যন্ত্রপাতি ও ল্যাব অচল, দুর্ভোগে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রোগীরা
ঢাকার বাইরে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালই (সিএমসিএইচ) একমাত্র সরকারি হাসপাতাল যেখানে ব্র্যাকিথেরাপি মেশিন আছে। নারীদের জরায়ু ক্যান্সারের চিকিৎসায় এই মেশিন ব্যবহৃত হয়। অথচ এই ধরনের অত্যাবশ্যক একটি সরঞ্জাম গত বছরের জুন থেকে অকার্যকর অবস্থায় পড়ে আছে।
কেবল এটিই নয়, স্তন টিউমার/ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য ব্যবহৃত ম্যামোগ্রাফি মেশিনটিও এক বছর ধরে অচল। এমআরআই এবং সিটি স্ক্যানের মতো অতি প্রয়োজনীয় দুটি মেশিনেও প্রায়ই সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়া দুটি ক্যাথ ল্যাবের মধ্যে একটি ২১ মাস ধরে বন্ধ আছে।
এসব মেশিনে ত্রুটির কারণে ভোগান্তিতে পড়তে হয় রোগীদের। অনেক সময় প্রাইভেট ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে ব্যয়বহুল পরিষেবা নেওয়া ছাড়া তাদের আর কোন উপায় থাকে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মেশিনগুলি মেরামত করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোর ডিপো এবং সরঞ্জাম সরবরাহকারীদের কাছে কয়েকবার চিঠি দিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত আবেদনের প্রেক্ষিতে কোনো ফলাফল পাওয়া যায়নি।
ব্র্যাকিথেরাপি মেশিন ১৫ মাস ধরে বন্ধ
সিএমসিএইচ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালে প্রায় ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে জার্মানি থেকে আমদানি করা ব্র্যাকিথেরাপি মেশিনটি হাসপাতালে বসানো হয়।
গত বছরের ৬ জুন মেশিনের কিছু খুচরা যন্ত্রাংশ অকার্যকর হয়ে যাওয়ার পরে সরবরাহকারী প্রকৌশলীরা সেগুলো প্রতিস্থাপনের সুপারিশ করেন। কিন্তু সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোর ডিপোর একটি প্যাকেজের বিল অপরিশোধিত থাকায় মেশিনটি মেরামত করা হচ্ছে না।
প্রতি বছর সিএমসিএইচ এর বহিঃবিভাগের ৫,০০০-৭,০০০ নতুন রোগীদের বেশিরভাগকে ব্র্যাকিথেরাপি করতে হয়।
বর্তমানে রাজধানীর বেসরকারি হাসপাতালে ব্র্যাকিথেরাপির একটি সেশনের খরচ ৫,০০০ টাকা, যা সরকারি হাসপাতালে ১,৫০০ টাকা।
এমআরআই মেশিনে ৪ বছরে কয়েকবার ত্রুটি
২০১৭ সালের আগস্টে ৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি এমআরআই মেশিন বসায় সিএমসিএইচ। তিন বছরের ওয়ারেন্টির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ২০২০ সালের শেষ দিকে তা নষ্ট হয়ে যায়।
এরপর ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে সরবরাহকারী কোম্পানি মেডিটেল প্রাইভেট লিমিটেডকে দিয়ে মেশিনটি মেরামত করানো হয়। গত বছরের মে মাসে ত্রুটির কারণে ইমেজিং মেশিনটি বেশ কয়েকবার সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে পড়ে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিএমসি নির্দেশিকা অনুযায়ী, মেশিন সরবরাহের পর প্রথম বছরে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মোট দামের ৬.৫ শতাংশ ব্যয় করার কথা। সে অনুযায়ী, এমআরআই মেশিন রক্ষণাবেক্ষণে খরচ হওয়ার কথা আনুমানিক ৬৩.৯৬ লাখ। কিন্তু হাসপাতালের একটি সূত্র জানায়, সরবরাহকারী কোম্পানি মেশিন মেরামতে ৯৩ লাখ টাকা দাবি করে।
একটি এমআরআই স্ক্যানের জন্য বেসরকারি হাসপাতালে খরচ পড়ে ৫,০০০ থেকে ২০,০০০ টাকা। আর সরকারি হাসপাতালে চার হাজার বা তারচেয়ে কিছুটা বেশি।
