শৌণকের সারেঙ্গী এখনো বাজছে!
সময়টা ২০১৮ সাল। ১৩ বছরের একটি ছোট ছেলে মায়ের হাত ধরে গুটিগুটি পায়ে হাজির হয়েছে বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ে। ক্ষুদের ভীষণ ইচ্ছে সারেঙ্গী শেখার। তাই সুযোগ যখন একবার পেয়েছে সারেঙ্গী বিদ্যা ঝালিয়ে নেওয়ার, সেটিকে আর হাতছাড়া করতে চায়নি। গুরু শ্রী দেবাশীষ হালদারের কাছে শুরু করলো তালিম নেওয়া। সঙ্গীতের দেবীকে সারেঙ্গীতে ধারণ করে সেই যে ছেলেটি ছুটতে শুরু করেছে, এরপর আর থামেনি। অবিরাম পাহাড়ি ঝর্ণার মতো সারেঙ্গীর সুরের মূর্ছনায় সকলকে মোহিত করেছে বারবার। বলছিলাম, শৌণক দেবনাথ ঋকের কথা। যে তার সারেঙ্গীর জাদুতে প্রতিনিয়ত মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে দিচ্ছে চারপাশে।
সারেঙ্গীর করুণ সুরে আবিষ্ট করে রাখা শৌণক দেবনাথ ঋকের বর্তমান বয়স ১৭। আর এই বয়সেই তিনি পেয়েছেন কোক স্টুডিও বাংলা সিজন ২- এ বাজানোর সুযোগ। পেয়েছেন বিভিন্ন শিল্পীদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ।
শৌণকের সারেঙ্গী শিক্ষার মূল অনুপ্রেরণা ছিলেন তার মা শুক্লা হালদার। শুক্লা নিজেও এসরাজ শিল্পী হওয়ায় বাড়িতে ছিল সঙ্গীতের আনাগোণা। এসরাজ বাজানোর পাশাপাশি শুক্লা হালদার গানের সাথেও যুক্ত ছিলেন। তাই ৩-৪ বছর বয়সেই মায়ের কাছে গানের হাতেখড়ি হয় শৌণকের।
শৈশব থেকে সঙ্গীতের আবহেই বড় হয়েছেন শৌণক; তাই মায়ের হাতে এসরাজ দেখে যন্ত্রশিক্ষার সুপ্ত বাসনাও হয়তো তার মনের মধ্যে ছিল। পরবর্তী সময়ে মায়ের কাছ থেকে যখন সারেঙ্গী শিক্ষার অনুরোধ পান, তখন থেকেই শুরু হয় শৌণকের নতুন এক দুনিয়ায় যাত্রা।
শৌণকের সারেঙ্গী যাত্রা
শৌণকের বিগত ৫ বছরের সারেঙ্গী যাত্রায় যে নামটি বার বার উঠে এসেছে, সেটি হলো- বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়। সারেঙ্গী শিক্ষার গুরুকুল হিসেবে এই স্থানটি শৌণকের কাছে পরম পূজনীয় স্থান। বলাই বাহুল্য, বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয় বাংলাদেশের সঙ্গীত শিক্ষার অন্যতম পীঠস্থান হিসেবে পরিচিত।
বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ে শিক্ষা শুরুর অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে শৌণক বলেন, "২০১৮ সালে বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ে সারেঙ্গী এবং এসরাজের একটা ওয়ার্কশপ হয়েছিল। সেখানে আমার মা এসরাজ শিখতেন। সেই ওয়ার্কশপে মায়ের যিনি গুরুজী ছিলেন, তিনিই আমার গুরুজী। তিনি সারেঙ্গী এবং এসরাজ দুটোই বাজাতেন।"
"ওয়ার্কশপের সময় গুরুজী বলেছিলেন, কেউ যদি সারেঙ্গী শিখতে ইচ্ছুক থাকে তাহলে জানানোর জন্য- তিনি শেখাবেন। তখন মা আমার কাছে একদিন জানতে চাইলো, আমি সারেঙ্গী শিখতে চাই কিনা। এই যন্ত্রটি যেহেতু অনেক বিরল আর কেউ সেভাবে বাজায় না আমাদের দেশে বলতে গেলে, তাই শিখতে চাইলাম। এরপর একদিন ক্লাসে গেলাম, গুরুজীর বাজনা শুনলাম। আমার গুরুজী শ্রী দেবাশীষ হালদার। তখন সারেঙ্গী শুনে ভালো লাগা শুরু করলো আর সেভাবেই শুরু," বলেন তিনি।
