মুর্তজা বশীরের মূর্ত-বিমূর্ত নারীরা
শৈশবের কথা
মনে নেই
শুনেছি দু' চোখ ভ'রে পৃথিবীর আলো
দেখবার আগেই আমার
হাত, এসেছিল
গর্ভবাস থেকে
অন্ধকারের কাজল মুছে দিয়ে স্পর্শমনির
খোঁজে,
বাইরে বেরিয়ে।
—'অস্তাচলে চাঁদ', ১৯৯২, 'সাদায় এলিজি', মুর্তজা বশীর
জন্মের আগেই তিনি পৃথিবীর আলো-হাওয়ার স্পর্শ পেয়েছিলেন। গর্ভবাস থেকে বেরিয়ে এসেছিল তাঁর হাত। মা মরগুবা খাতুন দুই দিন দুই রাত দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁকে পৃথিবী দেখাবেন বলে। নারীর ত্যাগ, মায়ের অকৃত্রিম ভালোবাসা আর জন্মের আগেই পৃথিবী দেখার অপর মানে নারীর জগতের সঙ্গে তাঁর সহজাত আবেগের জৈবিক বন্ধন সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল।
মুর্তজা বশীরের সৃষ্টিশীল জীবনের শেষ পর্বও সেই নারীর বর্ণিলতা এক বিশেষ অভিজ্ঞতা। সৃষ্টি করা আর সৃষ্টিশীল জীবনকে উদ্যাপনের যোগসূত্রই সৃষ্টিকে নানা সময় নানা মাত্র দেয়—কখনো কখনো পায় নানা অনুভূতির আখ্যান। 'তোমাকেই শুধু' কবিতার বইতে ১৯৭৮ সালের ২২ মার্চ মুর্তজা বশীর লিখছেন, 'সময়ের শীতল বরফ গলে গলে নদী হয়/ তোমার উত্তাপে'। কবিতার এই তুমি, এই নারীর প্রতি এ গভীর ভালোবাসা তাঁর জীবনের বিভিন্ন পর্বে বিভিন্ন রকম। কখনো তিনি শুধু জীবন দেখেছেন। কখনো দেখেছেন রং আর রেখা। কখনো দেখেছেন অবয়ব। কখনো চোখের ভাষায় 'পৃথিবী' আবিষ্কার করেছেন।
১৯৭৪ সালের ৩ মে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় 'শিল্পী মুর্তজা বশীর ও বাংলাদেশের রমণী' শীর্ষক সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন, '...অবচেতন মনে সব সময় জৈবিক আকাক্সক্ষা কাজ করে। মেয়েদের সৌন্দর্য সে আকাক্সক্ষা জাগিয়ে তোলে। এটা একধরনের জৈবিক তৃপ্তি।' মেয়ে বা নারীদের ছবি এঁকে তৃপ্তি না পাওয়া এ শিল্পী নারী ও পুরুষের তুলনা করতে গিয়ে বলেছেন, 'মেয়েরা ফর্ম হিসেবে অনুপ্রাণিত করার চেয়ে বেশি করে তারা রমণী বলে। পুরুষও সুন্দর হয়। বতিচেল্লির ভেনাসের চেয়ে মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর ডেভিড কোনো অংশে কম সুন্দর নয়। আসলে শিল্পীদের মেয়েরা আকর্ষণ করে মেয়ে বলে। জৈবিক কারণে। ছন্দ, ভঙ্গি, রেখা এসব বাজে কথা।' অনেকটা পুরুষতান্ত্রিক ভাবনা হয়তো এ কথার ভিত্তি। কিন্তু সৃষ্টি করা যে জৈবিক বিষয়—চিরকালের। মুর্তজা বশীরের আঁকা নারী চিত্রমালায় সেই চিরকালের অনুভূতি আছে ইতিহাস-ঐতিহ্য-বাস্তবতা-স্থান-সময়ের সঙ্গে ঐকান্তিকভাবে মিলেমিশে।
