আলগা গল্প
বাবলার জন্য ব্যাপারটা সাংঘাতিক! ঈর্ষণীয়ও বটে! যেখানে ইন্টারমিডিয়েট ফেল করে ১০ বছর এটা-ওটা করে বাবলা কিছু করতে পারেনি, সেখানে মাত্র ৫ বছর জাপানে কুলিগিরি করে ৩০ লক্ষ নিয়ে এসেছে!
বাবলার বন্ধুরা যারা ঢাকায় এত দিন হাইফাই জীবন যাপন করছিল, বাবলার প্রত্যাবর্তনে তারা লো-ফাই হয়ে গেল!
৩০ লাখ টাকা ক্যাশ; একটা গাড়ি। দুনিয়ার হাইফাই ইলেকট্রনিকস! এ ছাড়া জাপান থেকে পাঠানো টাকায় বাবলার বাবা একটা দোতলাও তুলেছে!
যে বাবলা একসময় বন্ধুদের পকেট থেকে সিগারেট মেরে খেত, সে এখন মার্লবোরো ছাড়া কিছু টানে না। আবার যেহেতু মার্লবোরো সব জায়গায় পাওয়া যায় না, সেহেতু সে সেটা কিনতে শেরাটন হোটেলে চলে যেত। আর যেহেতু শেরাটনে যাওয়া হয়, সেহেতু একটু বারেও যাওয়া পরে।
হিংসুক দোস্তরা অবশ্য এটা বেশ পছন্দ করে। শেরাটনে যাওয়াটা। ফ্রি হুইস্কি। মার্লবোরো।
সানগ্লাসটা সহজে খোলে না বাবলা। খুলতে বললেই গজগজ করে, 'আরে রাখ তোর আন্ধার হয়া যাওয়া! লাগাইসি রেবান! কেউ খেত ভাবলে আমার কি? আমার কাছে ভালো! ব্যাস! সব ভালো!'
এখন বাবলা যা বলে, তা-ই ঠিক! যত দিন ৩০ লাখ আছে, তত দিন বাবলা ভুল কিছু বলে না।
'দোস্ত, আমি তো বাংলাদেশের ব্যবসার হালচাল বুঝি না! তোরা আছিস—তোরাই ক, এখন ৩০ লাখ টাকা লয়া কি করুম?' শেরাটনের বারে বসে একদিন চিন্তিত বাবলা বলেই ফেলে।
স্বাভাবিকভাবেই চার-পাঁচজন দোস্ত তখন প্রাণ উজাড় করা উপদেশ দেয়। জুতার ইন্ডাস্ট্রি, বার্জের ব্যবসা, কাপড়ের দোকান কিংবা রবার ফ্যাক্টরি—এ ধরনের সব বুদ্ধি এল।
'না! না! এগুলা বড় স্লো!' বাবলা তার গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বলে, 'ইন্ডাস্ট্রি করনের লেগা বহুত টাইম লাগে। কাপড়ের দোকানের আইডিয়াটা খারাপ না। তয় আমি ওই সব না—নতুন একটা রাতারাতি পয়সা বানানোর আইডিয়া খুঁজতেসি!'
আড্ডার মধ্যে সবচেয়ে অপদার্থ লোক হচ্ছে আজাদ। প্রাক্তন মাস্তান। এখন ইয়ং মাস্তানদের ট্রেনিং দেয় আর প্রতিষ্ঠিত বন্ধুদের সাথে মদ খাবার ছুতো খোঁজে। 'আমি তোরে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার বুদ্ধি দিতে পারি। আই মিন, বড়লোক তো তুই আছিসই—আরও বড়লোক!'
'তাই নাকি! ক দেখি কী তোর আইডিয়া?' কেশে নেয় বাবলা, 'যেই আইডিয়া লয়া তুই এখনো রাস্তায় বাতাস খায়া বেড়াস? বল দেখি?'
