মার্কিন গোয়েন্দারা বলছেন, ইউক্রেনের ‘কাউন্টার-অফেন্সিভ’ ব্যর্থ
ইউক্রেনের আক্রমণ অভিযানের লক্ষ্য ছিল দক্ষিণের মেলিটোপোল শহর। কিন্তু, ঘোষিত সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পারায়– অভিযান ব্যর্থ হচ্ছে বলে মনে করছেন মার্কিন গোয়েন্দারা।
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর এমন মূল্যায়ন উঠে আসে ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়, মেলিটোপোল পৌঁছে ক্রিমিয়াকে দক্ষিণ ইউক্রেনের রুশ বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিল কিয়েভ। এজন্য আগে থেকেই যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় কার্চ সেতুতে হামলা চালিয়ে আসছে। হামলায় সেতুর সড়ক অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, এখনও এটি সচল রয়েছে। তার সাথেই চলে স্থলপথের অভিযান।
এখন মেলিটোপোল থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে রবোতিন গ্রামে প্রচণ্ড লড়াই চলছে। ইউক্রেন এখানে ৮২তম এয়ারবর্ন-সহ তাদের সেরা প্রশিক্ষিত রিজার্ভ ইউনিটগুলোকে যুদ্ধ করতে পাঠিয়েছে।
যুক্তরাজ্যের চ্যালেঞ্জার-২ ট্যাংক, মার্ডার সাঁজোয়া যান, যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্রাইকার ট্যাংক ও ব্রাডলি সাঁজোয়া যান দিয়ে সুসজ্জিত এই সেনাদের– রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করে দ্রুত মেলিটোপোল পৌঁছানোর লক্ষ্য রয়েছে।
ইউক্রেনীয়রা এই আক্রমণে অস্থায়ী কিছু সাফল্য পেলেও, জনবল ও সরঞ্জামের বিপুল ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে তাদের চরম মূল্য দিতে হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আক্রমণকারীদের পিছু হটতে বাধ্য করেছে রুশ সেনারা।
যদিও পশ্চিমারা ধারণা করেছিল, তাদের দেওয়া অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে রাশিয়ান প্রতিরোধ চুর্ন করে এগিয়ে যাবে ইউক্রেনীয়রা। কিন্তু, তা হচ্ছে না।
যুদ্ধে কৌশলগত রিজার্ভ সেনাদের মোতায়েন বরং ইউক্রেনের মরিয়া চেষ্টার লক্ষণ। রিজার্ভ সেনাদের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা ভারী হলে, যেমনটা বর্তমানে হচ্ছে– তারা আর কার্যকরভাবে লড়াইয়ের উপযুক্ত থাকবে না। ইউক্রেনের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাই তাতে মুখ থুবড়ে পড়বে।
বাস্তবতা হচ্ছে, কৌশলগত রিজার্ভের শূন্যতা পূরণের নেই ইউক্রেনের। বেশিরভাগ শিক্ষিত তরণ- যাদের এসব ইউনিটে ভর্তি করা যেত – হয় তারা ঘুষ দিয়ে ভর্তি এড়িয়েছে, নয়তো দেশ ছেড়েছে।
যুদ্ধের মধ্যেও ইউক্রেনকে দুর্নীতির থাবা ক্ষতবিক্ষত করছে। এই ঘুষ বাণিজ্যের জন্যই চলতি সপ্তাহে ইউক্রেনের সকল সামরিক নিয়োগকর্তাদের চাকরিচ্যুত করেছেন জেলেনস্কি। তিনি চান, সেনাবাহিনী এ নিক দায়িত্ব স্বচ্ছ উপায়ে, এবং দেশজুড়ে ভর্তির প্রচেষ্টা চালাক যেকোনো উপায়ে।
৪০ বা তদুর্ধ্ব বয়সের লোকদের এখন যুদ্ধে পাঠানোর পায়তাঁরা চলছে বলে শোনা যাচ্ছে। যুদ্ধের ময়দানে অনেক বয়স্ক সেনাদের দেখাও যাচ্ছে।
জনশক্তির তলানি ছেঁকে ইউক্রেন যদি এভাবে যথেষ্ট সদস্য যোগাড় করতেও পারে, তাতেও লাভ হবে না। কারণ, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণহীন এ সেনারা বোঝাই হবে। এই সেনারা হয়তো লড়তেও চাইবে না।
অনিচ্ছুক সদস্য নিয়ে মহাবিপদে পড়বেন ইউক্রেনের অফিসার ও নন-কমিশনড অফিসাররা (এনসিও)। নতুন সেনাদের তাদের শুধু তাগাদাই দিতে হবে না, একইসাথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে নামতে রাজি করাতে হবে।
ভবিষ্যতের কথা দূরে থাক, ইউক্রেনের কিছু সেনাদল আত্মঘাতী মিশনে যেতে রাজি হচ্ছে না, এমন খবরও বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে।
