খাদ্য বর্জ্য থেকে জৈব সার: সম্ভাবনা থাকলেও যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাব চট্টগ্রাম কম্পোস্ট প্ল্যান্টে
চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর এলাকার আনন্দবাজারের বর্জ্যাগারে প্রতিদিন একটি ট্রাকে করে খাদ্য বর্জ্য এনে ফেলা হয়। ধারাল বা শক্ত বর্জ্য সরিয়ে খাদ্য বর্জ্যগুলো পুরে দেওয়া হয় ডাম্পিং ট্যাংকে। দেড় মাস লাগে এসব বর্জ্য শুকাতে। এরপর তা কাটার মেশিনে ভেঙে প্যাকেট করা হয়। এমন প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হয় প্রাকৃতিক জৈব সার।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) এই প্ল্যান্টটি ছোট হলেও এর বহুমাত্রিক ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে।
খাদ্য বর্জ্য থেকে জৈব সার উৎপাদন একদিকে যেমন পরিবেশ দূষণ কমায়, অন্যদিকে তা পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে বর্জ্যের ভূমিতে চাপও কমাচ্ছে। অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তো রয়েছেই। তবুও গত দেড় যুগে যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি উদ্যোগটি। নানান প্রতিবন্ধকতার মুখে পরিসর বাড়ার পরিবর্তে উল্টো কমেছে।
সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, ২০০৫ সালে ইউনিসেফের সহায়তায় বর্জ্য থেকে সার তৈরির প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছিল। বর্জ্যাগারের পাশে একটি শেডে ৩২টি ট্যাংক স্থাপন করা হয়েছে। এখানে খাদ্য বর্জ্যগুলো শুকানো হয়। দৈনিক সর্বোচ্চ ৩ টন সার উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে দৈনিক ৩০০-৫০০ কেজি সার উৎপাদন হয়। মাসে মাত্র এক থেকে দেড় টন সার উৎপাদন হয়। সিটি জৈব সার নামে ১, ২,৫,২০ ও ২৫ কেজি প্যাকেটে এ সার বিক্রি করা হয়।
প্ল্যান্টের কর্মকর্তারা জানান, লোকবল কম থাকায় উৎপাদন কার্যক্রম সংকুচিত হয়ে আসছে দিনদিন। গড়ে ওঠেনি যথাযথ বিপণন ব্যবস্থাপনাও। ফলে দেড় যুগেও ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিতি পায়নি এই সার। বর্তমানে দৈনিক একটি ট্রাকে করে কাঁচাবাজার ও ইপিজেডের বিভিন্ন খাবার হোটেল থেকে খাদ্য বর্জ্য আনা হয় প্ল্যান্টে। তা প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এ কাজে নিয়োজিত আছেন মাত্র ছয়জন মানুষ।
প্ল্যান্ট তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা চসিকের যান্ত্রিক বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. আনু মিয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমাদের উৎপাদিত সার একেবারে নির্ভেজাল। স্বল্প পরিসরে উৎপাদন চলছে। প্রতি কেজি সার মাত্র ১০ টাকায় বিক্রি হয়। বাজারে সারের দাম অনেক বেশি। অথচ বাজারের সারের চেয়ে মানও ভালো। সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে সম্ভাবনাময় একটি প্রকল্প হতে পারে এটি।"
তিনি আরো বলেন, "প্ল্যান্টে আনা বর্জ্যগুলো সলিড হতে হয়। এজন্য সংগ্রহের সময় ধারাল বা শক্ত বর্জ্য আলাদা করতে হয়। এছাড়া বর্জ্যগুলো আনার পর তা খোলা স্থানে ছড়িয়ে আবার শক্ত বর্জ্য আলাদা করা হয়। পরিসর বাড়াতে লোকবলের প্রয়োজন।"
মূলত জমির উর্বরতা বাড়াতে জৈব সার ব্যবহার করা হয়। সরকারের কৃষি নীতিও প্রাকৃতিক সার ব্যবহারে উৎসাহিত করছে। কারণ জৈব সারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। বাজারে ৩৮টি কোম্পানির জৈব সার রয়েছে। যার কেজিপ্রতি পাইকারি দাম ৩০-৪০ টাকা। আর খুচরায় বিক্রি হয় ৪৫-৬০ টাকা।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও জৈব কৃষি গবেষক ড. মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, ১৩ হাজার বছরের কৃষির ইতিহাসে মাটির জৈব পর্দাথ কমেছে ৩.৫ শতাংশ। শুধু গত ৫০-৬০ বছরে কমেছে ২.৫ শতাংশ। জমিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার বাড়ায় এমন পরিস্থিতি। এজন্য সরকার জৈব সার ব্যবহারে গুরুত্ব দিচ্ছে।
