রুশ স্পাইদের খেলার মাঠ এখনো লাতিন আমেরিকাই!
গত ১৮ মাসে ইউরোপে অনেক সন্দেহভাজন রাশিয়ান স্পাইর (গুপ্তচর) সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। নেদারল্যান্ড থেকে নরওয়ে, সুইডেন থেকে স্লোভেনিয়া — সব দেশেই ধরা পড়েছেন রাশিয়ান স্পাইরা।
ধৃত এসব স্পাইদের অনেকের মধ্যে একটি বিষয়ের মিল রয়েছে। সেটি হলো, তাদের মধ্যে আমেরিকা মহাদেশের একটি সংযোগ রয়েছে। এসব স্পাইদের গ্রেপ্তার থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের মতো এখনো লাতিন আমেরিকা রাশিয়ান স্পাইদের গঠন ও মিশন পরিচালনার জন্য পছন্দের স্থান।
ভিক্টর মুলার ফেরেইরা'র কথা ধরা যাক। ২০২২ সালের এপ্রিলে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ইন্টার্নিশিপে যোগ দিতে আসেন তিনি। কিন্তু দ্রুতই তাকে ফেরত পাঠানো হয়।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি আদতে সার্গেই ভ্লাদিমিরোভিশ চেরকাসভ, একজন 'ইলিগ্যাল' তথা রাশিয়ার সামরিক গোয়েন্দাসংস্থা জিআরইউ গোয়েন্দা কর্মকর্তা। যেসব গোয়েন্দা নকল কূটনৈতিক পরিচয়ের আড়ালে কাজ না করে ভুয়া পরিচয় তৈরি করে কাজ করেন, তাদেরকে ইলিগ্যাল বলা হয়।
এ ঘটনার পর আরও অনেক রাশিয়ান স্পাই ইউরোপে ধরা পড়তে শুরু করেন। যেমন অক্টোবরে কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করা ব্রাজিলিয়ান হোসে আসিস গিয়াম্মারিয়াকে গ্রেপ্তার করে নরওয়ে। তিনি আদতে মিখাইল মিকুশিন, আরেক জিআরইউ কর্মকর্তা।
একই বছরের ডিসেম্বরে স্লোভেনিয়া মারিয়া মেয়ার ও লুডউইগ গিশ নামক এক আর্জেন্টাইন দম্পতিকে পাকড়াও করে। তারা দুজন আদতে রাশিয়ার ফরেইন স্পাই এজেন্সি এসভিআর-এর সদস্য ছিলেন।
২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে রিও ডি জেনিরোতে বসবাসকারী অস্ট্রিয়ান-ব্রাজিলিয়ান গের্হার্ড দানিয়েল ক্যাম্পোস ভিটিশ হঠাৎ উধাও হয়ে যান। তার আসল নাম শিমেরেভ। তিনি গোপনে বিয়ে করেছিলেন আরেক জিআরইউ অফিসার ইরিনা শিমেরেভকে। অ্যাথেন্সে বাস করা ইরিনা মারিয়া সালা নামক মেক্সিকান নারীর ভেক ধরেছিলেন।
ডিপ-কাভার অফিসারদের জন্য মিথ্যা পরিচয় গড়ে তুলতে লাতিন আমেরিকা মহাদেশকে দীর্ঘদিন ধরে উপযুক্ত স্থান হিসেবে বিবেচনা করেছে রাশিয়ান স্পাইরা। কানাডিয়ান ব্যবসায়ী গর্ডন লন্সডেল পরিচয়ে ১৯৫৩ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত ব্রিটেনে সফল গুপ্তচরবৃত্তির ক্যারিয়ার তৈরি করেছিলেন কনোন মলোদি।
২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্র কয়েক ডজন অবৈধ গুপ্তচরের সন্ধান পায়। এদের মধ্যে চারজনই ছিল কানাডার পরিচয়ধারী।
লন্ডনের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির কেভিন রাইল বলেন, 'দীর্ঘসময় ধরে স্পাইরা পাসপোর্টের জন্য কানাডার শরণাপন্ন হতো।' অতীতে কানাডার পাসপোর্ট পাওয়া যেমন সহজ ছিল, তেমনি এ পাসপোর্ট ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে খুব সহজেই ভ্রমণ করা যেত।
কেন্দ্রীয়ভাবে রেকর্ড রাখার কোনো ব্যবস্থা ছিল না কানাডার, বলেন অটোয়ার কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিফানি কার্ভিন। এর ফলে মৃত কানাডিয়ান শিশুদের পরিচয় খুব সহজেই নকল করা যেত।