এপর্যন্ত রণাঙ্গনের সব সেক্টরে সক্রিয় প্রতিরোধই হচ্ছে রাশিয়ার কৌশল। একমাত্র ব্যক্তিক্রম খারকিভ অঞ্চল, রুশ সেনারা সেখানে দ্রুত অগ্রসর হয়ে খুব শিগগিরই কুপিয়ানস্ক শহরে হামলা চালাবে। কুপিয়ানস্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে হাব, উত্তরপূর্বাঞ্চলের যুদ্ধক্ষেত্রে গোলাবারুদ ও রসদ সরবরাহে যার নিয়ন্ত্রণ ইউক্রেনের দরকার। অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে শহরটির পতন হতে পারে।
রাশিয়া জানিয়েছে, তারা আক্রমণ অভিযান শুরু করেনি, কিন্তু তার প্রস্তুতি নিচ্ছে। উত্তরপূর্বাঞ্চলে এরমধ্যেই এক লাখ সেনা জড়ো করেছে। সরঞ্জামবাহী যানবহরও দেখা গেছে রণাঙ্গন থেকে পাওয়া ভিডিওতে। সুতরাং, বলাই যায় প্রস্তুতি জোরেশোরে চলছে। তবে রাশিয়া কোথায় আঘাত হানবে তা পুরোপুরি নিশ্চিত নয়।
কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করছেন, রাশিয়া ইউক্রেনের দ্বিতীয় বড় শহর- খারকিভকে লক্ষ্যবস্তু করবে। তবে অন্য উপায়ও আছে রুশদের। যেমন ইউক্রেনের অভিযান থিতিয়ে পড়লে– তারা উত্তর ও দক্ষিণ দুই দিক থেকে ইউক্রেনীয় বাহিনীকে ঘেরাও করে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করতে পারে। এতে ভয়ানক বিপদে পড়বে দেশটি, এমনকী অস্তিত্ব সংকটও দেখা দেবে।
মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনের সর্ব-সাধারণের জন্য প্রকাশিত সংস্করণে– সামনের দিনগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আভাস নেই। তবে গোপনীয় সংস্করণে নিশ্চয়ই আরো রুঢ় বাস্তবতা আছে। এর মাধ্যমে গোয়েন্দারা হোয়াইট হাউস ও জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদকে কী বার্তা দিচ্ছেন? তাদের কথায় কি নীতিনির্ধারকরা এবার কান দেবেন?
মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের ইউক্রেন-সমর্থক ককাসের কো-চেয়ার অ্যান্ডি হ্যারিস এই উপসংহারে পৌঁছেছেন, যে ইউক্রেন যুদ্ধে জেতা সম্ভব নয়। অন্যান্য অনেকের মতো তিনিও খুব সম্ভবত অচলাবস্থার কথাই বলেছেন। কিন্তু, রাশিয়া এই সংঘাতের ইতি টানা না পর্যন্ত থামবে বলে মনে হয় না।
ইউক্রেনের মতো রাশিয়ার জনবলের ঘাটতি নেই, তাদের সমরাস্ত্র শিল্প দিনরাত এক করে উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধ অব্যাহত রাখার যথেষ্ট সরঞ্জাম তারা উৎপাদন করছে বলেও দেখা যাচ্ছে। বিপরীত অবস্থা কিন্তু ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের। দক্ষ কর্মীর গুরুতর স্বল্পতার পাশাপাশি – সরবরাহ ব্যবস্থার বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছে তারা।
যেমন যুক্তরাষ্ট্রের একটি শীর্ষস্থানীয় সমরাস্ত্র নির্মাতা রেথিওন স্বীকার করেছে যে, চীন থেকে অপরিহার্য কিছু সরবরাহ পাওয়ার ওপর নির্ভরশীল তারা। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে টানাপোড়েনের কারণে চীন হয়তো আগামীতে এই সরবরাহ বন্ধ করে দেবে।
এদিকে ইউক্রেনের জন্য আরো ২০.৬ বিলিয়ন ডলার চান প্রেসিডেন্ট বাইডেন। কিন্তু, এই প্রস্তাবে কংগ্রেসের অনুমোদন দরকার। নিশ্চিত হারের পেছনে কংগ্রেস এ মুহূর্তে এত বড় অংকের টাকা ঢালবে কি-না তাও অনিশ্চিত।
বাইডেন পুনর্নিবাচিত হওয়ার আগপর্যন্ত যুদ্ধকে জিইয়ে রাখতে চায় বর্তমান মার্কিন প্রশাসন। অচলাবস্থা ধরে রাখার এই চেষ্টা যেন নিঃসঙ্গ বনে আগুন জ্বালিয়ে বন্যপশুর থাবা থেকে বাঁচার চেষ্টা। কিন্তু, আবহাওয়া বৈরি হলে- এক সময় দমকা হাওয়া বয়, তারপর বৃষ্টিও আসে। আগুন নিভলেই নামে আধার, ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে শ্বাপদ। তাই দরকার হয় নিরাপত্তার দেওয়াল। মস্কোর সাথে আলোচনার মাধ্যেমে যুদ্ধের ইতি টানার উদ্যোগ হতো সেই দেওয়াল। এরপরেও, রাশিয়ার সাথে আলোচনায় বসতে ওয়াশিংটনে কারো মধ্যে ন্যূনতম আগ্রহই দেখা যাচ্ছে না।