'বাবরনামা'য় নিসর্গবিদ বাবরের প্রাণীরা
মোগল সম্রাট জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর (১৪৮৩–১৫৩০) ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য সবচেয়ে বিখ্যাত। ১৫২৬ সালে দিল্লি দখল করেন তিনি।
মধ্য এশিয়া থেকে তরুণ বয়সে এসে প্রথমে ১৫০৪ সালে কাবুল জয় করেছিলেন বাবর। এরপর আরও পূর্বে অগ্রসর হয়ে তৎকালীন দিল্লির সুলতান ইব্রাহিম লোদীকে ১৫২৬ সালে পানিপথের যুদ্ধে পরাজিত করে দিল্লি করায়ত্ত করেন।
তারপরে ১৫২৭ সালে মেবারের রাজপুত রানা সংগ্রাম সিংহকে হারিয়ে ভারতবর্ষের ক্ষমতাকে আরও পাকাপোক্ত করেছিলেন বাবর।
সামাজ্য পরিচালনা, যুদ্ধের নেতৃত্বদানের মতো বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকার পরও বাবর নিজের আত্মজীবনী রচনার সময় পেয়েছিলেন। বাবরনামা নামক ওই আত্মজীবনী দিল্লির সম্রাট যেমন নিজের বিভিন্ন যুদ্ধজয়ের কথা উল্লেখ করেছেন, তেমনি সেখানে তিনি নিজের অনুভূতিকে বেশ অবাধে প্রকাশ করেছেন।
বাবর ছিলেন একজন পণ্ডিত, কবি, ও নিসর্গবিদ। বাবরনামায় প্রকৃতি নিয়ে তার স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষণক্ষমতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আর এর বেশিরভাগই ছিল বাবরের একান্ত অভিজ্ঞতালব্ধ।
বাবরনামার মূল ভাষা চাগাতাই তুর্কি। এ বইয়ে বর্ণিত ঘটনাপঞ্জি কালানুক্রমিক, বছরের হিসেবে এটি লেখা হয়েছে। বেশ কয়েকবার গ্রন্থটি ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বিখ্যাত অনুবাদটি ১৫৮৯ সালের।
ওই বছর বাবরের নাতি ও দিল্লির শাসনকর্তা আকবরের অনুরোধে তার প্রধানমন্ত্রী বাবরনামাকে ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করেন। ওই অনুবাদেরই একটি সংস্করণ ব্রিটিশ লাইব্রেরির সংগ্রহে রয়েছে।
মূল বইটিতে মোট ১৮৩টি অলংকরণ ছিল। যদিও লাইব্রেরির সংগ্রহে থাকা বইটিতে চিত্রকর্মের সংখ্যা ১৪৩টি। সম্প্রতি এক প্রদর্শনীতে বইটি দর্শণার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রেখেছে লাইব্রেরিটি।
বাবরনামায় উল্লেখ থাকা ভারতবর্ষের প্রাণী, পাখি ও গাছপালা নিয়ে ব্রিটিশ লাইব্রেরির এশিয়ান অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ ব্লগ-এ লিখেছেন লাইব্রেরিটির পার্সিয়ান, এশিয়ান অ্যান্ড আফ্রিকান কালেকশনস-এর প্রধান কিউরেটর উরসুলা সিমস-উইলিয়ামস।
বাবর জানাচ্ছেন, হিন্দুস্তানের হাতিদের মূল আবাস ছিল কাল্পি (অধুনা উত্তর প্রদেশ) ও তারও পূর্বের অঞ্চলগুলোতে। হাতিকে মহৎ প্রাণী উল্লেখ করে বাদশাহ লিখেছেন, হাতি মানুষের কথা বোঝে, মানে। হাতি যত বড়, তত মূল্যবান। হাতি প্রসঙ্গে তিনি আরও লিখেছেন, ভারতবর্ষের কোনো কোনো দ্বীপে হাতির উচ্চতা ১০ গজেরও বেশি, তবে তিনি নিজে কখনো ৪–৫ গজের বেশি উঁচু হাতি দেখেননি।
হাতি প্রচুর ভার বহন করতে পারে, তিন-চারটা মিলে এমন গাড়ি টানতে পারে যা মানুষের ক্ষেত্রে ৪০০–৫০০ জনের দরকার হবে। তবে হাতি যে অনেক খায়, তা বাবরের চোখ এড়ায়নি। তিনি লিখেছেন, দুটো কাফেলার সব উট যে পরিমাণ খাবার খেতে পারে, তা দিয়ে কেবল একটা হাতির পেট ভরে।
আরেক বড় প্রাণী গন্ডার। আকারে তিনটা মহিষের সমান। তবে গন্ডার শিং দিয়ে একটা হাতিকে শূন্যে তুলতে পারে বলে যে গল্প প্রচলিত আছে, তা মিথ্যা। নাকের ওপর একটা শিং থাকে গন্ডারের। আর এর চামড়া অনেক মোটা। হাতিকে পোষ মানানো গেলেও গন্ডার পোষ মানে না — এটি বেশ হিংস্র।
বাবরনামায় অনেক ধরনের বানরের উল্লেখ রয়েছে। হলুদ রংয়ের সাদামুখো ও ছোট লেজের একটা বানরকে বাইরে থেকে হিন্দুস্তানে নিয়ে আসা হতো। ওই বানরকে বিভিন্ন খেলা দেখানো প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।
লেঙ্গুর বানরের গা ছিল বড় সাদা চুলে ভর্তি, লেজ বড়, মুখটা কালো। বিভিন্ন দ্বীপ থেকে আসা আরেক প্রজাতির বানরের রং নিয়ে ধন্দে পড়েছিলেন বাবর
বাবর অনেক টিয়াপাখির কথাও উল্লেখ করেছেন। এক জাতের টিয়া নিয়ে তার ধারণা ছিল, ওই পাখিকে কেবল যা বলতে শেখানো হতো, তা-ই বলতে পারত। কিন্তু একদিন আশ্চর্য এক ঘটনা শুনতে পান নিজের এক অমাত্যের মুখে। ওই অমাত্যের একটি টিয়া ছিল। একদিন তিনি পাখির খাঁচাটা ঢেকে দিলে পাখিটি বলে উঠেছিল, 'ঢাকনা খুলুন, আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না।'
হাড়গিলে পাখির সঙ্গেও বোধহয় মোলাকাত হয়েছিল দিল্লির বাদশাহর। তিনি লিখেছেন, এ পাখির ডানার আকার ছিল প্রায় মানুষের মতো। পাখিটির ঘাড়ে ও গলায় পালকের বালাই নেই। ঠোঁট আর বুক ছিল সাদা রংয়ের।
হাড়গিলেকে পোষ মানানো যেত। এটির দিকে মাংস ছুঁড়ে মারলে সেটি ধরে খেতে পারত পাখিটি। একবার ছয় স্তরের একপাটি জুতা খেয়ে ফেলেছিল একটি হাড়গিলে পাখি। আরেকবার ডানা-পালকসহ একটি মোরগ হাড়গিলের উদরে গিয়েছিল।
বাবরনামায় আরও একটি প্রাণীর উপস্থিতি রয়েছে। তা হলো বিভিন্ন প্রজাতির কুমির।
বাবর কুমিরকে (অ্যালিগেটর) দেখতে টিকটিকির মতো উল্লেখ করেছেন। ফার্সিতে কুমির শব্দের অর্থ দাঁড়ায় অনেকটা জলসিংহের মতো। ব্রিটিশ লাইব্রেরির সংগ্রহে থাকা বাবরনামার ছবিগুলোতে যিনি কুমিরের ছবি এঁকেছিলেন, তিনি খুব সম্ভবত জীবনে কখনো কুমির দেখেননি বা ফার্সিতে জলসিংহ বলতে যে কুমিরকে বোঝায় তা জানতেন না।
কারণ কুমিরের অলংকরণ করতে গিয়ে তিনি একটি সিংহ একটি ষাঁড়কে আক্রমণ করছে — এমন ছবি এঁকেছেন। সে যা-ই হোক, বাবর তার লেখায় ডলফিন, ঘড়িয়ালের কথাও এনেছেন।