'জয়নুল স্কুল'-এর শিক্ষার্থী মুর্তজা বশীর শিল্পশিক্ষা পর্বে বাঙালি নারীর সহজাত রূপ আঁকতে মনোযোগী ছিলেন। একধরনের রোমান্টিকতা সেই সব সৃষ্টির প্রাণ। কপালে টিপ আর শাড়ি পরিহিত সেই সব চিত্রমালা বাঙালি নারীর চিরায়ত ধারণাকেই উল্লেখ করে। শিল্পশিক্ষা পর্ব শেষে মুর্তজা বশীর নিজেকে উপস্থাপন করলেন আরেক মাত্রায়। তিনি বলছেন, 'আমার ছবি আমার ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশ। বলতে গেলে আত্মজীবনীর একেকটি পাতা।' অবশ্য ইতালিতে শিক্ষাগ্রহণে যাওয়ার আগপর্যন্ত তাঁর আঁকা রমণীরা সাধারণ বাঙালি। যদিও ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে তাঁর অর্জিত উপলব্ধি ও অঙ্গীকার থেকে আঁকলেন হাসপাতালের বিছানায় থাকা কিষাননেত্রী ইলা মিত্র। নাম দিলেন 'Waiting for tomorrow'. সাদা রঙে বলিষ্ঠ ও নানাভাবে সোজা রেখার ব্যবহারে আঁকা সেই পেইন্টিং এমন এক প্রত্যয়ের ধারণাকে সমর্থন করে, যা শুধু সমসাময়িক নয়—সব সময়ের। যদিও চিত্রকর্মটির এখন আর বাস্তব উপস্থিতি নেই। এ সময়ের আরেকটি চিত্রকর্ম ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ছবিটি ছিল একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীকে নিয়ে। সেই সময়ে আলোচিত এই চিত্রকর্ম সম্পর্কে শিল্পী বলেছেন এভাবে, 'সামনের দিকে তার শরীর কিন্তু চেহারা ছিল প্রোফাইলে এবং হাতটা অনাগত শিশুকে মমতা মাখিয়ে স্পর্শ করছে। একজন ২১-২২ বছরের যুবক কী করে একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীর যন্ত্রণা ও স্বপ্ন চিত্রিত করতে পারে, তা ছিল বিস্ময়ের ব্যাপার।' মুর্তজা বশীর এ পর্বে ভারতের প্রখ্যাত শিল্পী পরিতোষ সেনের কাজ দেখে অভিভূত হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, 'আমার মনে হলো, যা আমি বলতে চাচ্ছি, তা একমাত্র পরিতোষ সেনের কাছ থেকেই আমার পক্ষে নেওয়া সম্ভব।' প্যালেট নাইফ ব্যবহার করে রঙের সীমিত ব্যবহারে, সরল ফর্মে আর ফ্ল্যাট সারফেস তৈরি করে উল্লিখিত ছবি এঁকেছিলেন মুর্তজা বশীর।
১৯৫৬ সালে মুর্তজা বশীর শিক্ষাগ্রহণ করতে গেলেন ইতালির ফ্লোরেন্সে। শিল্পীর ভাষায়, 'ইতালি প্রবাসকালে সেখানকার সাধারণ মানুষের জীবনের দুঃখ এবং জীবনযাত্রা ছিল আমার বিষয়বস্তু।' এ পর্ব সম্পর্কে তিনি আরও বলছেন, 'ফ্লোরেন্স শহরের সাধারণ মানুষ বা রাস্তার ধারে কোনো রমণী বসে লেবু বিক্রি করছে কিংবা একজন অসহায় অন্ধ রমণী তার পাশে ছোট্ট এক বালিকাকে নিয়ে ভিক্ষে করছে বা কোনো দরিদ্র ব্যক্তি অ্যাকোর্ডিয়ান বাজিয়ে ভিক্ষে করছে। এই ছবিগুলোর বিষয়বস্তু আমার ইতালি আসার আগে ঢাকায় আঁকা ছবির বিষয়বস্তুর মতো সাধারণ মানুষ। তা ছাড়া ইতালিতে বাংলাদেশের ওপর ভিত্তি করে কিছু ছবি আঁকি। যেমন কলসি কাঁখে রমণী। কলসি কাঁখে রমণী ছিল ঢাকা শহরে দেখা জীবিকার জন্য যে রমণীরা রাস্তার কল থেকে কলসি দিয়ে পানি নিয়ে দোকানে বা বাড়িতে নিয়ে যেত। তাদের কোমরে একটি কাপড় গোঁজা থাকত। যেন পরিধানের শাড়ি ভিজে না যায়। এ রকম ধরনের ছবি ইতালিতে থাকাকালীন আঁকি। তবে আঙ্গিকের দিক থেকে একটা পরিবর্তন আসে।' কী সেই পরিবর্তন?