সারেঙ্গী শেখার পূর্বে অন্য কোনো বাদ্যযন্ত্র শেখার সেরকম কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না শৌণকের। তাই মনপ্রাণ সঁপে সারেঙ্গীর প্রতিই দিয়েছেন একনিষ্ঠ মনোযোগ। প্রতিদিন চার ঘণ্টা ধরে সারেঙ্গীর অনুশীলন করতে হয় তাকে। শৌণক বলেন, "সারেঙ্গী খুবই কঠিন একটি যন্ত্র। এটি ৩টি আঙ্গুলের উল্টো পাশ দিয়ে ঘষে ঘষে বাজাতে হয়। তাই নিয়মিত রেওয়াজ প্রয়োজন। একদিন রেওয়াজ না করলেই দেখা যায় আঙ্গুলের দাগ চলে যায়। বিরতি দিয়ে রেওয়াজ করলে পরে বাজাতে কষ্ট হয়।"
শৌণকের ভাষ্যে, সারেঙ্গীর মূল তার হচ্ছে ৩টি। যেগুলো মূলত উটের নাড়ি দিয়ে বানানো হয়। ঐ তিনটি তারকেই বাম হাতের আঙ্গুলের নখের গোড়া দিয়ে ঘষে বাজাতে হয়। মূল তিনটি তারের পেছনে আরও ৩৫টি তার থাকে। যেগুলো আসলে তরফ তার হিসেবে পরিচিত। এই ৩৫টি তার সুর ধরে রাখতে সাহায্য করে। তাছাড়া সারেঙ্গী বাজানোর জন্য ধনুকাকৃতির যে মাধ্যমটি ব্যবহার করা হয়, সেটির নাম ছড়।
মায়ের সঙ্গে একই মঞ্চে পরিবেশনা!
ভারতীয় সারেঙ্গী বাদক ওস্তাদ সুলতান খানের বাজনা নিয়মিত শোনেন শৌণক। বাজনা শুনতে গিয়ে অনেক নতুন কিছু শেখার অভিজ্ঞতাও হয়েছে তার। এছাড়া বর্তমান সময়ের সারেঙ্গী বাদক মোমিন খানের বাজনারও ভক্ত তিনি। পরিবার থেকে নিয়মিত সারেঙ্গী চর্চার সমর্থন পেয়েছেন সৌনক। মা এবং বাবা দুজনেই ভীষণ উৎসাহ দিয়েছেন সারেঙ্গী শেখার জন্য।
বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের মাসিক বৈঠকে নিয়মিত বাজানোর চেষ্টা করেন শৌণক। একক বাজনা খুব বেশি না বাজালেও দলভিত্তিকভাবে সারেঙ্গী বাজিয়েছেন বহুবার। প্রথমদিন মঞ্চে উঠার অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে শৌণক বলেন, "প্রথম প্রথম অনেক ভয় করতো। প্রথম আমার একক পরিবেশনা বেঙ্গলের একটি বৈঠকে ছিল। তখন সামনে আরো অন্যান্য বিভাগের গুরুজীরা ছিলেন। তাদের সামনে বসে বাজানো, এটা অনেক কঠিন একটা বিষয় ছিল। প্রথম প্রথম একটু নার্ভাস লাগতো, তারপর আস্তে আস্তে নার্ভাসনেস কমে যায়।"
মায়ের সাথে একসাথে সারেঙ্গী বাজিয়ে ভীষণ আনন্দ পান শৌণক। একই মঞ্চে এসরাজ হাতে মা এবং সারেঙ্গী হাতে ছেলে এমন দৃশ্য চোখেরও আরাম দেয় খুব। শৌণক বলেন, "বেঙ্গলের একটি মাসিক বৈঠকে আমি, মা আর আরেকজন এসরাজ ও সারেঙ্গী বাজিয়েছি। ওটা আমাদের কোরাস পারফর্ম্যান্স ছিল। মায়ের সাথে বাজানোর একটা খুব ভালো অনুভূতি হয়েছিল সেসময়। এর আগেও মায়ের সাথে দুয়েকবার বাজিয়েছি। খুব ভালো লাগে, যখন আমি আর আমার মা একসাথে মঞ্চে বাজাই।"
কোক স্টুডিও বাংলায় বাজানোর সুযোগ
কোক স্টুডিওর সাথে যুক্ত হওয়ার অভিজ্ঞতাটাও মধুর শৌণকের কাছে। ২০২২ সালে কোক স্টুডিও বাংলা থেকেই সারেঙ্গী বাজানোর প্রস্তাব আসে। তখন এসএসসি পরীক্ষার সবে দু'মাস বাকি। শৌণক বলেন, "শুভেন্দু দাস শুভ, যিনি কোক স্টুডিও বাংলাতে গিটার বাজান, তিনি আমাকে একদিন 'দাঁড়ালে দুয়ারে' গানের স্যাম্পল দিয়ে ম্যাসেজ করলেন যে গানটা একটু সারেঙ্গীতে তুলে রাখতে। পরে কাজে আসবে। এরপর দাদা ফোন দিয়ে বললে, এই গানটা কোক স্টুডিওতে যাবে এবং পরে একদিন আমাকে ডাকবেন। তখন আমি এটা শুনে অনেক খুশি হয়েছিলাম, কোক স্টুডিওর মতো বড় একটা প্লাটফর্মে আমি সারেঙ্গী বাজাবো।"
