ডিমের বাজারে কারসাজি: ১০ প্রতিষ্ঠান, সমিতির বিরুদ্ধে মামলা করছে প্রতিযোগিতা কমিশন
ডিমের বাজারে কারসাজির মাধ্যমে অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি করে বাড়তি মুনাফা করায় এবার ৬ কোম্পানি ও ৪ বাণিজ্যিক অ্যাসোসিয়েশনের (সমিতি) বিরুদ্ধে মামলা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন (বিসিসি)।
বিসিসির একটি অনুসন্ধানী দল বাজার থেকে তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠানগুলোর সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেখানে উঠে এসেছে বেশ কিছু কোম্পানি ও তাদের সংশ্লিষ্ট সমিতিগুলো এসএমএস-এর মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে বাড়তি মুনাফা করেছে।
বিসিসি সূত্র বলছে, কাজী ফার্মস লিমিটেড, প্যারাগন পোল্ট্রি লিমিটেড, ডায়মন্ড এগ লিমিটেড, পিপলস পোল্ট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি লিমিটেড, নাবা ফার্ম লিমিটেড, বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি), বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন (বিপিআইএ), বাংলাদেশ পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদ, পোল্ট্রি প্রফেশনালস বাংলাদেশ (পিপিবি) এবং ইউনাইটেড এগ সেল পয়েন্টের বিরুদ্ধে মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
বাজার কারসাজির অভিযোগে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিযোগিতা আইন, ২০১২ এর ধারা ১৫(১), ১৫(২)(ক)(অ), ১৫(২)(খ) ও ১৫(২)(গ) ধারা অনুযায়ী অভিযোগ দায়ের করে মামলা করা হচ্ছে।
বিসিসির সদস্য মো. হাফিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "ডিমের বাজারে সিন্ডিকেশন করে দাম বাড়ানোর ঘটনায় চিহ্নিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।"
যদিও প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিআইএ) মহাসচিব ও ইউনাইটেড এগ সেল পয়েন্ট এর স্বত্বাধিকারী খন্দকার মুহাম্মদ মহসিন টিবিএসকে বলেন, "রাষ্ট্র তার দায় এড়ানোর জন্য আমাদের ওপর মামলা করছে। এই যে ৬০ হাজার খামার বন্ধ হয়ে গেছে তার দায় কে নেবে? সেখানে কী হয়েছে তার খোঁজ কি কেউ রেখেছে?"
ডিমের বাড়ার কারণ করে তিনি বলেন, "ওই সময় প্রচণ্ড গরমে হাজার হাজার মুরগি মারা যায়, এরপরের টানা বৃষ্টিতে মাছের সরবরাহ কমে যায়। তখন ডিমের বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়। কিন্তু উৎপাদন ছিল স্বাভাবিকের তুলনায় কম। এই চাহিদার কারণেই দাম বেড়েছিল।"
এর আগে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরেও ডিমের বাজারে অস্থিরতার কারণে সিপি, প্যারাগন, কাজী, ডায়মন্ড এগ ও তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. আমানত উল্লাহর বিরুদ্ধে মামলা করেছিল বিসিসি। যে মামলা এখনও চলমান রয়েছে।
গত আগস্ট মাসের মাঝামাঝিতে হঠাৎ করেই ডিমের দাম বাড়তে শুরু করে। ১৪৫-১৪৮ টাকা ডজন হিসেবে বিক্রি হওয়া প্রতি ডজন ডিমের দাম ১৭০ টাকায় উঠে যায়। পিস হিসেবে কোথাও কোথাও প্রতিটি ডিম বিক্রি হয় ১৫ টাকায়। প্রায় সপ্তাহখানেক এই অবস্থা চলার পর মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় প্রতিটি ডিমের উৎপাদন খরচ প্রকাশ করে ১০.৫০ টাকা এবং খুচরায় ১২ টাকার বেশি দামে ডিম বিক্রি হলে ব্যবস্থা নেওয়ার হুশিয়ারি দেয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে ধীরে ধীরে ডিমের দাম স্বাভাবিক হতে শুরু করে।
এ সময় ডিম উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীরা দাবি করেন, লোকসানে পড়ে খামার বন্ধ করে দেওয়ায় ডিমের উৎপাদন কমে গেলেও চাহিদা বৃদ্ধি পায়। বাজারে সরবরাহ স্বল্পতার কারণে সে সময় ডিমের দাম বেড়ে যায়। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন ডিমের উৎপাদন ৪.৫-৫ কোটি পিস হলেও অস্থিরতার সময়ে তা ৪ কোটি পিসের নিচে নেমে আসে।
বাজারে হঠাৎ অস্থিরতা তৈরি হওয়ার কারণ জানতে প্রতিযোগিতা কমিশন একটি তদন্ত দলকে সরেজমিন অনুসন্ধানে পাঠায়। একই সঙ্গে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর একটি তদন্ত প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও প্রতিযোগিতা কমিশনকে প্রদান করে। এই দুটি প্রতিবেদনেই ডিমের বাজারে অস্থিরতা তৈরির পেছনে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের কারসাজি ধরা পড়ে।
প্রতিযোগিতা কমিশনের অনুসন্ধানে উঠে আসে, মোট ১০টি কোম্পানি ও তাদের সমিতিগুলো পারস্পারিক যোগসাজসের মাধ্যমে বাজারে ডিমের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দেয়। একইসঙ্গে বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতায় বিঘ্ন সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা কমিশন ব্যবস্থা নিতে পারে বলে সুপারিশ করে ভোক্তা অধিদপ্তর। কমিশনের সভাতেও সিদ্ধান্ত হয় ব্যবসায়ী সমিতিগুলোর কথিত সিন্ডিকেট প্রতিরোধে কার্যকর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
তবে ডিমের বাজারে অস্থিরতা তৈরি করার অভিযোগে মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে কিনা তা জানতে চেয়ে আগস্টের ২০ তারিখে মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর চিঠি দিলেও তার কোন জবাব পায়নি কমিশন।
এছাড়া, বাজার নিয়ন্ত্রণে বেশকিছু সুপারিশও প্রদান করা হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে। এরমধ্যে ডিমের বাজারে মধ্যস্বত্তভোগীদের কারসাজি বন্ধে পাইকারি বিক্রেতা ও কর্পোরেট গ্রুপগুলোর ওপর কর্তৃপক্ষের নজরদারির পাশাপাশি নাগরিক নজরদারিও প্রয়োজন। ভোক্তাদেরকে নজরদারি ও মনিটরিং কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। ডিম ব্যবসায়ী সমিতিগুলোর সিন্ডিকেট, মজুতদারি, দেশব্যাপী এসএমএসের মাধ্যমে দাম নির্ধারণ প্রক্রিয়া বন্ধে সমিতিগুলোর কার্যক্রমকে জবাবদিহির আওতায় আনা জরুরি।