ইউরোপীয় প্রাক্-রেনেসাঁর শিল্পী জত্তো, সিমাব্যু, দুচ্চো, ফ্রা অ্যাঞ্জেলিকোর চিত্রকর্মের অঙ্কনশৈলী থেকে প্রভাবিত হন মুর্তজা বশীর। বাইজেনটাইনের শিল্পকর্ম তাঁকে করে অনুপ্রাণিত। এ ছাড়া ইট্রুসকান আমলের ব্রোঞ্জ আয়নার গায়ে আঁকা রেখা আর গ্রিক অ্যাম্ফেরা পাত্রের গায়ে খোদাই করা চিত্রমালা মুর্তজা বশীরের আঁকা রেখায় পায় চূড়ান্ত রূপ। ইতালি পর্বে আমরা সেই সাবলীল একক রেখার উদ্ভাসন দেখতে শুরু করি। ফ্লোরেন্সে একাডেমিয়া দি বেল্লির শিক্ষার্থী হিসেবে ১৯৫৬ সালে প্রথম ন্যুড নারী আঁকলেন মুর্তজা বশীর। মিরাজুল ইসলামের লেখা 'নার্সিসাসে প্রজাপতি: মুর্তজা বশীরের জীবনালেখ্য' থেকে জানা যায়, 'মুর্তজা বশীর আজ অবধি তাঁর সমগ্র শিল্পী জীবনে মূর্ত-বিমূর্ত ফিগারেটিভ, নন-ফিগারেটিভ ফর্মে কয়েক শত ছবি এঁকেছেন। কিন্তু চিত্রকলার অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয় হিসেবে ন্যুড এঁকেছেন সেই তুলনায় খুব কম। যা এঁকেছিলেন, তার প্রায় সব ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত ইতালিতে আঁকা।'
১৯৫৯ সালে মুর্তজা বশীর তেলরঙে আঁকলেন তাঁর সৃষ্টিশীল জগতের এক বিখ্যাত চিত্রকর্ম 'দুই প্রেমিকার জন্য সঙ্গীত'। স্প্যানিশ কবি ফেদরিকো গার্সিয়া লোরকা থেকে অনুপ্রাণিত এ চিত্রকর্ম তিনি চিত্রকলরা আঙ্গিকগত ইতিহাসের নিরিখে এক ধরনের 'নতুন' চিন্তাকে সামনে নিয়ে আসলেন। তাঁর ভাষায়, 'একটা জিনিস তখন অনুভব করলাম, আমরা ব্যাকগ্রাউন্ড বলতে যা বুঝি, সেটি আমার কাছে নতুনভাবে দেখা দিল। আমরা সাধারণত দেয়ালে একটি জানালা আছে, জানালার ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে। আমার কাছে মনে হলো, এটা যেমন সত্য, তেমনি একটি জানালা, তার সামনে একটি চেয়ার, সেখানে একটি লোক বসে আছে—এটাও সত্য। অর্থাৎ দুভাবেই আমি এটাকে বলতে পারি। তখন আমার মনে হলো—তথাকথিত ব্যাকগ্রাউন্ড বলে কোনো কিছু নেই। সবকিছুই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একটি চেয়ারের ওপর একটি লোক বসে রয়েছে। তার পেছনের জানালা যেমন সত্য, তেমনি জানালার সামনে একজন বসে আছে, এটাও সত্য। তখন এই ধারণাটি বোঝাবার জন্য যে রং, সে রংটি চিত্রে আমি রেখা দ্বারা ফুটিয়ে তুলতাম। অর্থাৎ সামনে যে মানুষটি, তার পেছনে যদি চেয়ার থাকে, সেই চেয়ারের হলুদ রং আমি মানুষটির শরীরের ওপর দিয়ে এঁকে ফেলতাম। তবে ১৯৫৮ সালে ইতালিতে যে কাজগুলো করলাম, সেখানে সেই রেখাগুলোকে বাদ দিয়ে আলো-ছায়ার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করলাম। ফলে সবকিছু ট্রান্সপারেন্ট হয়ে গেল। সেই কাজগুলোকে আমি তখন বললাম, ট্রান্সপারেন্সিজিম।'