আজাদ বাবলার কটাক্ষ উপেক্ষা করে বলল, 'আমারে মাত্র ৫ লাখ টাকা দিবি—কাল-পরশুর মইধ্যে বড় দাও মাইরা দিমু!'
'তাইলে বোঝা গেছে!' সবাই হাসে!
'না, না—তোরা বুঝোস নাই! ৫ লাখ দিয়া ঢাকার টপ বদমাইশগুলারে ভাড়া করুম। তাদের দিয়া ব্যাংক লুট কইরা ৫০-৫০ করুম তোর লগে!' আজাদ হেসে বলে।
সবাই হাসিতে ফেটে পড়ে।
'ব্যাংক লুটে আরও লস,' একজন বলল, 'এখন কেউ ব্যাংকে টাকা রাখে না। ব্যাংক সব ফাঁকা! ব্যাংকের মালিকরা বেনামে সব টাকা উঠিয়ে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে!'
'দুর! ফালতু আলাপ!' বাবলা তার গ্লাস শেষ করে। 'এর চেয়ে রাস্তাঘাটে ঘুরলেও বেশি বেশি নতুন আইডিয়া পাওন যাইব।'
এর দুদিন পর বাবলা মতিঝিলের দিকে যাচ্ছে—কিছুতেই জ্যাম ঠেলে ওর গাড়ি এগুচ্ছে না। বায়তুল মোকাররম, গুলিস্তান—সব দিকেই জ্যাম। তখন পল্টনের চিপায় গাড়িটা রেখে হেঁটে হেঁটে মতিঝিলের দিকে রওয়ানা করল।
এদিকটায় ফাঁকা দেখে একটা রিকশা ডাক দিল।
তরুণ রিকশাওয়ালা। ব্যাকব্রাশ করা বাবরি চুল; গলায় ১০ টাকার একটা সস্তা চেন।
'আয়েন সাব, কই যাইবেন—ইত্তেফাকের মোর? ৪ টাকা!'
বাবলা রিকশায় উঠল।
রিকশাওয়ালা প্যাডেল মারে আর গান শুরু করে, 'আসি আসি বইলা জোসনায় ফাঁকি... ফাঁকি দিয়াছে!'
রিকশায় বসলে আরোহীরা সাধারণত একটু ভাবুক ভাবুক হয়ে যায়। বাবলাও আধা ভাবুক হয়ে যায়।
'আসি আসি বইলা জোসনায়... ফাঁকি দিয়াছে!'
প্যাডেল মারছে আর এই লাইনটা পুনরাবৃত্তি করছে রিকশাওয়ালা।
'আসি আসি বইলা জোস...'
'এই ব্যাটা কী কস এই সব?' মাঝখানে বাধা দিয়ে উঠে বাবলা। জাপানে থাকাকালীন সময়ে গানবাজনা শোনার সময় পেত না। দেশে আসার সময় বেশ কিছু ক্যাসেট নিয়ে এসেছিল: নিউ ওয়েভ, হেভি মেটাল ইত্যাদি। তা-ও শোনা হয়নি। আসলে বাবলা গানবাজনার মানুষ না। আর বেদের মেয়ে জোসনার নামও সে শোনেনি।
রিকশাওয়ালা একটু ঘাড় ঘুরিয়ে বাবলাকে দেখে নিল। তারপর প্যাডেল মারতে মারতে আবার গান জুড়ল, 'আসি আসি বইলা জোসনায়... জোসনায় ফাঁকি!'
'এই! এই! কী শুরু করছিস এই সব! এক লাইন বারবার?' বাবলা আবার বাধা দেয়, 'কই থেকা এই সব গান শুনছস—এ? আসি আসি কি? এ?'
রিকশাওয়ালা চুপ করে প্যাডেল মারা বন্ধ করল, কিন্তু ব্রেক কষল না। 'কী হইসে স্যার? আসি আসি চিনেন না?'
বাবলা চরম বিরক্ত হয়ে বলল, '৮০-৮০ হইতেসে ১৬০! এইবার চুপ থাক!'
'এইটা ৮০ না—আসি!' রিকশাওয়ালা উত্তর দিল!
'হইসে! এইসব অখাদ্য-কুখাদ্য গান গাইবার দরকার কী?' বাবলা বলল।
'ওখাইদ্য?' রিকশাওয়ালা ঠান্ডা গলায় বলল, 'কেন বেদের মেয়ে জোসনা সিনেমা দেখেন নাই?'
'হে! বেদের মেয়ে? না!'
'বেদের মেয়ে জোসনার গান শুনেন নাই?'
'না!'
'বেদের মেয়ে জোসনার নাম শুনেন নাই?'
'না!'
রিকশাওয়ালা রিকশা থামাল। রাস্তায় নেমে প্রথমে গামছা দিয়ে মুখের ঘাম মুছল। বাবলা একটু হতভম্ব।
'নাইমা যান!' রিকশাওয়ালা বলল।
'এ?' ৩০ লাখ টাকার মালিক বাবলা অবাক।
'নাইমা যান!'
'কে... কেন?'
'আপ্নে বেদের মেয়ে জোসনা দেখেন নাই!'
'তো কী হইসে?' বাবলা প্রশ্ন করে।
'যে বেদের মেয়ে জোসনা দেখে না, তারে আমি রিস্কায় নেই না!'
ইতিমধ্যে চারপাশে ছোটখাটো ভিড় জমে গেছে। বাবলা খুব অপমানিত বোধ করছে। সবচেয়ে বড় কথা নিজেকে বোকা বোকা লাগছে। এ কেমন কথা!
'আহা... এটা কেমন কথা? শোনো,' বাবলা বলে।
'যে বেদের মেয়ে জোসনার গান শোনে না, তার কথা আমি শুনি না,' রিকশাওয়ালা বলে।
বাবলা রিকশা থেকে নেমে পকেটে হাত দেয়। রিকশাওয়ালা তার রিকশা নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়।
'টাকা নিয়া যাও!' বাবলা বলল।
'যে বেদের মেয়ে জোসনার নাম শোনে নাই, তার টাকাও নেই না,' বলে ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সে বাবলার ওপর; তারপর ফেটফেটা রোদে বাবলাকে দাঁড় করিয়ে রেখে সে চলে গেল।
পাঁচ মিনিট পাথর হয়ে বাবলা দাঁড়িয়ে রইল।
কিন্তু এরপর ওর মনে হলো, 'দ্যাটস ইট! আমারে এমন একটা ফিলিম বানাইতে হইব, যেইটা না দেখলে মানুষ একজন আরেকজনরে অপমান করব!'
পরবর্তী এক মাসের মধ্যে বাবলা সাংঘাতিক কাণ্ড করে ফেলল। একটা ফিল্ম কোম্পানির ঢ়ধৎঃহবৎ হয়ে গেল। ছবির কাহিনি জোগাড় করল। একজন হিট ডিরেক্টর জোগাড় হলো আর আর্টিস্টও ঠিক হয়ে গেল।
সিনেমা টাইপ: ফোক ফ্যান্টাসি
নাম : বেদের ছেলে আরমান
নায়ক: ইয়াসির
নায়িকা: কাজলী
খলনায়ক: খলকু জামাল
ব্যস—সব ঠিক! বাবলাকে ডিরেক্টর যা বোঝায়—বাবলা তাই বোঝে। এই সাথে নিজের বাংলা ছবি দেখার প্রাচীন অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে নেয়। নিজে বাংলা ছবির কোন জিনিসটা পছন্দ করত, ভাবে বাবলা। নায়িকার মোটাত্ব? নায়কের খেত ভাব? মারামারি? ভিলেনের বদমাশি? কোনটা? ভেবে পায় না বাবলা—কেন সে স্কুলজীবনে এত্ত এত্ত বাংলা ছবি দেখত?
