মাকসুদের ‘ওগো ভালোবাসা’: বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ রক-জ্যাজ ফিউশন অ্যালবাম!
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ধাঁচের গানের ফিউশন বা মেলবন্ধনের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। আমাদের দেশেও হালে কোক স্টুডিও ও গান বাংলা'র মতো প্ল্যাটফর্মগুলোতে গান নিয়ে নিরীক্ষাধর্মী নানান কাজ হচ্ছে। তবে ফিউশনের কথা যদি ওঠে, আর তা যদি হয় রক-জ্যাজ ফিউশন — তবে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে দুই যুগ পেছনে, শ্রোতা হয়ে ফিরে যেতে হবে ১৯৯৯ সালে।
১৯৯৯ সালে বেরিয়েছিল 'মাকসুদ ও ঢাকা' ব্যান্ডের দ্বিতীয় অ্যালবাম ওগো ভালোবাসা। দুই পিঠে পাঁচটি করে মোট দশটি গানের এ অ্যালবামটি ছিল বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ রক-জ্যাজ ফিউশন অ্যালবাম।
গত শতাব্দীর ৬০ দশকের শেষদিকে রক, ফাঙ্ক, রিদম ও ব্লুজ ধাঁচের সঙ্গে জ্যাজের মিশ্রণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নতুন একটি জঁরা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় জ্যাজ ফিউশন। একে রক জ্যাজ বা প্রগ্রেসিভ জ্যাজও বলা হয়।
এ ধরনের ফিউশনে ব্রাস, ট্রাম্পেট ও স্যাক্সোফোনের মতো যন্ত্রানুষঙ্গ ব্যবহৃত হয়। পিয়ানো বা ডবল বেজের প্রয়োগ প্রায় থাকেইনা। সে জায়গায় আসে ইলেকট্রিক গিটার, ইলেকট্রিক পিয়ানো, সিনথেসাইজার ও বেজ গিটার।
এই ধারায় প্রভূত অবদান রেখেছেন মাইলস ডেভিস, ল্যারি কোরিয়েল, গ্যারি বার্টন, চার্লস লয়েড, জন ম্যাকলাফলিনের মতো গায়ক-বাদকেরা। ম্যাকলাফলিনের গড়া ব্যান্ড মহাবিষ্ণু অর্কেস্ট্রায় পাশ্চাত্যের সাইকেডেলিক রক ও জ্যাজের সঙ্গে তিনি মিশিয়ে দেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে।
প্রায় তিন দশক পরে নব্বই দশকের শেষদিকে বাংলাদেশি ব্যান্ড 'মাকসুদ ও ঢাকা' প্রথমবারের মতো পূর্ণাঙ্গ রক-জ্যাজ ফিউশন করে বাংলা ভাষায়।
ক্যাসেটের ইনলে কভারে এ নিয়ে নিজেদের ভাবনার কথা সবিস্তারে লিখেছিলেন মাকসুদ। সেখান থেকে আমরা জানতে পারি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দুইশ বছর আগে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত থেকেই জন্ম জ্যাজ সঙ্গীতের। এর সঙ্গে জুড়ে গেছে বর্ণবৈষম্যের কলঙ্ক। মাকসুদ উল্লেখ করেন, 'শ্বেতাঙ্গরা তাদের কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের সংগীত ছাড়া আর কোনো মানসিক উন্নতির প্রয়াসকে প্রশ্রয় দিত না। সেই কৃষ্ণাঙ্গরাই আজ বিশ্বসঙ্গীতের পৃথিবীতে রাখছে অকল্পনীয় অবদান। ক্রীতদাসদের দুঃখ, বেদন, ভালোবাসা ও কষ্ট সবকিছুরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই সঙ্গীতের মাঝ দিয়ে এবং তা প্রতিফলিত হয় তাদের আধ্যাত্মিক ও রাজনীতিক চেতনার মধ্যে।'