মুর্তজা বশীরের ফ্লোরেন্স-লন্ডন থেকে শুরু হওয়া ট্রান্সপারেন্সিজিম পর্বটি ঢাকা-করাচিতে বেশি দিন স্থায়ী হলো না। দেশ কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা নয়—এটা মেজাজে, রক্তে বিশ^াসী মুর্তজা বশীর ১৯৬০-৬১ সালে লাহোরে থাকাকালীন তাঁর আঁকা রমণীরা ছবিতে এসেছে একটা অস্থিরতা এবং জ¦ালা থেকে। এ সময় সম্পর্কে তিনি বলছেন, 'সে সময় আমি লাহোরের পথে একা একা ঘুরতাম। দেয়ালে দেয়ালে এমন অসংখ্য মানুষের মুখ দেখতে পেতাম। ...ছবি আঁকতাম মাটিতে ক্যানভাস বিছিয়ে। ...আমি তখন ক্যানভাসে রং ফেলে নিজের খুশিমতো আঁকতাম। ...এককথায় আমার অবচেতনের চিন্তা, রেখা সব উঠে আসতে লাগল। আমি গভীরভাবে চেয়ে দেখলাম, সেখানে দেখা যাচ্ছে কোনো মুখ কিংবা কোনো মেয়ে বসে ফুল দেখছে।' নারীর সঙ্গে পাখি বিষয়বস্তু হিসেবে দেখা যায় তাঁর এ পর্বে। তবে এ পর্বের ১৯৬১ সালে আঁকা একটি গুরুত্বপূর্ণ চিত্রকর্ম হলো 'রমণী ও তক্ষক'। অনেকটা প্রকাশবাদী শৈলীতে আঁকা এ চিত্রকর্মে আদিমতা এসেছে রূপক অর্থে। নারীর সহজাত জটিল ক্ষমতা ও শক্তিই যেন হয়ে ওঠে বিশ^জীবনের নিয়ন্ত্রণকারী।
১৯৬২ সালে আমিনা বশীরকে বিয়ে করেন মুর্তজা বশীর। হুট করে বিয়ে করলেও জীবনকে তিনি দেখলেন নির্দিষ্ট এক ছকে। মুর্তজা বশীর মনে করলেন, 'জীবনটা অনেক গোছানো এবং প্রতিটি বস্তু সুশৃঙ্খল কাঠামোয় আবদ্ধ।' প্রথমবারের মতো ক্যানভাসে সোনালি ও রুপালি রঙে নারীর চেহারা, গাছ, বাড়ি, মুরগি—সবকিছু জ্যামিতিক বন্ধনে দ্রুত চালানো ব্রাশে আঁকলেন। ক্যানভাসে আঁকা সবকিছুকে দেখলেন স্থাপত্যিক কাঠামোতে। এরপর ধীরে ধীরে আঁকলেন দেয়াল, শহীদ শিরোনাম, জ্যোতি ইত্যাদি বিমূর্ত ধারণার গুরুত্বপূর্ণ চিত্রমালা।
১৯৮০ সালে একটি সেমিনারে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে জাপানের ফুকুওকাতে গিয়েছিলেন মুর্তজা বশীর। করমর্দনের বদলে এক জাপানি মেয়ে মাথা নত করে তাঁকে অভিবাদন জানালেন। এ অভিজ্ঞতা মুর্তজা বশীরের শরীরে যেন চাবুকাঘাত করল। এরপরই জানতে শুরু করলেন নিজেকে। ইউরোপীয় দীক্ষা নেওয়া এ শিল্পী উপমহাদেশের ইতিহাস জানতে শুরু করলেন। যার ধারবাহিকতায় ১৯৮৭ সালে বাংলার শিল্প সম্পর্কে জানতে ব্রিটেন গেলেন। ওই সময় তিনি আবার কালীঘাট ও পালযুগের চিত্রকলাসহ বাঙালির শিল্প ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণা করলেন। উল্লেখ্য, এ সময়েও বেশ কয়েকটি ন্যুড