এর ভেতর সে বেদের মেয়ে জোসনাও দেখেছে কয়েকবার। কী কারণে এটা এত হিট? নায়িকা? নায়ক? ভিলেনের চকচকে নাক? সাপ? ব্যাঙ? কী? কী আছে এতে?
যা-ই হোক, বেদের মেয়ে জোসনার সাথে মিল রেখে ছবি বানানোই নিরাপদ। বেদের মেয়ে লাভ করেছে ১২ কোটি টাকা! বাহ্ বাহ্! বাবলার লক্ষ্য ১২ কোটি না। এক কোটি লাভ করলেই সে খুশি!
এফডিসিতে ফ্লোর ভাড়া করে একটানা ১৫ দিন শুটিং চলল।
বাবলা আসে-যায়। দেখে। নায়ক-নায়িকা ইত্যাদি তার নীরবতা ও নিষ্প্রভ ভাবকে ভয় করে। কেউ তাকে ঘাঁটায় না।
শুটিং দেখে বাবলার মনে নানা প্রশ্ন জাগে। ডিরেক্টর তাকে বুঝিয়ে দেয়। বাবলা অনেক কিছু জেনে নিলেও একটা জিনিস বোঝে না। আবার সেটা ডিরেক্টরকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়াটা শোভন হবে কি না, তা-ও সে বুঝে উঠতে পারে না। বাবলা আবার কিছু বিষয়ে বেশ ভদ্রলোক এবং সে মেয়েদের কখনো খাটো করে কথা বলে না।
অবশেষে একদিন সে ডিরেক্টরকে প্রশ্ন করে: এ-এ একটা ব্যাপার আমি বুঝি না!
'কোন ব্যাপারটা?'
'এই যে কাজলী এবং তার সখীদের ব্যাপার!'
'হ্যাঁ?'
'মানে খেয়াল করলাম যে শুটিংয়ের আগে কাজলিরে পাতলা লাগে কিন্তু শুটিংয়ের সময় তারে মোটা লাগে! কেন?'
ডিরেক্টর অনেকক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে বাবলাকে দেখে। বলে, 'দেখেন ভায়া, ফিল্মে এসেছেন আর হিট ছবি বানায় কীভাবে, এটা যদি না জানেন, তাইলে এই লাইন ছেড়ে দেন!'
বাবলা লজ্জিত বোধ করল। চুপ হয়ে গেল।
ডিরেক্টর বলল, 'শুনেন, ওটাই হচ্ছে সিক্রেট অফ আওয়ার সাকসেস! আপনি যে জানেন না—এতে আমি অবাক হইনি। অবাক হয়েছি এত দিন পর জানতে চেয়েছেন দেখে!'
তারপর ডিরেক্টর নায়িকার দিকে তাকিয়ে বাবলাকে বলে, 'লুক, এখন তার পাছা ৪২ ইঞ্চি। সিনেমা হিট হবেই!'
বিষম খায় বাবলা, 'পাছা? এ? ৪২? এইসব কী কন!'
'ইয়েস!' ডিরেক্টর বলে, 'নো পাছা...নো হিট! এই জন্য টেইলার দিয়ে আলগা পাছা বানিয়ে নায়িকা এবং তার সখীদের সাপ্লাই দেওয়া হয়েছে!'
