কেন এই বিদেশি ব্যান্ডগুলোকে বাংলাদেশে পারফর্ম করতে দেয়া হয়নি?
২০১০ সালে প্রথমবার ঢাকায় এসেছিল পাকিস্তানের ব্যান্ড 'জাল'। এরপর গত ১৪ বছরে বাংলাদেশের কোনো কনসার্টে দেখা যায়নি তাদের। বিরতি ভেঙে আবারও ঢাকায় গাইতে আসছে দলটি।
ব্যান্ডটি আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর 'লেজেন্ডস অফ দ্য ডিকেড' শিরোনামে পূর্বাচলের ঢাকা অ্যারেনায় পারফর্ম করবে।
তবে, ১৪ বছর পর 'জাল'-এর আগমনের আনন্দের সংবাদ আমাদের বিগত বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক শিল্পীদের অনুষ্ঠান বাতিল হওয়ার ইতিহাসও স্মরণ করিয়ে দেয়।
সর্বশেষ, পাকিস্তানি কিংবদন্তি রাহাত ফাতেহ আলী খানের ২০ জুলাইয়ের অনুষ্ঠান ছাত্র আন্দোলন এবং কারফিউয়ের কারণে বাতিল হয়। নতুন করে কনসার্টটি পুনরায় অনুষ্ঠিত হবে কিনা তা এখনও অনিশ্চিত।
তবে এটি তো মাত্র কয়েকদিন আগের ঘটনা। বাংলাদেশি মেটালহেডদের হয়ত ২০১৬ থেকে ২০১৭ সালের কথা মনে আছে। নিরাপত্তার উদ্বেগের কারণ দেখিয়ে সেসময় অনেকগুলো কনসার্ট বাতিল করা হয়েছিল। তবে বাতিল করার আসল কারণ কি 'নিরাপত্তার উদ্বেগ'-ই ছিল নাকি অন্যকিছু?
২০১৬ সালে, সুইস ফোক মেটাল ব্যান্ড এলুভেইটি'র কনসার্ট মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে বাতিল করা হয়।
আন্তর্জাতিক কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় অনুষ্ঠিত 'ইভিনিং উইথ এলুভেইটি' কনসার্ট নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণ দেখিয়ে বাতিল করা হয়। কনসার্টের আয়োজক গ্রিন ইভেন্টস বিডি সেসময় টিকেট ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই অনেক ভক্তরা এই নিরাপত্তার উদ্বেগের ব্যাখ্যা মেনে নিতে পারেননি, বিশেষত যখন বলিউড গায়িকা নেহা কক্কর ঠিক এর আগের সপ্তাহে একই ভেন্যুতে সফলভাবে কনসার্ট করে গিয়েছেন।
ইউটিউবে একটি ভিডিও পোস্ট করে ঢাকায় অনুষ্ঠান করতে না পারার হতাশার কথা জানায় ব্যান্ড দল এলুভেইটি।
এর পরের বছর ৯ মে ঢাকায় অনুষ্ঠাতব্য কনসার্টে ব্রাজিলিয়ান ডেথ মেটাল ব্যান্ড ক্রিসিউন ও নার্ভোকেওসকে পারফর্ম করতে বাধা দেওয়া হয়। ব্যান্ডগুলোর এশিয়া ট্যুরের অংশ হিসেবে রাজধানীর কাওরান বাজারের টিসিবি মিলনায়তনে 'মেটাল মোর্গ' শিরোনামে কনসার্টটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল।
আয়োজকরা সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অনুমতি পেয়েছিল এবং নিরাপত্তা ছাড়পত্র (এনওসি) নেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদনও করেছিল। তবুও ৮ মে হঠাৎ করে তাদের জানানো হয়, 'নিরাপত্তাজনিত কারণে' কনসার্টটি করতে দেয়া যাবে না। তবে ঠিক কী কারণে তা স্পষ্ট করেনি পুলিশ।
কিন্তু ব্যান্ড দুটি ততক্ষণে ইন্দোনেশিয়া থেকে মালয়েশিয়া হয়ে বাংলাদেশের পথে। ৯ মে রাত দেড়টার দিকে ঢাকায় পৌঁছায় তারা।
পৌঁছানোর পর, ক্রিসিউন ও নার্ভোকেওস সদস্যদের ইমিগ্রেশনে আটকে দেয়া হয় এবং তাদের পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়। নিরাপত্তা ছাড়পত্র বাতিল করা সত্ত্বেও কেন তারা বাংলাদেশে এসেছেন তা নিয়ে শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ।
আয়োজকরা অনুরোধ করেছিলেন, ব্যান্ড সদস্যদের যেন অন্তত একটি হোটেলে থাকার অনুমতি দেওয়া হোক। দরকার হলে তাদের বাদ্যযন্ত্র ও সরঞ্জাম বিমানবন্দরে রেখে দেওয়া হোক যতক্ষণ না তারা পরের দিন তাদের দেশে ফিরে যায়।