ড্রইং দেখতে পাওয়া যায়; যা একান্তভাবেই ইউরোপীয় শিল্প ঐতিহ্যেরই সম্প্রসারিত রূপ। পরবর্তী সময়ে ভারত সরকারের সহযোগিতায় তিনি দেশটির বিভিন্ন জাদুঘর পরিদর্শন করলেন এই একই বিষয় জানতে। টেরোকোটার ইতিহাস জানতে ভারতের পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন জেলার মন্দির দেখলেন। এসব ধারণার পরিশীলিত উদাহরণ পাওয়া যায় ১৯৮৯ সালে বিটিসির ক্যালেন্ডারের জন্য আঁকা বাংলা উপন্যাসের ১২ নারী চরিত্র। পাল যুগের চোখের আঁকা শৈলী, কালীঘাটের রেখা এবং প্রাক্-রেনেসাঁর চিত্রকর্মের সমতল বৈশিষ্ট্য, পাশ্চাত্যের রেখা আঁকার শিক্ষা—মুর্তজা বশীরের নারী আঁকার আরেক পর্বের সূচনা হলো। এ অধ্যায় তাঁর শিল্পজগৎ ভারতীয় শিল্প ঐতিহ্য থেকে উৎসারিত। এমনকি এই ঐতিহ্যের পরম্পরার সম্প্রসারণ মুর্তজা বশীরের এসব চিত্রমালা। মিশ্র ঐতিহ্য ও শৈলী থেকে অনুপ্রাণিত এ শিল্পী ২০০৩ সালে তাঁর জীবনসঙ্গীকে উপজীব্য করে আঁকলেন 'আমার গৃহকর্তী'। এ ছাড়া তাঁর জীবনসঙ্গীকে বিষয় করে বিভিন্ন সময়ে ১২টি রেখাচিত্র এঁকেছেন।
মুর্তজা বশীরের ভারতীয় ঐতিহ্য অনুগামী এ পর্বে নারীরা হলেন বাঙালি উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত নারী। কথাসাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই এ পর্বকে উল্লেখ করেছেন এভাবে, 'সেখানে রঙের ব্যবহারে পাল যুগের ঐতিহ্য অনুসরণ করলেন। বাইজেন্টীয় ভঙ্গিতে মুখের কনটুর সৃষ্টি করলেন রেখার পরিবর্তে রং দিয়ে। কিন্তু সমতলে মসৃণতা থাকল প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে। ফিগারে নারীমূর্তিও চোখের নিচে ছিল কালো রেখা, লোকজ ঐতিহ্যেও অনুসরণে চোখ ছিল আয়ত এবং প্রসারিত। বসা বা দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে ছিল ধ্রুপদ মেজাজ। কিন্তু ড্রইংয়ে ছিল একাডেমিক পদ্ধতির অনুসরণ। ...সব মিলিয়ে এই সব ছবিতে একটি নতুন শৈলীর সন্ধান করেছেন বশীর, যেখানে লোকজ ঐতিহ্যেও সঙ্গে প্রতীচ্যের শিল্পকলারীতির মেলবন্ধন হতে পারে।' এ পর্বের চিত্রমালার উল্লেখ্যযোগ্য চিত্রকর্ম হলো 'ডুরে শাড়ি পরিহিতা নারী'। তবে মুর্তজা বশীরের এ পর্বের চিত্রমালা উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, তাঁর আঁকা 'চোখ'। অনেকটা সেই প্রবাদের মতো—'চোখ কথা বলে'। বিভিন্ন পর্বে তাঁর শুধু রেখায় আঁকা নারীর মুখ-শরীরে সবকিছু অতিক্রম করে চোখই হয়ে ওঠে স্পষ্টভাবে আকর্ষণের বিষয়। মুর্তজা বশীরের গত শতকের নব্বইয়ের দশকে আঁকা এসব নারীচিত্রমালা এমন নারীদের কথা