এ ব্যাপারে আরও সূক্ষ্ম আলাপ শুরু করল ডিরেক্টর। কিন্তু বাবলা আগে ঘুণাক্ষরেও এমনটি আঁচ করেনি দেখে ওর মাথা ঘুরাচ্ছিল। ও শুটিং থেকে কেটে পড়ল।
এফডিসির শুটিংয়ের পর কিছু গ্রামের শুটিংয়ের প্রয়োজন পড়ল। বাবলার মামাবাড়ি নদীর ওপারে। বিশাল জায়গাজমি। আবার নদীনালা, খাল-বিল আছে। ১০ দিনের প্রোগ্রাম তৈরি করে মামাবাড়ি রওনা দিল বাবলা।
বাবলার ছোট মামা বাবলাদের রিসিভ করল। ছয়টা গাড়িতে বাবলার শুটিং টিম এসেছে। ডিরেক্টর কাজে নেমে গেল আর নায়ক-নায়িকা-অভিনেতারা ঘুরে ঘুরে গ্রাম দেখতে লাগল।
ব্যস ভীষণ ভিড় জমে গেল। নায়ক-নায়িকা বিভিন্ন পাত্র-পাত্রী এবং সর্বোপরি নায়িকার সখীদের আশেপাশে ভিড় আর ভিড়।
মেকআপম্যান আর কস্টিউমম্যানের জন্য আলাদা দুটা রুম দিল বাবলা। কস্টিউমম্যান বিশাল বিশাল তিনটা ট্রাঙ্ক তার রুমে ঢুকাল।
ডিরেক্টর বাবলাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, 'ওই তিন ট্রাঙ্কের একটা পুরো হিট ম্যাটেরিয়াল ভরা!'
'এঁ? হিট মেটেরিয়াল? কী?'
'আশ্চর্য! ভুলে গেলেন? আলগা পাছা!'
'আলগা পাছা?' বিষম খায় বাবলা! আলগা নিতম্ব বিষয়টা ওর কাছে এখনো অদ্ভুত!
'হ্যাঁ! এগুলা আবার ওয়াটারপ্রুফ! এগুলো একদম ৪২ সাইজে থাকবে! আলতু-ফালতু জিনিস না! তুলোর হলে পানিতে নামলে ওগুলো ভিজে ভারী হয়ে যাবে!'
'তাই?' বাবলা হাসে।
'হ্যাঁ! সবকিছু ভেবে নিতে হয়! চিন্তা করেন নায়িকা ৪২ ইঞ্চি নিয়ে নদীতে নামল...তুলার পাছা ফুলে ৫০ হয়ে গেল...কেমন হবে?'
বাবলা বোকার মতো বলে, '৫০ হয়ে যাবে?'
'৫০ হলেও অসুবিধা নেই! কিন্তু সেটা ঢোল হয়ে খসে পড়লেই বিপদ! মানে দৃশ্যটা হবে নায়িকা ৪২ পাছা নিয়ে পানিতে নেমে নাচতে নাচতে ৫০ ইঞ্চি হয়ে গেল...তারপর হটাৎ সে আবার চিকন ৩৬ ইঞ্চি হয়ে গেল! পুরো শুটিং বরবাদ হয়ে যাবে!'
'আপনে খুব বিজ্ঞ,' বাবলা অবশেষে বলল।
এমন সময় হটাৎ চেঁচামেচি লেগে গেল। ডিরেক্টর সেদিকে ঘুরে চিৎকার, 'কী হয়েছে ওখানে?'
কয়েকজন এক্সট্রা এসে ডিরেক্টরের কাছে অভিযোগ করে: দেখেন স্যার গ্রামের লোকেরা আমাগো টিটকারি করে—বিশেষ কইরা ওই ছেমড়াটা!
এক্সট্রাদের নির্দেশিত যুবকটির কাছে যায় ডিরেক্টর। মাস্তান গোছের যুবক। গেঞ্জি, লুঙ্গি, সানগ্লাস।
ডিরেক্টরকে দেখে সে উল্টো বলে উঠে, 'কী হৈছে? মিয়া আমাগো এলাকায় ছবি বানাইবেন আর আমাগো দেখবার দিবেন না?'
'দেখো মিয়া,' ডিরেক্টর বলে।
'কি হৈছে? ওই তুই আমারে তুমি কচ ক্যা?' ছোকরাটা উদ্যত হয়ে ওঠে।
সর্বনাশ! এ হচ্ছে উপজেলার মাস্তান হাবলু।
বাবলা তার মামাকে ডাক দেয়। বাবলার মামা আসে। ডিরেক্টরের কলার চেপে হাবলু ঝাঁকাচ্ছে।
'এই ব্যাটা! কত বড় সাহস!' বাবলার মামা এসে কষে ধমক দেয় হাবলুকে।
মামাকে দেখে হাবলু থতমত খেয়ে ডিরেক্টরকে ছেড়ে দেয়। বলে, 'হেতানে আমারে গালাগালি করচে!'