হাসপাতালের এক কর্মকর্তা জানান, ব্যবহার বিবেচনায় বেসরকারি হাসপাতালের চেয়ে সরকারি হাসপাতালের এমআরআই মেশিন বেশিদিন টেকসই হওয়ার কথা। বেসরকারি হাসপাতালে মেশিনগুলো প্রায় ১০ বছর টেকে।
সিটি স্ক্যান মেশিন ৩ মাসে ৩ বার বিকল
মাথায় আঘাতের পরে মস্তিষ্কের অবস্থা মূল্যায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সিটি স্ক্যান মেশিন গত তিন মাসে তিনবার বিকল হয়েছে।
প্রথমবার ৬ জুন তা নষ্ট হয়। ১৯ দিন পর মেরামত শেষে ২৫ জুন মেশিনটি চালু হয়।
৪ আগস্ট ফের ত্রুটি দেখা দেয় এবং আবার মেরামত করে ২ সেপ্টেম্বর থেকে চালু করা হয়। তবে
একদিন পরই তা আবার নষ্ট হয়ে যায়। তারপর থেকে মেশিনটি এভাবেই পড়ে আছে।
কার্যকর অবস্থায় প্রতিদিন ৩০-৫০ জন রোগী সিটি স্ক্যান করাতেন। সরকারি হাসপাতালের একটি সিটি স্ক্যানে খরচ পড়ে ২,০০০ থেকে ৪,০০০ টাকা। আর বেসরকারি হাসপাতালে একই পরীক্ষার জন্য খরচ হয় ৩,০০০ থেকে ১০,০০০ টাকা।
ম্যামোগ্রাফি মেশিন এক বছর ধরে বন্ধ
নারীদের স্তন টিউমার/ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য ব্যবহৃত ম্যামোগ্রাফি মেশিনটি এক বছর ধরে অচল। এতে রোগ নির্ণয়ে বেসরকারি হাসপাতালে প্রায় ২,০০০-৩,০০০ টাকা খরচ করতে হয় রোগীদের। যেখানে সরকারি হাসাপাতালে এতই পরীক্ষার জন্য খরচ হয় ৮০০ টাকা।
২০১৮ সালের আগস্ট মাসে স্থাপনের পর থেকে মেশিনটি চারবার নষ্ট হয়েছে। সম্প্রতি হাসপাতাল থেকে বারবার আবেদন করা সত্ত্বেও মেশিনটির সরবরাহকারী নিউ টেক জিটি লিমিটেড মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
২১ মাস ধরে বন্ধ ক্যাথ ল্যাব
হাসপাতালটির কার্ডিওলজি বিভাগে দুটি ক্যাথেটারাইজেশন ল্যাবরেটরি বা ক্যাথ ল্যাবের মধ্যে একটি ২১ মাস ধরে বন্ধ। এতে রোগীদের পেসমেকার স্থাপন এবং এনজিওগ্রামের মতো পরিষেবা দিতে অসুবিধা হচ্ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, ল্যাব মেরামতে ব্যয় হবে ১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা।
সিএমসিএইচ এর ৬০ শয্যার কার্ডিওলজি বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ জন রোগী চিকিৎসা সেবা নেন। অর্ধেক রোগীকে স্টেন্টিং, পেসমেকার ইমপ্লান্টেশন, এনজিওগ্রাম এবং এনজিওপ্লাস্টি করতে হয়।
বর্তমানে, চালু থাকা ল্যাব দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ১৫-২০ রোগীকে এনজিওগ্রাম এবং পেসমেকার স্থাপন সেবা দেয়। এবং প্রায় ৩-৫ জন রোগীকে রিং পরানো হয়।
এমন পরিস্থিতিতে, কিছু রোগীকে সিএমসিএইচে কার্ডিয়াক সেবার জন্য দুই থেকে তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়। আবার অনেকে দ্রুত চিকিৎসা করাতে বেসরকারি হাসপাতালে ছুটে যান।
জনস্বাস্থ্য অধিকার সংরক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক মাহফুজুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, হাসপাতালের এসব যন্ত্রপাতি না থাকায় সুবিধাবঞ্চিত রোগীরা চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বেসরকারি হাসপাতালে যাওয়ার সামর্থ্য তাদের নেই।
সিএমসিএইচের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ শামীম আহসান টিবিএসকে বলেন, মেশিন এবং ল্যাব মেরামতের জন্য আমরা বারবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়েছি। মেরামতের জন্য আমাদের সরবরাহকারীদের উপর নির্ভর করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, কতকাব মেশিনগুলো নষ্ট হয়েছে এবং কতদিন চালু আছে তা আমরা তদন্ত করছি। এই সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।