আলু, পেঁয়াজ ও ডিমের দাম বেঁধে দিল সরকার
প্রতি কেজি আলুর সর্বোচ্চ খুচরা দাম ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা, প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা এবং প্রতি পিস ফার্মের ডিমের দাম ১২ টাকা নির্ধারণ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। উর্ধ্বমুখী বাজার নিয়ন্ত্রণে এসব পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
বর্তমানে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আলু ৪৫ থেকে ৫০ টাকা এবং প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৭০ থেকে ৮০ টাকা এবং প্রতি পিস ফার্মের ডিম ১২ থেকে ১৩ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর (বুধবার) সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত 'কৃষি পণ্যের মূল্য পর্যালোচনা সংক্রান্ত' সভায় ডিম, আলু ও পেঁয়াজের খুচরা পর্যায়ের দাম বেঁধে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নাহিদ রশিদ, কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার, ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশন, ভোক্তা অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ এসোসিয়েশন ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলন করে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আলু, পেঁয়াজ ও ডিমের দাম ঘোষণা করেন। একইসাথে ভোজ্যতেলের দামও ঘোষণা করেন মন্ত্রী।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, খুচরা পর্যায়ে প্রতিটি ডিম ১২ টাকায় বিক্রির সিদ্ধান্ত যদি ব্যবসায়ীরা না মানেন, তাহলে পণ্যটি আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে ডিম আমদানির অনুমতি চেয়ে ব্যবসায়ীদের আবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা আছে। এছাড়া হিমাগার থেকে বেশি দামে আলু বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গেলে নিলাম করে নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি করে দেওয়া হবে।
টিপু মুনশি বলেন, 'উৎপাদন খরচ হিসাব করে আমরা দেখেছি ডিম, আলু ও পেঁয়াজ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। সেজন্য আমরা কৃষি এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসে এই দাম নির্ধারণ করেছি।'
একইসঙ্গে কোল্ড স্টোরেজ পর্যায়ে প্রতি কেজি আলু ২৬ থেকে ২৭ টাকা, দেশি পেঁয়াজ পাইকারি পর্যায়ে ৫৩ থেকে ৫৪ টাকা এবং প্রতিটি ফার্মের ডিম উৎপাদন পর্যায়ে ১০.৫০ টাকা দর নির্ধারণ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানায়, দাম বেঁধে দেওয়া তিন কৃষিপণ্য কী দামে বিক্রি হচ্ছে, তা তদারকিতে শুক্রবার থেকে নামবে জাতীয় ভোক্তা–অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পাশাপাশি জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, কৃষি ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মাঠে কাজ করবেন। আইন অনুযায়ী দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
টিপু মুনশি জানান, উৎপাদক, পাইকারী এবং খুচরা পর্যায়ের খরচ ও মুনাফা বিবেচনায় নিয়েই এসব পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। এখানে কারো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সুযোগ নেই। যদি কেউ বেশি মুনাফা লাভের জন্য অবৈধ মজুদ বা অন্য কোনো বেআইনি কাজ করে তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সভায় উপস্থাপন করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবছর দেশে ১ কোটি ১২ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ২.৮৩% বেশি। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কোল্ডস্টোরেজে আলু সংরক্ষণ করা হয়। এ বছর আলু সংরক্ষণের সময় প্রতি কেজির গড় দর ছিলো ১২ টাকা। আর কোল্ডস্টোরেজে প্রতি কেজির সংরক্ষণ ব্যয় ৫ থেকে ৬ টাকা। ফলে আলুর দাম ৪৫ টাকা বা তার বেশি হওয়ার কোনো কারণ নেই।
অপরদিকে প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে এবছর দেশের চাহিদার চেয়ে ১৩৪ কোটি ৫৮ লাখ পিস বেশি ডিমের সরবরাহ রয়েছে। অতিরিক্ত সরবরাহ থাকার পরেও ডিমের দাম বৃদ্ধির কোনো কারণ নেই। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রতি পিস লাল ডিম বাংলাদেশি টাকায় ৬.৫০ টাকা এবং সাদা ডিম ৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া পেঁয়াজের চাহিদার বিপরীতে স্থানীয় উৎপাদন ও আমদানি বিবেচনায় সরবরাহে ঘাটতি নেই। বাংলাদেশ ট্রেড ও ট্যারিফ কমিশন মনে করছে, বাজারে দেশি পেয়াজের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা হতে পারে।
এসময় বাণিজ্যমন্ত্রী প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ৫ টাকা কমানোর ঘোষণাও দেন। তিনি বলেন, এখন থেকে পরবর্তী ঘোষণার আগ পর্যন্ত প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬৯ টাকা দরে বিক্রি হবে। আর প্রতি লিটার খোলা পাম তেল বিক্রি হবে ১২৪ টাকা দরে।
গত কয়েক মাস ধরে আলু, পেঁয়াজ ও ডিমের বাজারে ব্যাপক অস্থিরতা চলছে। প্রতি পিস ডিম ১৫ টাকা বা তার বেশিতেও বিক্রি হয়েছে। আলু বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা দরে, যা গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। পেঁয়াজের দামও হঠাৎ করে কেজিতে ২০ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
এ অবস্থায় গত আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১২.৫৪%, যা গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান গত মঙ্গলবার একনেক পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ডিম ও মুরগীর দামের কারণে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন ও আমদানির মাধ্যমে পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেও শুধুমাত্র বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে কিছু পণ্যে অযৌক্তিকভাবে দাম বেড়েছে। যেখানে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী অতিরিক্ত মুনাফা করছেন। অন্যদিকে খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষ জীবনযাপন করতে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেকে চাহিদা ছেঁটে, নিম্ন পুষ্টিমানের খাবার খেয়ে ব্যয় সংকুলান করছেন।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সাধারণ মানুষের আয় বৃদ্ধি, বাজারে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা এবং বাজারে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে আইনের কঠোর প্রয়োগের পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
এছাড়াও ভারতে ইলিশ রপ্তানির বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে টিপু মুনশি জানান, সারা বছর ভারতে ইলিশ রপ্তানি করা হয় না। পূজা উপলক্ষে ভারতীয় বাঙালিদের নিকট শুভেচ্ছা উপহার হিসেবে দেশে যা উৎপাদন হয় তার সামান্য পরিমাণ রপ্তানি করা হয়।
কী পরিমাণ রপ্তানি করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চার থেকে পাঁচ হাজার টনের বেশি নয়।