'যা! এখান থেকে ভাগ,' বাবলার মামা বলে।
'নইলে কী হইব?' হাবলু একটু বেয়াদবি সুরে বলে।
'কালুরে খবর দিমু?' বাবলার মামা রেগে বলে।
'ক কালু ভাই? হে হে মাইনে ভুল হয়া গেছে! করেন ভাই, আপ্নেরা ছবি করেন! 'হাবলু একটু পিছিয়ে যায়। কালু সর্দার বনেদি গুন্ডা। তাকে ভয় পায় না এমন কেউ এই এলাকায় নাই। 'আমি খালি দূর থেকা দেখুম।'
'না, তুই যা!' মামা ধমকে বলল।
'দেহেন বেশি বাড়াবাড়ি করবেন না! আমারে শুটিং দেখতে না দিলে ছবি খারাপ হয়া যাইব,' হাবলু বলল।
'আরে যা যা!'
হাবলু চলে যায়।
ঘণ্টা দুই পর শুটিং শুরু হয়। নায়িকা আর পাঁচজন সখী খালের পারে হাঁটছে। ক্যামেরা রোল হচ্ছে। 'কাট! কাট!' চিৎকার হচ্ছে। ডিরেক্টর লম্ফজম্ফ করছে।
ঘণ্টা চারেক শুটিংয়ের পর সবাই ঘেমেনেয়ে উঠলে পর বেশ কয়েকটা ভালো শট রেকর্ড করা সম্ভব হলো!
কিন্তু হটাৎ ডিরেক্টর লাফিয়ে উঠল, 'কাজলী?'
নায়িকা সবে চোখে গ্লিসারিন লাগিয়ে কাঁদো কাঁদো একটা মুড সৃষ্টি করেছে, 'কী?'
'তোমাকে পাতলা লাগছে কেন?'
'দুঃখের সিন, তাই পাছাটা খুলে রেখেছি!'
'সব্বোনাশ! ছবির নায়িকা যদি মিনিটে মিনিটে মোটা-চিকন হয়, তাইলে তো দর্শক দিশেহারা হয়ে যাবে!' ডিরেক্টর চিৎকার করে, 'যাও পাছা পরে এসো!'
গ্লিসারিনের প্রভাবে নায়িকা কাঁদতে কাঁদতে কস্টিউম রুমে চলে গেল!
বাবলা নিচু স্বরে গজগজ করে, 'এসব করেই বাংলা সিনেমার বারোটা বাজানো হয়েছে!'
ডিরেক্টর ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, 'কী বললেন?'
'চমৎকার বললাম!'
'তাই বলেন! আসলে কী...ওয়াটারপ্রুফ তো! গরম লাগে নিশ্চয়!"
সেদিনের মতো বাবলা শুটিং স্পট ত্যাগ করল।
পরদিন।
সূর্যটা চমৎকার উঠেছে। ডিরেক্টর আর ক্যামেরাম্যান তাই দেখে মহাখুশি।
'ফ্যান্টাস্টিক! এটাই চাই! এমন সূর্য শুটিংয়ের জন্য বেস্ট!' ডিরেক্টর বলল।
বিশাল উঠানে সেট! নায়িকা আর সখীরা নাচগান করবে। একপাশের চেয়ারে ডিরেক্টর, বাবলা আর কয়েকজন প্রোডাকশনের লোক। দুপাশে ক্যামেরা। আর ছোটখাটো ভিড় ইতিমধ্যে জমে গেছে। ডান্স ডিরেক্টর আরও ঘণ্টাখানেক আগে থেকে নায়িকা আর সখীদের নাচ দেখিয়ে দিচ্ছে।
নায়িকা আর সখীরা বিজাতীয় পোশাকে। নায়িকার পরনে ঘাগড়া চোলি আর সখীদের পোশাক মঙ্গল গ্রহ থেকে আনা। এগুলাই নাকি বাংলাদেশের দর্শকদের দৃষ্টিতে সেক্সি।
'সব আলগা পাছার দৌলত!' ডিরেক্টর বাবলাকে বলে। হ্যাঁ, সবগুলো মেয়ে এখানে ঢাউস নিতম্ব নিয়ে চলাফেরা করছে। সখীগুলো সব গরিব ঘরের মেয়ে...শুকনা। কিন্তু আলগা নিতম্বের দৌলতে তাদের বেশ হৃষ্টপুষ্ট লাগছে।
অ্যাকশন!
