েছে প্রকল্পের আওতায়। এছাড়া মাঠের চারপাশে বিভিন্ন জাতের গাছের চারা রোপণসহ হাঁটার পথের উন্নয়ন করা হয়েছে।
এই এলাকার ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী ইব্রাহিম টিবিএসকে জানায়, "এই মাঠে আগে আমরা ছোট পরিসরে খেলাধুলা করতাম, কিন্তু আশপাশে ময়লা ও দুর্গন্ধে অনেকেই আসতো না। এখন পরিষ্কার হওয়ায় খেলাধুলায় আর প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে না। অবসরে বন্ধুদের নিয়ে নিয়মিত খেলাধুলা করি।"
এ এলাকার এক শিশুর অভিভাবক আমিনুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "আমার ১০ বছরের বাচ্চাকে খেলতে দেওয়ার মতো কোনো স্থান পাইনি আগে, তাই বাসাতেই কম্পিউটার আর মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। এখন ছোট পরিসরে হলেও খেলাধুলা করতে পারছে ওরা। আমরা এ শহরে যান্ত্রিক মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠতে চাই না। অন্তত শিশুদের জন্য এমন আরও খেলার মাঠ ও পার্ক চাই।"
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন নগর এলাকার প্রান্তিক শিশু কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করতে বস্তিসহ নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত এলাকায় খেলার মাঠের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কার্যকর পরিকল্পনা, যথাযথ নকশা প্রণয়ন করবার পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্ততার মাধ্যমে স্বল্প ব্যয়ে ও স্বল্প সময়েই এসব এলাকার উন্মুক্ত পরিসর ও খেলার মাঠের টেকসই উন্নয়ন করা সম্ভব।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, "বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা আমাদের এসব পরিত্যাক্ত জায়গা নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। সিটি কর্পোরেশন থেকে এসব উন্নয়নের উদ্যোগ নিলে আমাদের শিশুরা আরও অনেক গণপরিসর পাবে। শুধু টাকা খরচের প্রকল্প না করে স্বল্প সময়ে ও স্বল্প খরচে গণপরিসর বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।"
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, "এই মাঠের উন্নয়ন নকশায় ব্যয়বহুল ও ভারী উপাদান ব্যবহার না করায় মাঠটি স্বল্প ব্যয়ে উন্নয়ন করা সম্ভব হয়েছে এবং এলাকাবাসীর আস্থা অর্জন করতে পেরেছে।"
মাঠটিতে যেন আগের মতই সাধারণ ছেলেমেয়েরা অবাধে খেলতে পারে সে বিষয়টি নিশ্চিত করার ব্যাপারে এলাকাবাসীকে অনুরোধ জানান তিনি।
মাঠ সংলগ্ন একটি পুরনো কক্ষ এলাকাবাসীরা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য ব্যবহার করতেন। তবে এই কক্ষটি ছিল ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যবহারের অনুপোযোগী। পরবর্তীতে সেভ দ্য চিলড্রন এক প্রকল্পের আওতায় স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও উন্নয়ন কমিটির সহায়তায় খেলার মাঠটি শিশুদের খেলার উপযোগী এবং কক্ষটিকে কমিউনিটি সেন্টার হিসেবে সংস্কারের লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করে।
সেভ দ্য চিলড্রেন ছাড়াও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এবং স্থানীয় বাসিন্দারা পুরো প্রকল্পে সহায়তা করেছেন।
এই উন্নয়ন উদ্যোগে কারিগরি পরামর্শ দিয়েছে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) এবং ভূমিজ।
সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশের পরিচালক শীমতানা শামীম বলেন, "আমাদের শিশুদের খেলার মাঠের সংকট আছে, প্রকৃতির সান্নিধ্য পাবার চ্যালেঞ্জ আছে। এই বাস্তবতায় ছোট পরিসরে, স্বল্প খরচে, এলাকার মানুষের আন্তরিক সহযোগিতায় শিশুদের জন্যে খেলার সুবিধা ও প্রাণ প্রকৃতি ফিরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টায় আমাদের এ উদ্যেগটি সবার জন্যে উদাহরণ হতে পারে।"
"বাউনিয়াবাঁধের স্বল্প আয়ের অনেকগুলো পরিবারের শিশুরা সবুজ চত্বর, খেলার মাঠ এবং প্রকৃতির সান্নিধ্য পাবার সুযোগ পাবে, যা তাদের মানসিক বিকাশ এবং একটু সুস্থ পরিবেশে বেড়ে উঠার সুযোগ করে দেবে," যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, "স্থানীয় এলাকাবাসীর সম্পৃক্ততার মাধ্যমে যে সুন্দর নকশা প্রণয়ন সম্ভব, তা এই খেলার মাঠের উন্নয়নের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে। আমাদের নগর এলাকার অন্যান্য মাঠের উন্নয়ন পরিকল্পনায়ও এটি অনুসরণ করা দরকার।"
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মাকসুদ হাশেম জানান, কমিউনিটি পর্যায়ে এই ধরনের উদ্যোগে সিটি কর্পোরেশনের সহযোগিতা সবসময়ই থাকবে।
এছাড়া নগরীর সবুজায়নের লক্ষ্যে মাঠের চারপাশে নিম গাছ, বট গাছ, কৃষ্ণচূড়া, বকুল, কদম, কাঠ বাদাম, অর্জুন, সুপারি, জারুল, হিজল ও মাধবীলতাসহ বিভিন্ন গাছের চারা রোপন করা হয়েছে।