মাকসুদ জ্যাজকে 'সকল বিবেচনায় খুব উঁচুমাপের সঙ্গীত' বলে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ সম্ভ্রান্ত মহাজনদের দরবারি সঙ্গীত নয় জ্যাজ, বরং আমজনতার সব স্তরে জ্যাজ মিশে গিয়ে বিশ্বজুড়ে ব্যাপ্ত হয়েছে। এ কারণেই অন্যান্য ধাঁচের সঙ্গে জ্যাজের ফিউশন করাটা সহজ। মাকসুদের মতে, 'কথাটা খুব হালকা শোনালেও সত্য, এই জ্যাজ-রক ফিউশন খুব ভালো জাতের আলু যা যেকোনো তরকারিতেই মানানসই।'
তার কথার সত্যতা প্রমাণিত হয় ক্যাসেটের গানগুলোতেও। দশটি গানে জ্যাজ ফিউশনের নানা রকম নিরীক্ষা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। ক্যাসেট শুরু হয় "ভালোবাসা দিবস' ৯৯" গান দিয়ে। এটি ছিল জ্যাজ-রক-ফাঙ্ক ফিউশন ধাঁচের গান। এরপর জ্যাজ-রক ফিউশন 'একদিন কাঁদবে'। তৃতীয় গানটি মাকসুদের ৩ নং গীতিকবিতা; এটিই অ্যালবামের টাইটেল গান 'ওগো ভালোবাসা' — ধরনের দিক থেকে জ্যাজ-রক ফিউশন ইন্দো ক্লাসিকাল। এরপরের গান 'অভিশাপের পালা' ব্লুজ-ফাঙ্ক ফিউশন। এপিঠের শেষ গান 'রবীন্দ্রনাথ ২০১০'। রবিঠাকুরের 'না চাহিলে যারে পাওয়া যায়' গানটি জ্যাজ-রক ফিউশন ইন্দো ক্লাসিকাল হিসেবে পরিবেশন করে মাকসুদ ও ঢাকা।
অ্যালবামের ওপিঠের সূচনা গান 'রঙতামাশার এই ভুবনে' মারফতি-ফাঙ্ক ফিউশন। এরপর বাংলা ও ইংরেজি কথার মেলবন্ধনে 'আমি তার কিছু পাব কি না' বোস্যানোভা সাম্বা-ফাঙ্ক ফিউশন। তারপর জ্যাজ-ফাঙ্ক ফিউশনে মাকসুদের আরেকটি গীতিকবিতা 'হে প্রবঞ্চনা'। 'চিঠি ব্যক্তিগত' (অতি জরুরি) গানটির সুর বিদেশি গান বলে উল্লেখিত। কোন গান তা বলা না থাকলেও ধরনের দিক থেকে এটি ফাঙ্ক ফিউশন। শেষ গান 'পিঞ্জর' মুর্শিদি-রক-জ্যাজ থিয়েটার ধাঁচের।
উল্লেখ্য, ১৯৯৭ সালে প্রথম অ্যালবাম প্রাপ্তবয়স্কের নিষিদ্ধ বেরোবার পর মাকসুদ পরিকল্পনা করছিলেন রাষ্ট্রক্ষমতা ২০১০ নামক পরবর্তী অ্যালবামের। তবে তার আগেই ১৯৯৯-এ চলে আসে ওগো ভালোবাসা।
গানে সুরের দিক থেকে অভিনবত্ব ও কৌশল যেমন ছিল, তেমনি ছিল বাণীর নির্মাণেও। 'ওগো ভালোবাসা', 'অভিশাপের পালা', 'হে প্রবঞ্চনা'র মতো গানগুলো প্রচলিত ধাঁচের সরল ও একপেশে ভালোবাসা বা বিচ্ছেদের গান থেকে আলাদা — 'অভিশাপের পালা'য় 'এত ভয়/এত ক্ষয়/এত সুখ জানা ছিল না তো, প্রিয়তমা' কিংবা 'হে প্রবঞ্চনা'য় মার্জনা প্রার্থনা করে বলা 'আমি ভিন্ন রংয়ে পুরোনো হাতে নতুন ছবি আঁকার স্বপ্ন দেখিনা' অথবা, অ্যালবামের শিরোনাম গান 'ওগো ভালোবাসা'য় বলা 'ওগো পবিত্রতা, তুমি অপবিত্র আমাকে কতটুকু ভালোবাসো জানি/তোমার অশ্রুর প্লাবন দেখে অথৈ জলের নদী লজ্জা যে পাবে, ও সজনী'।