জৈব সারের বর্তমান পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, "বর্তমানে ৮.৯ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ রয়েছে, ধান ছাড়া অন্যান্য ফসল চাষে প্রতি হেক্টর জমিতে গড়ে ৩ টন জৈব সার ব্যবহার। ধানের জমি, বাগান হিসেব করলেও জৈব সারের বাৎসরিক চাহিদা দাঁড়ায় ১৮-১৯ মিলিয়ন টন। দেশে ৩৮টি নিবন্ধিত কোম্পানি ছাড়াও দেড় শতাধিক অনিবন্ধিত উদ্যোক্তা আছেন। সবমিলে উৎপাদন সক্ষমতা ১২-১৫ মিলিয়ন টন।"
"জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হলে সংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য সার উৎপাদনের প্রকল্পগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে," মনে করেন ড. মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন।
পুনর্ব্যবহারে কমবে পরিবেশ দূষণ
ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনইপি) এবং যুক্তরাজ্য ভিত্তিক সংস্থা ডব্লিউআরএপি-এর ২০২১ সালের 'ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্স রিপোর্ট' থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশিরা বছরে গড়ে ৬৫ কেজি খাবার অপচয় করে যা রাশিয়া (৩৩ কেজি), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (৫৯ কেজি) এবং আয়ারল্যান্ডের (৫৫ কেজি) মতো ধনী দেশগুলোকেও ছাড়িয়ে গেছে। এছাড়াও বাংলাদেশে গৃহস্থালির খাবারের বর্জ্য বার্ষিক ১০.৬২ মিলিয়ন টনে পৌঁছেছে।
গবেষকরা বলছেন, সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে না ওঠায় দিনদিন বর্জ্যের স্তুপ উঁচু হচ্ছে। ফলে ভূমির ব্যবহারের পাশাপাশি পরিবেশ দূষণও বাড়ছে। বর্জ্যকে পুনর্ব্যবহার করতে পারলে চাপ কিছুটা হলেও কমবে।
চলতি বছরের শুরুতে জাপানি পরামর্শক সংস্থা জেএফই ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন এবং ইয়াকিয়ো ইঞ্জিনিয়ারিং কোং লিমিটেডের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক সেমিনারে বলা হয়, চট্টগ্রাম শহরে প্রতিদিন প্রায় ২,১০০ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার ৬৮% খাদ্য বর্জ্য। এসব খাদ্য বর্জ্য পচে পরিবেশে মিথেন ছড়ায়। এরফলে বায়ুমণ্ডলে উষ্ণতা বাড়ে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন টিবিএসকে বলেন, "খাদ্য উৎপাদনে মাটির পুষ্টিগুণ ক্ষয় হয়। খাদ্য বর্জ্যকে জৈব সারে রূপান্তর করে মাটিতে ব্যবহার করা গেলে পুষ্টিগুণ অপচয় হবে না। অন্যথায় খাদ্য বর্জ্য ডাম্পিং করা হলে তা নষ্ট হবে। বর্জ্যের সঙ্গে সাগরে গিয়ে পড়বে। আর মাটির পুষ্টিগুণ-উৎপাদনের সার্কেল বন্ধ হচ্ছে। ফলে মাটির পুষ্টিগুণের জন্য আমদানিকৃত অন্য সার ব্যবহার করতে হচ্ছে। এটি হল খাদ্য বর্জ্য কাজে না লাগানোর একদিকের ক্ষতি। অন্যদিকে খাদ্য বর্জ্য পচে পরিবেশে মিথেন ছড়ায়, যা বায়ুমন্ডলে উষ্ণায়নের জন্য বেশি দায়ী।"
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মুহাম্মদ আবুল হাশেম টিবিএসকে বলেন, "২০১৯-২০ সালের দিকে একটি প্রস্তাব এসেছিল। প্রাকৃতিক কৃষি নিয়ে কাজ করে, এমন একটি গ্রুপ পুরো প্ল্যান্টটি আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে পরিচালনা করতে চেয়েছিল। কিন্তু যান্ত্রিক বিভাগের তৎকালীন প্রধান দ্বিমত করায় আর বাস্তবায়ন হয়নি।"
"তবে এখন আসলেই এটি নিয়ে চিন্তা করার সময় এসেছে। সম্ভবনাময় একটি উদ্যোগ এটি। কীভাবে উৎপাদন বাড়ানো যায়, তা নিয়ে চিন্তা করা হবে।"