শুরু হলো নাচ!
চারদিকে আরও দর্শক জুটে গেছে! গ্রামের রেজাউল, আবুল, রবিউলরা হাঁ করে দেখছে! কাজলী ও তার সখীগণের বিশাল পাছা আন্দোলন দেখে ওরা বিষম খাচ্ছে! এসব ওরা বাস্তব জীবনে দেখেনি। কোনো দিন গ্রামের সখিনারা আপন মনে এভাবে বাস্তব জীবনে নাচে না!
কাজলী ভয়ংকর নাচ শুরু করেছে। রসকষহীন বাবলার দৃষ্টিতে 'দাপাদাপি'। আবার ওর সুড়সুড়িও লাগছে।
কিন্তু হঠাৎ কাজলী পাছা দোলাতে দোলাতে স্লিম হয়ে গেল। কাজলীর খবরও নেই যে ওর ৪২ ইঞ্চি হঠাৎ ৩৪ ইঞ্চি হয়ে গেছে।
ডিরেক্টর লাফিয়ে ওঠে: ও মাই গড!
কাজলীর পাছা ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
দর্শকরা হতভম্ব—কারণ, ওরা আলগা পাছার সিক্রেট জানে না!
হঠাৎ ভিড়ের মধ্য থেকে এক লোক লাফ দিয়ে ফ্লোরে পড়ল—স্যাৎ করে আলগা পাছাটা তুলে নিল, 'হা হা পাইসি! পাইসি!'
এই বলে কয়েক সেকেন্ড নাচ দেখাল ছোড়াটা। হাবলু! তারপর তিরবেগে পাছাসহ উধাও হয়ে গেল সে!
'কাট! কাট!'—চিৎকার করে ওঠে ডিরেক্টর। সবাই থেমে যায়। 'ওই পালাল! ওকে ধর! ওকে ধর!'
দুজন ক্যামেরা ত্রু হাবলুর সন্ধানে ছুটল। কিন্তু কে পায় হাবলুকে; বিশেষত প্রতিহিংসাপরায়ণ হাবলুকে।
তিন-চার ঘণ্টা শুটিং বন্ধ রইল। হাবলু ডিরেক্টরকে একটা চিঠি পাঠাল কাউকে দিয়ে। ওতে লেখা: নায়িকার পাছা ফেরত পাইবেন না। ওইটা সারা উপজেলায় দেখাইব আর বলিব যে আপনারা কী রূপে লোকজনদের বোকা বানান। ইতি: ধূমকেতু ওরফে হাবলু।
ডিরেক্টর খুবই আপসেট। তবে বাবলার বিকার নেই। সে উপদেশ দিল, 'ওই পাছা ছাড়াই সিনেমা বানান!'
দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ডিরেক্টর বলল, 'ছবিটা মার খাবে। অন্তত এই এলাকায়!'
'খাক! মানে ওই পাছা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে এমনি এমনি হয় না?' বাবলা ডিরেক্টরকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে।
'সে না হয় হলো। কিন্তু ওই মূল্যবান পাছা! জানেন ওটা পরে কে কে অভিনয় করেছিল?'
'বাদ দেন!' বাবলা বলল। 'আগে জানলে কাপড়ের দোকানের ব্যবসা করতাম!'