এ তিনটি গান বাণীর দিক থেকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। বাকি গানগুলোও খুব একটা পিছিয়ে নেই। রক-জ্যাজ ফিউশন হিসেবে 'কাঁদবে', কিংবা বোস্যানোভা সাম্বায় 'আমি তার কিছু পাব কি না' খুব উন্নত কম্পোজিশন।
মাকসুদ এর বাইরে চমক দেখিয়েছেন মুর্শিদি, মারফতি ও রবীন্দ্রসঙ্গীতকে ফিউশনের আওতায় এনে। মুর্শিদি ও মারফতি গান লোকজ ধারা ও আধ্যাত্মিক সাধনার সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই নিপীড়িত শ্রমিকদের জ্যাজ গান এদের সঙ্গে চমৎকার রসায়ন তৈরি করেছে।
এসব কিছুকে ছাপিয়ে অ্যালবামটি বহুল আলোচিত-সমালোচিত হয়ে ওঠে 'রবীন্দ্রনাথ ২০১০' গানটি নিয়ে। মাকসুদ পরিষ্কারভাবেই উল্লেখ করেছিলেন, তিনি কোনো 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' করছেন না। তবুও 'না চাহিলে যারে পাওয়া যায়' গানটি নিয়ে সংস্কৃতিজন ওয়াহিদুল হকসহ কেউ কেউ তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। বিটিভির আমন্ত্রণে সেখানে 'রবীন্দ্রনাথ ২০১০' পরিবেশনের পর মাকসুদকে গণমাধ্যমে নিষিদ্ধ করার আহ্বানও জানান তারা।
তবে মাকসুদ রবীন্দ্রসঙ্গীতের পরিবেশনা শৈলীতে ২০১০ সাল নাগাদ যে পরিবর্তন আসবে বলে অনুমান করেছিলেন, তা কিন্তু একেবারে ভুল প্রমাণিত হয়নি। নচিকেতা-শ্রেয়া ঘোষালের 'পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে' শুনলেই বোঝা যায় তা।
ওগো ভালোবাসা অ্যালবামে ব্যান্ডের সদস্যদের বাইরেও অতিথিশিল্পী ছিলেন কয়েকজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাকসুদের সহপাঠী, পরবর্তীসময়ে দিল্লীনিবাসী শাস্ত্রীয়সঙ্গীতশিল্পী উর্মি, তবলাবাদক নীতিরঞ্জন, গায়িকা মেহরিন এদের মধ্যে কয়েকজন। আর ছিলেন প্রয়াত জ্যাজ ইন্সট্রুমেন্টালিস্ট ট্র্যাভিস জেকিন্স। তিনি ১৯৬১ সাল থেকে বহু জায়গায় জ্যাজ বাজিয়েছেন। ঢাকার বারিধারায় 'ঢাকা জ্যাজ অনসাম্বল'-এ বাজাতেন।
ব্যান্ডের নিয়মিত সদস্যদের বাইরে গায়িকা রমা, ডালিয়া, লিন্ডসে, বেহালাবাদক রূপসী, গিটারিস্ট সেলিম হায়দার ও রুবাইয়াৎ তাদের অবদান রেখেছেন। এমন অনেকের প্রচেষ্টায় সফলরূপ পেয়েছিল বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ রক-জ্যাজ ফিউশন অ্যালবাম ওগো ভালোবাসা। দুই যুগ পেরিয়ে আমাদের সঙ্গীত অঙ্গনে মাইলফলক হয়ে রয়েছে অ্যালবামটি।