বলেছেন—যারা অনেক স্বচ্ছন্দপূর্ণ জীবন অতিবাহিত করেও এক অতৃপ্তি ও বিষাদের ভাষা চোখে ভেসে উঠেছে। নারীর সঙ্গে কি শুধু বেদনাবোধের সম্পর্ক ছিল মুর্তজা বশীরের? হয়তো বিভিন্ন সত্তা, বিচিত্র অভিজ্ঞতা আর নানা অনুভূতি মিলেমিশে তিনি নারী আঁকতে সচেতন ছিলেন। আসলে মানুষের জীবন—বিশেষত নারীর জীবন কোনো একক লক্ষ্যে স্থির নয়। নানা আয়োজনের মধ্যে চলমানতায় থাকে মানুষের মানে নারীর পূর্ণতা—এ ধারণাই হয়তো সত্য-অবিনশ^র।
২০১৩ সালে অসুস্থতার কারণে মুর্তজা বশীরের জীবনযাপন হয়ে গেল সীমাবদ্ধ। তেলরঙে ছবি আঁকার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ ছিল। তাই মাধ্যম হিসেবে বেছে নিলেন ওয়েল প্যাস্টেল। কাগজ ও ক্যানভাসে ঘষে ঘষে তল তৈরি করে বিভিন্ন স্তরের বর্ণিল রঙে আঁকলেন নারীর নানা মুখ। তবে তিনি এ পর্বে ঠিকই নজর দিলেন চোখের দিকে। বিশেষত কালীঘাটে থাকা চোখ এবারও প্রবলভাবে থাকল। যদিও তাঁর আঁকা নারীদের সেসব চোখ নানা ধরনের কথা বলে; যা শুধু অনুভব করেই নিতে হয়। গ্যালারি কায়ায় মুর্তজা বশীরের এ পর্বের আঁকা চিত্রমালার একক প্রদর্শনী হয় ২০১৪ সালে।
জীবনের শেষ পর্বে এসে মুর্তজা বশীর ফিরলেন পেছনের দিকে। অর্থাৎ তাঁর সৃষ্টিজগতের কিছুটা প্রারম্ভিক পর্বে। ২০১৭-১৮ সালে কাগজে আঁকলেন জ্যামিতিক কাঠামোতে ওয়েল প্যাস্টেলে ঘষতে ঘষতে বিচিত্র রঙের তল ও স্তরে চেনা-অচেনা নারীর মুখ। নারীর শরীর, মুখ, চোখকে বিভিন্ন কাঠামোতে নির্মাণ করা—স্তনকে প্রতীকায়িতভাবে কিংবা সরল গোলাকার ইঙ্গিতে আঁকা এ পর্বের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তবে কিউবিজম বা জ্যামিতিক ধারণার মধ্যেও সাবলীলভাবে পরিসরের প্রতিটি অংশের রঙে-ফর্মে-রেখায় সাবলীল বিচরণ মুর্তজা বশীর নিজের চিহ্নকে শনাক্ত করলেন। অনবদ্য হয়ে থাকল তাঁর শিল্পজীবনের এই পর্যায়।
মুর্তজা বশীরের আঁকা নারী নির্বাচিত নির্দিষ্ট পরিসরে আছে পুরো অংশজুড়েই। ইটের টুকরায় রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে ১৯৭৪ সালে তাঁর করা 'অক্ষয় বট' ম্যুরালটিতে থাকা হাত মেলে ধরা নারী যেভাবে চারপাশের নানা উপাদানকে একত্র করেছে, তা নারী নিয়ে ভাবনাকে করে সম্প্রসারিত। আসলে নারী কিংবা পুরুষ তাঁর আঁকা পুরো পরিসরজুড়ে দৃঢ়ভাবে চরিত্রটির অস্তিত্বকেই দৃঢ়ভাবে প্রতীয়মান করে। নারীর ভেতর দিয়ে তাই হয়তো মুর্তজা বশীর মানবসভ্যতার জৈবিক ইতিহাসই রচনা করছেন। সৃষ্টি-শিল্প-সৃজনশীলতা-নন্দনবোধ জৈবিক প্রাণে হয়েছে সমৃদ্ধ। এটাই মুর্তজা বশীরের অনন্য অবদান।