প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হওয়ার পর শুভেন্দু দাস শুভ তার বাসায় ডেকে শৌণকের বাজনা শোনেন ও রেকর্ড করেন। পরবর্তী সময়ে সঙ্গীত শিল্পী শায়ান চৌধুরী অর্ণবও সারেঙ্গী বাজানো শোনেন শৌণকের। এরপর নানান আলোচনায় গানটি কীভাবে যাবে তা ঠিক হয়। শৌণকের ভাষ্যে, মাঝখানে তার এসএসসি পরীক্ষার জন্য বেশ কিছুদিনের বিরতি ছিল। এরপর ধীরে ধীরে রেকর্ডিং, শ্যুটিং-এর পর অবশেষে কোক স্টুডিওর কাজ শেষ করেন তিনি। নজরুলসঙ্গীত 'দাঁড়ালে দুয়ারে' গানে বাজানোর পরেও আরো কিছু গানে বাজানোর সুযোগ পান শৌণক।
বর্তমানে রাজধানীর মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি কলেজে প্রথম বর্ষে অধ্যয়ন করছেন শৌণক দেবনাথ ঋক। পড়ালেখার পাশাপাশি এখনো বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ে শিখে যাচ্ছেন সারেঙ্গী।
সারেঙ্গী উৎপত্তির গল্প
সারেঙ্গী যন্ত্রটির উৎপত্তিস্থল হিসেবে উত্তর ভারতকে ধরা হয়। মনে করা হয়, মুঘল শাসনামলে রাজস্থানের লোকসঙ্গীতের অনুষঙ্গ হিসেবে এই যন্ত্রটির উদ্ভব হয়েছিল। সারেঙ্গীকে সারিন্দা ও দিলরুবা বাদ্যযন্ত্রের কাছাকাছি রূপ বলে ধরা হয়। হিন্দু পুরাণ অনুসারে, ব্রহ্মা গন্ধর্বদের তাদের যন্ত্র হিসাবে সারেঙ্গী দিয়েছিলেন, যেটি পরবর্তী সময়ে পৃথিবীতে আনা হয়েছিল। নেপালের ইতিহাস অনুযায়ী, গাইন বা গন্ধর্ব হল সঙ্গীতজ্ঞদের একটি সম্প্রদায়। যাদেরকে মূলত তথ্য বা বার্তাবাহক এবং বিনোদনের মাধ্যম হিসাবে বরাদ্দ করা হয়েছিল। ধরা হয়, সপ্তদশ শতক থেকে সারেঙ্গী রাগসঙ্গীতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা শুরু করে।
শ্রী বিমলাকান্ত রায়চৌধুরীর 'ভারতীয় সঙ্গীতকোষ' বই থেকে জানা যায়, সারেঙ্গী একটি প্রাচীন ভারতীয় গ্রাম্য বাদ্যযন্ত্র। প্রায় ৫০০ বছর যাবৎ এই যন্ত্রটি উত্তর ভারতীয় সঙ্গীতে অনুষঙ্গী যন্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এতে সেতার বা এসরাজের মতো নির্দিষ্ট স্বর উৎপাদনের জন্য কোনো ঘাট নেই। এক হাতে ছড় টেনে টেনে এই যন্ত্রের মূল তারে সুর তোলা হয়। অন্য হাত তারের উপর চেপে ধরে ওই সুরকে স্বরে পরিণত করা হয়।
বাংলাদেশে সারেঙ্গীর চর্চা কিংবা অনুশীলন করেন এমন শিল্পী খুব কম রয়েছেন। যদিও বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত সারেঙ্গী বাদক মতিউর রহমান রয়েছেন। তবে বর্তমানে ধীরে ধীরে অনেকে সারেঙ্গী বাজনার দিকে ঝুঁকছেন।
শৌণকের কাছে সারেঙ্গী শেখার আবদারও করেছেন কয়েকজন। শৌণক নিজে এখনও শিক্ষার্থী হওয়ায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শেখানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। তবে কেউ সারেঙ্গী নিয়ে তার কাছে এলে নিজের জ্ঞান থেকে দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।
সারেঙ্গী নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে শৌণক বলেন, "আমি এটা নিয়ে এগোতে চাই। আমি সারেঙ্গী নিয়েই থাকতে চাই এবং ভবিষ্যতে পড়াশোনার পাশাপাশি সারেঙ্গীকে আমার প্যাশন হিসেবে নিতে চাই।"