‘বারবার আমরা বলেছি, ত্রাণ দিতে হবে না, ভালো একটা বাঁধ করে দেন’
আম্পান ঝড়ে সাতক্ষীরায় ভেসে গেছে উপকূল রক্ষা বাঁধ। ধ্বসে গেছে কাচাঘরবাড়ি, ভেসে গেছে মাছের ঘের। সবকিছু হারিয়ে উপকূলবাসীর এবারের ঈদ শুধু বেঁচে থাকার নতুন লড়াই। পরিবারকে আশ্রয়কেন্দ্রে রেখে পুরুষেরা ছুটছেন স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে উপকূলীয় বাঁধ রক্ষায়।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার উপকূলীয় গাবুরা ইউনিয়ন পুরোপুরি বিধ্বস্ত। গোটা ইউনিয়ন এখন পানির নিচে। আজ মঙ্গলবার সকাল থেকে কয়েক হাজার মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণের কাজে নেমেছেন। গাবুরা ইউনিয়নের লেবুগুনিয়া এলাকায় বাঁধ রক্ষায় কাজ করছেন এসব মানুষ।
লেবুগুনিয়া এলাকার ৮ বছর বয়সী রাসেল। ঈদের কোনো আনন্দ নেই তার মনে। রাসেল জানান, ঈদের কোনো আনন্দ করতে পারলাম না। নৌকায় করে চলাফেরা করতে হচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে আমাদের। আব্বু সকালে বাঁধ রক্ষার কাজে গেছেন।
একই গ্রামের মিজানুর রহমান জানান, লেবুগুনিয়া গ্রামের কপোতাক্ষ নদীর বাঁধ ভেঙে গোটা ইউনিয়ন প্লাবিত হয়ে গেছে। এক কিলোমিটারেরও বেশি বাঁধ ভেঙে গেছে। স্ত্রী, বাচ্চাদের নিয়ে উচু জায়গায় আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে রয়েছি। কোন খাদ্যসামগ্রী এখনো আমরা পাইনি। বাড়িতেও খাবার নেই। খুব কষ্টে রয়েছি।
তিনি বলেন, আমাদের ত্রাণের প্রয়োজন নেই। বার বার আমরা বলেছি, ত্রাণ দিতে হবে না ভালো একটা বাঁধ করে দেন আমাদের। কেউ আজও দেয়নি।
লেবুগুনিয়া গ্রামের বৃদ্ধ রাশেদ জানান, খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছি। পরিবারের কেউ ঈদের আনন্দ করতে পারিনি। বাড়িতে খাবার নেই। খুব কষ্টে রয়েছি। কেউ এখনো আমাদের দেখলো না। আমরা চাই উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ আমাদের একটু দেখুক।
লেবুগুনিয়া এলাকায় বাঁধ রক্ষায় স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কাজ করছেন আমিনুর রহমান। তিনি বলেন, ভাটার সময় পানি কমছে আবার জোয়ারের সময় বাড়ছে। নদীর জোয়ার ভাটার সঙ্গে মিলেমিশে চলছে আমাদের জীবন। সরকারিভাবে এখনো বাঁধ রক্ষায় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাই বেঁচে থাকার তাগিদে গ্রামবাসীর উদ্যোগে বাঁধ রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছি।
গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিএম মাসুদুল আলম জানান, বাঁধ রক্ষায় গ্রামবাসীকে নিয়ে কাজ করছি। মানুষের জীবন বাঁচাতে হবে। ইউনিয়নের ৪০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
পার্শ্ববর্তী পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পাতাখালি এলাকায় কপোতাক্ষ নদীর বাঁধ রক্ষায় স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছেন এলাকাবাসী।
পাতাখালি গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা সাজিদুর রহমান জানান, আইলায় যে জায়গায় বাঁধ ভেঙেছিল ঠিক সেখানেই আম্পান ঝড়ে বাঁধ ভেঙেছে। আমরা মেরামতের চেষ্টা করছি। এছাড়া বেঁচে থাকবো করে?
স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করা একই গ্রামের আরেক বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম জানান, ভাটার সময় মেরামত করছি, জোয়ারের সময় আবার তা ভেঙে যাচ্ছে।
পদ্মপুকুর ইউনিয়নের স্থানীয় ইউপি সদস্য সাইফুল্লাহ্ বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের খামখেয়ালিপনার কারণে আজ আমাদের এই দুর্দিন। বার বার এমন হলেও, তারা কোনো পদক্ষেপ নেয় না।
জেলা প্রশাসনের কার্যালয় সুত্রে জানা গেছে, জেলার উপকূলব্যাপী ৫৭.৫০ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান খান বলেন, 'বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে এলাকাবাসী কাজ করছে। আমরা সিমপেথিক ব্যাগ, বাশ দিচ্ছি। এছাড়া কিছু জিও ব্যাগও দেওয়া হবে। এলাকাবাসী যে বাঁধটি দিচ্ছে, সেটি খুব সাময়িক। এটা আবার ভেঙে যাবে। আমরা এসটিমেট করছি। ঠিকাদার নিয়োগের মাধ্যমে দ্রুত বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হবে।'
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের বলেন, গ্রামবাসীর সহযোগিতায় বাঁধ রক্ষার কাজ চলমান রয়েছে। আমরা সাতক্ষীরা উপকূলে স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণের জন্য উদ্যোগ নিয়েছি।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এস.এম মোস্তফা কামাল বলেন, সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপকূলীয় এলাকায় বাঁধ রক্ষার কাজ শুরু হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বলা হয়েছে বাঁধ রক্ষায় জিও ব্যাগ ও বাঁশ যা লাগবে, তারা যেন সেগুলো সরবরাহ করে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় আমি পিআইসি কমিটি করে দিয়েছি। তারা দেখবে সেখানে কি পরিমাণ খরচ বা বরাদ্দ প্রয়োজন।
তিনি বলেন, জনপ্রতিনিধি ও গ্রামবাসীরা একযোগে কাজ করছেন। বিশ্বাস করি এই দূর্যোগ আমরা কাটিয়ে উঠতে পারবো।