পরে 'নিন্দার' মুখে পড়ে পাসপোর্টের নিরাপত্তা বাড়াতে বাধ্য হয় কানাডা। এতে কানাডা থেকে ভুয়া পরিচয় তৈরি করতে না পেরে দক্ষিণে নজর দেয় রাশিয়ান স্পাইরা। 'বোধ হয় এ কারণেই আমরা এখন প্রচুরসংখ্যক লাতিন আমেরিকান স্পাই [ইলিগ্যাল] দেখছি,' বলেন রাইল।
তবে লাতিন আমেরিকাকে বেছে নেওয়ার আরেকটি কারণ হলো এ অঞ্চলের দুর্নীতি। যেমন, চেরকাসভ গর্ব করেই জানিয়েছেন, তিনি একজন ব্রাজিলিয়ানকে (সম্ভবত স্থানীয় কোনো কর্মকর্তা) ৪০০ ডলারের একটি নেকলেস উপহার দিয়ে কোনো কাগজপত্র ছাড়াই নাগরিকত্ব, জন্মসনদ ও ড্রাইভিং লাইসেন্স তৈরি করে নিয়েছিলেন।
লাতিন আমেরিকা অঞ্চল গিজগিজ করে মার্কিন কর্মকর্তা ও অন্যদের দিয়ে। এ অঞ্চলে মার্কিনীদের কর্মকাণ্ড জানতে ইচ্ছুক রাশিয়ানরা। এ জন্যই লাতিন আমেরিকা রাশিয়ানদের জন্যও সমানভাবে আকর্ষণীয়।
যুক্তরাষ্ট্রের নর্দার্ন কমান্ডের প্রধান জেনারেল গ্লেন ভ্যানহ্যার্ক গত বছর তার পর্যবেক্ষণে জানান, বিশ্বের অন্য কোনো দেশের তুলনায় মেক্সিকোতে সবচেয়ে বেশি জিআরইউ সদস্য রয়েছেন।
ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে লাতিন আমেরিকায় রুশ স্পাইরা কম তদন্ত বা নজরদারির মধ্যে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন। ১০–২০ বছর আগে এর কারণ ছিল, লাতিন আমেরিকার স্থানীয় গোয়েন্দাসংস্থাগুলো, কিছু ব্যতিক্রম বাদে, অতটা দক্ষ ছিল না। তাদের পর্যাপ্ত রসদেরও অভাব ছিল।
লাতিন আমেরিকায় মার্কিন গোয়েন্দাসংস্থা সিআইএ-এর সাবেক অপারেশন প্রধান ডুয়েন নরম্যান বলেন, 'এখন অবশ্য প্রযুক্তির কল্যাণে তারা অনেক সক্ষম হয়ে উঠেছে।'
তবে দক্ষ হলেও রাশিয়ান স্পাইদের তাড়ানোর কোনো ইচ্ছাই হয়তো লাতিন স্পাইদের নেই। লাতিন আমেরিকার অনেক গোয়েন্দাসংস্থাই এ অঞ্চলে রাশিয়ার এসব কর্মকাণ্ডের প্রতি বেশ উদার দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে।
ব্রাজিল পুলিশ অবশ্য শেষতক চেরকাসভের কর্মকাণ্ডের তদন্ত চালিয়েছিল। তার ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি যুক্তরাষ্ট্রে কাছে হস্তান্তর করেছিল। তবে চেরকাসভকে বিচারের জন্য আমেরিকায় পাঠানোর অনুরোধ ব্রাজিল সরকার রাখেনি। এমনকি তার কারাদণ্ড ১৫ বছর থেকে কমিয়ে পাঁচ বছর করা হয়।
আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল উভয় দেশের গোয়েন্দাসংস্থাতেই রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। এসব দেশে নতুন সরকার ক্ষমতায় এলে গোয়েন্দাবাহিনীগুলোর বড় বড় পদের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার পরিবর্তন ঘটে।
রাজনৈতিক ও আদর্শগত; উভয় কারণেই এ দুটি দেশের কোনোটিই রাশিয়ার সঙ্গে বিবাদে যেতে চায় না। ব্রাজিলের মোট সারের এক-পঞ্চমাংশ আসে রাশিয়া থেকে। আর্জেন্টিনার ক্ষেত্রে এ হার এক-দশমাংশ।
লাতিন আমেরিকার অনেক সরকারই যুক্তরাষ্ট্রের মতো রাশিয়াকে ভূরাজনৈতিক ভিলেইন হিসেবে দেখে না। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাশিও লুলা দা সিলভা চলমান ইউক্রেনযুদ্ধের জন্য ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে 'পুতিনের মতোই সমান দায়ী' করেছেন।
পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। গত বছর ৬০০-এর বেশি সন্দেহভাজন রাশিয়ান গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে ইউরোপের বিভিন্ন রুশ দূতাবাস থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। লাতিন আমেরিকাজুড়ে অনেক রাশিয়ান স্পাইয়ের কথা প্রায়ই জানা যাচ্ছে।