প্রিগোজিনকে বহনকারী বিমানে মিসাইল নিক্ষেপের প্রমাণ পায়নি যুক্তরাষ্ট্র
গত বুধবার মস্কোর উত্তরে তেভর অঞ্চলে একটি প্রাইভেট জেট বিধ্বস্ত হয়ে বিমানটিতে থাকা ১০ জনের সকলেই নিহত হয়েছেন। দেশটির অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ রোজাভিয়াসিয়ার তথ্যমতে, ঐ বিমানে থাকা যাত্রী তালিকায় ওয়াগনার বস ইয়েভগিনি প্রিগোজিনের নামও ছিল।
এবার বিমানটি বিধ্বস্তের ঘটনায় মুখ খুলেছে মস্কোর প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির ধারণা, ওয়াগনার বস প্রিগোজিনকে সম্ভবত বিমান বিধ্বস্ত করে হত্যা করা হয়েছে।
গতকাল (বৃহস্পতিবার) পেন্টাগনের মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল প্যাট্রিক রাইডার এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, "আমরা কীভাবে তথ্য সংগ্রহ করেছি, সে বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে যাচ্ছি না। তবে আমাদের প্রাথমিক মূল্যায়ন, বিভিন্ন কারণের উপর ভিত্তি করে সম্ভবত তাকে হত্যা করা হয়েছে।"
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল প্যাট্রিক রাইডার জানান, পেন্টাগনের কাছে এখন পর্যন্ত এমন কোনো তথ্য নেই যে, বিমানটি সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল দ্বারা গুলি করে ভূপাতিত করা হয়েছে।
অন্যদিকে গতকাল (বৃহস্পতিবার) দিনের শুরুতেই চার মার্কিন কর্মকর্তা সিএনএনকে জানিয়েছিল, বিমানটি মিসাইলের আঘাতে ভূপাতিত করার কোনো ইঙ্গিত তারা পায়নি।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এখনও বিমানটি বিধ্বস্তের কারণ নির্ণয়ে তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। কর্মকর্তারা মনে করেন, এত দ্রুত কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো ঠিক হবে না। সকল সম্ভাবনাকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে, যার মধ্যে একটি হচ্ছে অন-বোর্ড বিস্ফোরণ।
ওয়াগনার সংশ্লিষ্ট টেলিগ্রাম চ্যানেল গ্রে জোনের দাবি, বিধ্বস্ত বিমানটি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করে ভূপাতিত করা হয়েছে। তবে পশ্চিমা গোয়েন্দাদের সাথে সংশ্লিষ্ট আরেকটি সূত্র মার্কিন কর্মকর্তাদের সাথে সুর মিলিয়ে বলেছেন, মিসাইল উৎক্ষেপণ করে বিমানটি ভূপাতিত করার কোনো ইঙ্গিত তারা পায়নি।
কর্মকর্তারা জানান, এমব্রেয়ার লিগ্যাসি ৬০০ বিমানটিতে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কর্তৃক ভূমি থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপে আঘাত করা হয়েছিল, এমন কোনো তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নেই। এছাড়াও বিমানটিতে রাশিয়ার ফাইটার জেট থেকে 'এয়ার টু এয়ার' মিসাইল দ্বারা ভূপাতিত করা হয়েছে এমন ইঙ্গিতও পায়নি যুক্তরাষ্ট্র।
অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, "বিমানটি বিধ্বস্তের ঘটনায় প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছে সেটা জানি না। কিন্তু আমি এতে মোটেই বিস্মিত নই। রাশিয়ায় এমন কম জিনিসই ঘটে, যার পেছনে পুতিনের সংশ্লিষ্টতা নেই।"
অন্যদিকে রাশিয়ার তদন্ত কমিটি গত বুধবার জানায়, বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় তারা একটি ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে। মামলায় যাত্রী তালিকায় প্রিগোজিনের নাম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
ফ্লাইটরাডার২৪ এর ফ্লাইট ট্র্যাকিং ডেটা থেকে জানা যায়, বিমানটি উড্ডয়নের ৩০ মিনিটেরর মধ্যেই বিধ্বস্তের ঘটনাটি ঘটে। বিমানটি প্রায় ২৮০০ ফুট উচ্চতায় থাকা অবস্থায় হঠাৎ অনিয়মিত আরোহণ এবং অবতরণ শুরু করে। স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬:১৯ মিনিটে প্রাইভেট জেটটির উচ্চতা সম্পর্কিত ডেটা প্রেরণ বন্ধ হয়ে যায়। এর আগমুহূর্তে বিমানটির অবতরণের হার প্রতি মিনিটে ৮,০০০ ফুটের কাছাকাছি ছিল। এটি একটি অত্যন্ত দ্রুত অবতরণ; যা একটি বিমানের স্বাভাবিক গতিবিধির বাইরে।
পুতিনের বিরুদ্ধে ওয়াগনার গ্রুপের ব্যর্থ বিদ্রোহের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রিগোজিনকে সতর্ক করা হয়েছিল। বাইডেন প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারাও আন্দাজ করেছিলেন যে, ওয়াগনার বসকে হত্যা করা হতে পারে।
সিআইএ ডিরেক্টর বিল বার্নস ও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন মন্তব্য করেছিলেন যে, প্রিগজিনের বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।
গত জুলাই মাসে ব্লিংকেন বলেছিলেন যে, "আমি যদি প্রিগোজিনের জায়গায় থাকতাম, তবে আমি নিজেকে নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন থাকতাম।"