তবে পুলিশ উদ্বিগ্ন ছিল যে ব্যান্ডগুলো হয়ত ধার করা বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে পারফর্ম করার চেষ্টা করতে পারে।
এরপরে প্রায় ১০ ঘণ্টা ধরে চলা জিজ্ঞাসাবাদ ও হেনস্তার পর, ব্রাজিলিয়ান দূতাবাসের হস্তক্ষেপে অবশেষে উদ্ভূত পরিস্থিতির সমাধান হয়।
তৎকালীন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা মুকিত হাসান খান বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যম প্রথম আলোকে জানিয়েছিলেন, ব্যান্ডের সদস্যরা ট্যুরিস্ট ভিসায় দেশে ঢুকেছেন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত নিরাপত্তা ছাড়পত্র তাদের নেই। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে উদারপন্থি, নাস্তিক, বিদেশি ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করে জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে ২০১৬ সালের জুলাইয়ে হলি আর্টিজান হামলার পর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
কিছু আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ভুলবশত প্রতিবেদন প্রকাশ করে বসে যে, ব্যান্ডগুলোকে একটি 'ব্লাসফেমি আইন'-এর আওতায় আটকে রাখা হয়েছে, বাংলাদেশে যার কোনো অস্তিত্ব নেই।
তবে আসল কারণ কোনো আইন লঙ্ঘন নয় বরং অনেকের মতে, এসব ব্যান্ডের সংগীতের ধাঁচ স্থানীয় সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের বিপরীত। ডেথ মেটাল গানের কথাগুলো শয়তানীয় এবং ধর্মনিন্দামূলক হিসেবে বিবেচিত হওয়ায়, স্থানীয় সমালোচকরা উদ্বিগ্ন ছিলেন যে এটি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক এবং এদেশের যুবকদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
এনিয়ে কথা হয় মেটাল ব্যান্ড 'সিভিয়র ডিমেনশিয়া'র ভোকাল রিয়াসাত আজমির সাথে, যিনি একই সাথে একজন আইনজীবীও। সেদিন কনসার্টে ক্রিসিউনের সাথে তার ব্যান্ডেরও পারফর্ম করার কথা ছিল। তিনি মনে করেন 'অপসংস্কৃতি' এবং 'নিরাপত্তা উদ্বেগ'-এর অভিযোগগুলো ছিল ভিত্তিহীন। তার মতে, কনসার্ট বাতিলের আসল কারণ অন্য কিছু।
রিয়াসাতসহ এই অনুষ্ঠানের সাথে জড়িত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, কিছু প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ঘুষ না দেয়ায় তাদেরকে কনসার্টের অনুমতি দেয়া হয়নি।
ঘটনার পরপরই, ব্যান্ড ক্রিসিউন তাদের ফেসবুক পেজে লেখে, "আমরা একটি অত্যন্ত অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। আমাদের ১০ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে শুধু কিছু কুসংস্কার ও ভুল তথ্যের কারণে আটকে থাকতে হয়েছে।
৯ মে ভোরে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে যখন আমরা লাগেজ খুঁজছিলাম, এমন সময় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা আমাদের দিকে এগিয়ে আসেন। অত্যন্ত রক্ষণশীল এই দেশে কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই আমাদের পাসপোর্ট জব্দ করা হয়। কনসার্টটি বাতিল এবং ব্রাজিলে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে আমরা যে ভিসা পেয়েছিলাম তা সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হয়"।
পরিহাসের ব্যাপার হলো, ব্যান্ডগুলোকে প্রায় ১০ ঘণ্টার জিজ্ঞাসাবাদ ও হেনস্তার পর বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কনসার্টের জন্য 'নো অবজেকশন' সার্টিফিকেট ইস্যু করেছিল। কিন্তু ব্যান্ডগুলোর পক্ষে আর সেই পরিস্থিতিতে কনসার্ট চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন