আইএমএফের শর্ত থাকলেও নির্বাচনের আগে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সম্ভাবনা কম
চলতি বছর জ্বালানি তেলের দাম না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এমনকি আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়তে শুরু করলেও- দেশের বাজারে দাম সমন্বয় করা হবে না।
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাথে ঋণ চুক্তিতে চলতি সেপ্টেম্বর থেকেই পেট্রোলিয়াম পণ্যের ক্ষেত্রে একটি স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি চালু করার অঙ্গীকার থাকলেও– আসন্ন নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তবে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে দেশের বাজারেও কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এতে চলমান মূল্যস্ফীতির চাপের মধ্যে সাধারণ ভোক্তারা উপকৃত হবেন বলেও জানান তারা।
গত শুক্রবার বিশ্ববাজারে তেলের দাম সাত মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছায়। আপাতত বাড়তি এই দাম নিজস্ব তহবিল থেকে মেটাচ্ছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)। ফলে তাৎক্ষনিকভাবে মূল্যবৃদ্ধির চাপে নেই সরকার।
সরকার জ্বালানিতে আর ভর্তুকি দিতে রাজি না হওয়ায় গত বছরের আগস্টে – ডিজেলের ৪২.৫ এবং পেট্রলের ৫১ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি – বিপিসিকে যথেষ্ট আয়ের সুযোগ করে দেয়; ফলে তারা নিজস্ব মুনাফা থেকে আমদানির বিল মেটাতে পেরেছে।
ডলার সংকটের কথা বলে বিপিসির আমদানি বিল মেটাতে ব্যাংকগুলোর গড়িমসির কারণে আন্তর্জাতিক সরবরাহকারীদের বিল পরিশোধে দেরি হচ্ছিল বিপিসির। এই বাধা কাটিয়ে সরবরাহকারীদের প্রায় সব দেনা শোধ করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি।
আইএমএফ থেকে বাংলাদেশ যে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিচ্ছে তার অন্যতম একটি শর্ত হচ্ছে, সেপ্টেম্বরের মধ্যে পেট্রোলিয়াম পণ্যের ক্ষেত্রে একটি 'পিরিওডিক ফর্মুলা-বেইজড প্রাইস অ্যাডজাস্টমেন্ট মেকানিজম' চালু। আর আগামী বছরের মার্চ থেকে এই ফর্মুলা অনুযায়ী, জনসাধারণ বা গ্রাহকদের কাছে জ্বালানি তেল বিক্রি করার কথা রয়েছে।
চলতি বছরের এপ্রিলে ১ সেপ্টেম্বর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারদর অনুযায়ী- তেলের দাম তিন মাস পর পর সমন্বয় করার ঘোষণা দিয়েছিলেন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
গত মে মাসে আইএমএফ এর সফরকারী মিশনকেও সেপ্টেম্বর থেকে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিল জ্বালানি বিভাগ।
জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমছিল। তখন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রল, অকটেনসহ সব ধরনের জ্বালানি তেলে মুনাফা করছিল। ওই সময় থিঙ্ক ট্যাঙ্ক– সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-সহ দেশের ব্যবসায়ী মহল থেকে তেলের দাম সমন্বয় করার প্রস্তাব ছিল। এমন প্রেক্ষাপটে সেপ্টেম্বর থেকেই আইএমএফ এর ফর্মুলা অনুযায়ী, জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে এমন আভাস দেওয়া হয়েছিল।
তবে গতমাস থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে পরিশোধিত জ্বালানি তেল, বিশেষত ডিজেলের দাম অনেক বাড়ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে– ৭০ লাখ টন জ্বালানি চাহিদার বড় অংশই – পরিশোধিত জ্বালানি আমদানি তেল আমদানি করে মিটিয়েছে বাংলাদেশ।
নাম না প্রকাশের শর্তে জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, 'এখন দাম সমন্বয় করা হলে- ডিজেলের দাম লিটারে বর্তমান বাজার দরের চেয়ে প্রায় ১৫ টাকা বাড়বে। এর প্রভাব নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কৃষি, শিল্পখাতে। মূল্যস্ফীতি আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই নির্বাচনের আগে সরকার দাম সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে।'
নাম গোপন রাখার শর্তে- জ্বালানি বিভাগের অপর এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে এখন অকটেনের চেয়ে ডিজেলের দাম বেশি। তাই দেশের বাজারে দাম সমন্বয় করা হলে পেট্রল ও অকটেনের দাম কিছুটা কমবে। কিন্তু এসব জ্বালানি তুলনামূলক স্বচ্ছল/ ধনী ভোক্তারা ব্যবহার করেন। তাই সেপ্টেম্বরে দাম সমন্বয় করে ডিজেলের দাম বাড়ানো হলে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের কষ্ট বাড়বে, ধনীরা সুবিধা পাবে।
এর আগে ২০২২ সালের ৫ আগস্ট জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ– ডিজেলের দাম ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, পেট্রলের দাম ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা এবং অকটেনের দাম ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা করার ঘোষণা দেয়।
এরপর জ্বালানি কর হ্রাস করে প্রতি লিটারে ৫ টাকা কমানো হয়।
এসময় জ্বালানির বাড়তি দামের বোঝা জনগণের ওপর পার করে দেওয়ার জন্য সরকার সমালোচনার মুখে পড়েছিল।
বিপিসি আগের বছরগুলোয় মুনাফা করেছে। এই প্রেক্ষাপটে জ্বালানি শুল্ক কমিয়ে মূল্যের তীব্র বৃদ্ধি না এড়ানোর কারণে সরকার সমালোচিত হয়েছিল।
বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ তখন বলেছিলেন, সংস্থাটি ৪২ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা মুনাফা করলেও, উদ্বৃত্ত এ তহবিল সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় করা হয়েছে। ফলে তাদের কাছে শুধু দুই মাসের আমদানির বিল পরিশোধের মতো অর্থ আছে।
আইএমএফের ঋণে কোনো প্রভাব পড়বে কি?
গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, 'বর্তমান পরিস্থিতিতে, জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে নিয়মিত সমন্বয় করা জরুরি। কিন্তু, সরকার হয়ত নির্বাচনের আগে তা করবে না। আইএমএফকে বোঝানোর চেষ্টা করবে যে, এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।'
তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক পদ্ধতিতে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ, রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং বৈদেশিক মুদ্রার নিরাপদ মজুদ সৃষ্টির শর্তগুলো– আইএমএফের প্রথম মূল্যায়নে সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। নির্বাচনের অজুহাতে সরকার হয়ত সময় নেবে, যাতে পরের মূল্যায়নে এগুলো বিবেচনা করা হয়।
স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতির বর্তমান অবস্থা
জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, আইএমএফ- এর শর্ত অনুযায়ী ইতোমধ্যে স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতির খসড়া তৈরি করা হয়েছে। আগামী অক্টোবরে আইএমএফের মিশনের পরবর্তী সফরের সময় তাদের কাছে এটি উপস্থাপন করা হবে। তবে কবে থেকে ফর্মুলাটি কার্যকর করা হবে- সেটি এখনও চুড়ান্ত করা হয়নি।
তারা আরো জানান, সুবিধাজনক সময়ে সময়ে এই ফর্মুলা কার্যকর করা হবে। এ বিষয়ে আইএমএফের সাথে আলোচনাও হয়েছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের আমদানি মূল্য, জাহাজ ভাড়া, পরিশোধন খরচ, বিতরণ ও বিপণন খরচ এবং কর: এই বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করে ফর্মুলাটি তৈরি করা হয়েছে।
ফর্মুলা প্রণয়নে ভারতের জ্বালানি তেলের দরও বিবেচনায় রাখা হয়েছে। প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে জ্বালানি তেলের চোরাচালান বন্ধে – বাংলাদেশে তেলের দাম ভারতের বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নির্ধারণ করা হবে।
জ্বালানি তেলের মূল্য প্রবণতা
মোট জ্বালানি পণ্যের মধ্যে সিংহভাগই ডিজেল ব্যবহৃত হওয়ায় – বিপিসির মুনাফা বা লোকসান – আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির দর উঠানামার ওপর নির্ভর করে ।
যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের তথ্যমতে, গত ২৮ আগস্ট বিশ্ববাজারে পরিশোধিত ডিজেল প্রতি ব্যারেল সর্বনিম্ন ১৭৫ ডলার থেকে সর্বোচ্চ ২৩৮ ডলার দরে (সকল প্রকার করসহ) বিক্রি হয়েছে। অন্যান্য সূত্রগুলো জানায়, এদিন আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেল (ক্রুড অয়েল) প্রতি ব্যারেল ৮৪.৪৭ ডলারে বিক্রি হয়।
গত জুলাইয়ের শুরুতে এই দর ছিল ব্যারেলে ৭৪ ডলার। অর্থাৎ, দুই মাসের ব্যবধানে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে প্রায় ১০ ডলার।
অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়া এবং পরিশোধন বাবদ কোম্পানিগুলোর ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় পরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে বেশি। বাংলাদেশ চাহিদার ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে থাকে।
জ্বালানি বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, করোনা মহামারির আগে জ্বালানি তেলের পরিশোধন বাবদ ব্যারেল প্রতি ৫ থেকে ৭ ডলার ব্যয় ধরা হতো। বর্তমানে রিফাইনিং কোম্পানিগুলো এই ব্যয় ধরছে প্রায় ২০ ডলার।
বিপিসি মুনাফায় নাকি লোকসানে
এদিকে, আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়া এবং টাকার অবমূল্যায়নের কারণে গত দু'মাস ধরে আবারও লোকসানে পড়েছে দেশের একমাত্র জ্বালানি তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান- বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন(বিপিসি)। যদিও নিজস্ব তহবিল থেকেই লোকসান মেটাচ্ছে সংস্থাটি।
২০১৩ সাল থেকে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করে বিপিসি। মুনাফা থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা সরকারকে দিয়েছে বিপিসি। গতবছর ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বাড়তে থাকলে মুনাফা কমতে থাকে সংস্থাটির।
গতবছর অর্থ বিভাগের কাছে ভর্তুকি হিসেবে ১৯ হাজার কোটি টাকা দাবি করেছিল সংস্থাটি। তবে জ্বালানি তেলে ভর্তুকি না দেওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
ফলে গত বছর নাগাদ আন্তর্জাতিক সরবরাহকারীদের কাছে বিপিসির দেনার পরিমাণ ছিল প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার। মাঝখানে কয়েক মাস মুনাফা করে তা পরিশোধের উদ্যোগ নেয় সংস্থাটি। বর্তমানে দেনা ৩০ মিলিয়নে নেমেছে।
জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বিশ্বজুড়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। ফলে বিভিন্ন দেশের রিফাইনারিগুলোতে নতুন বিনিয়োগ আসছে না। তবে আগে যেসব রিফাইনারি স্থাপিত হয়েছে, তারা তাদের বিনিয়োগের অর্থ উত্তোলনের জন্য পরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।
এখানেই বিপত্তিতে পড়েছে বিপিসি। কারণ, দেশের একমাত্র পরিশোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির ৭০ লাখ টন জ্বালানি চাহিদার মধ্যে মাত্র ১৫ লাখ টন পরিশোধন করার সক্ষমতা আছে। ফলে বেশি দামে বাকি ৫৫ লাখ টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করতে হচ্ছে।
বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট জ্বালানি চাহিদার ৭০ শতাংশ ডিজেল। এছাড়া ৬.৫০ শতাংশ পেট্রল, ৬ শতাংশ অকটেন, ১ শতাংশ কেরোসিন, ৮.৫০ শতাংশ ফার্নেস অয়েল এবং জেট ফুয়েল ৬.২৫ শতাংশ। বাকিটা অন্যান্য ধরনের জ্বালানি হিসেবে বেচাকেনা হয়ে থাকে।