গত বুধবার প্রিগোজিনকে বহনকারী বিমানটি বিধ্বস্তের সংবাদটি ছড়িয়ে পরলে কিছু মার্কিন কর্মকর্তা একেবারেই আশ্চর্য হননি। বরং একজন কর্মকর্তা বলেন, "আমরা সকলেই এতদিন জানতাম যে, প্রিগোজিন মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে চলাচল করছেন।"
অন্যদিকে বিমানটি বিধ্বস্তের ঘটনায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি। তবে ঘটনার প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর গতকাল (বৃহস্পতিবার) টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে প্রিগোজিনকে নিয়ে নিরবতা ভাঙেন পুতিন।
বিমানটি বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন পুতিন। তবে বিমানের যাত্রী হিসেবে তালিকাভুক্ত ওয়াগনার বস প্রিগোজিন মারা গেছেন কি-না, সেটি নিশ্চিত করে কিংবা সরাসরিভাবে কিছু বলেননি তিনি।
বক্তব্যে পুতিন বলেন, "বিমান বিধ্বস্তের ঘটনাটি বেশ হৃদয়বিদারক। প্রাথমিক তথ্যগুলো ইঙ্গিত করে যে, ওয়াগনার সেনারা বিমানটিতে ছিল। আমি মনে করিয়ে দিতে চাই, এই ওয়াগনার সেনারাই ইউক্রেনের নব্য-নাৎসি শাসনের বিরুদ্ধে আমাদের পক্ষে লড়াই করে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। আমরা সেগুলো জানি এবং তাদের এ প্রতিদান আমরা কখনও ভুলবো না।"
রাশিয়ার কয়েকটি আউটলেটের মতে, বিধ্বস্ত বিমানটি এমব্রেয়ার লিগ্যাসি ৬০০ মডেলের। বিমানটির টেইল নম্বর ছিল আরএ-০২৭৯৫; যেটি প্রিগোজিন নিজে ব্যবহার করতেন বলে জানা যায়।
পুতিন বলেন, "আমি প্রিগোজিনকে অনেক আগে থেকেই চিনতাম; প্রায় ৯০ এর দশকের শুরু থেকে। জটিলতায় ভরা ভাগ্যের অধিকারী ছিলেন তিনি। তবে জীবনে তিনি গুরুতর কিছু ভুলও করেছিলেন।"
পুতিন আরও বলেন, "প্রিগোজিন একজন প্রতিভাবান ব্যক্তি, একজন প্রতিভাবান ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি কেবল আমাদের দেশেই সফলতার সাথে কাজ করেননি। পাশাপাশি বিদেশেও, বিশেষ করে আফ্রিকাতে তার কাজের পরিধি বিস্তৃত ছিল। সেখানে তিনি তেল, গ্যাস, মূল্যবান ধাতু ও পাথরের ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন।"
লন্ডনভিত্তিক থিংক ট্যাংক চ্যাথাম হাউজের কেয়ার গাইলস জানান, প্রিগোজিনের মৃত্যুর সংবাদকে ঘিরে সকলকে 'বিশাল সতর্কতা' অবলম্বন করতে হবে।
কেয়ার গাইলস বলেন, "ঘোষণা করা হয়েছে যে, ইয়েভগেনি প্রিগোজিন নামে একজন যাত্রী বিধ্বস্ত বিমানটিতে ছিলেন। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, একাধিক ব্যক্তি ভ্রমণের তথ্য লুকাতে নিজেদের নামের পরিবর্তে ইয়েভজেনি প্রিগোজিনের নাম ব্যবহার করে থাকেন।"
পুতিন বলেন, "আমি যতদূর জানি, প্রিগোজিন গতকাল আফ্রিকা থেকে ফিরেছিলেন। তিনি এখানে কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করেন। ইতিমধ্যে এই ঘটনার প্রাথমিক তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্তটি সফলভাবে সম্পন্ন করা হবে। এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দেখা যাক, তদন্তে কী উঠে আসে।"
কেয়ার গাইলস মনে করেন, যতক্ষণ না 'নিশ্চিতভাবে' জানা যাবে যে, বিমান বিধ্বস্তে নিহত ব্যক্তিটিই আসল প্রিগোজিন, ততক্ষণ যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে। সেক্ষেত্রে আফ্রিকা থেকে নতুন করে প্রকাশিত একটি ভিডিওতে প্রিগোজিনকে জীবিত দেখা গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
পুতিন বলেন, "অদূর ভবিষ্যতে তদন্তকারীরা কী বলে, সেটাই দেখার বিষয়। এখন বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ, টেকনিক্যাল যাচাই-বাছাই ও জেনেটিক পরীক্ষা করা হচ্ছে। এতে কিছু সময় লাগবে।"
গত জুলাই মাসে বিদ্রোহের পর থেকে নিজেকে অনেকটা আড়ালেই রেখেছিলেন প্রিগোজিন। মাত্র ২৪ ঘণ্টা টিকে থাকা বিদ্রোহে গ্রুপটি দক্ষিণ রাশিয়ার শহর রোস্তভে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল। যদিও পরবর্তীতে বেলারুশের নেতা আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্থতায় বিদ্রোহ থেকে সরে এসেছিল ওয়াগনার গ্রুপ।
ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার হয়ে অংশ নিয়েছিল ওয়াগনার গ্রুপ। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরেই অস্ত্র সরবরাহে ঘাটতির অভিযোগ তুলে রাশিয়ার সামরিক নেতাদের নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছিলেন ওয়াগনার বস প্রিগোজিন। রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সামরিক-প্রধানের সঙ্গেও প্রকাশ্য বিরোধে জড়িয়ে পড়েন তিনি। তারই চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে একসময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র পুতিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি।