কাঁচামালের দাম আর চাহিদা কমেও প্রভাব পড়েনি রডের উর্ধ্বমুখী মূল্যে
দেশীয় বাজারে ইস্পাতের কাঁচামালের (স্ক্র্যাপ, প্লেট ও বিলেট) দাম অস্বাভাবিক কমেছে। তিন মাসের ব্যবধানে পাইকারি পর্যায়ে এসব পণ্যের দাম কমেছে টনে ১৫-১৯ হাজার টাকা পর্যন্ত। তবে কাঁচামালের দাম কমলেও কমছে না ইস্পাত পণ্য এমএস রডের দাম। দীর্ঘদিন ধরে উর্ধ্বমুখী থাকা রডের দাম কিছুটা কমে এখনো টনপ্রতি ৯৫ হাজার টাকার ঘরে।
শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে ইয়ার্ডে প্রতিটন স্ক্র্যাপ বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৫৪ হাজার টাকায়। মে মাসের শেষ দিকে এই স্ক্র্যাপের দাম ছিল ৭০-৭১ হাজার টাকা। সে হিসেবে, গেল তিন মাসে প্রতি টন স্ক্র্যাপের দাম কমেছে কমপক্ষে ১৮ হাজার টাকা।
স্ক্র্যাপের পাশাপাশি কমে এসেছে ইস্পাতের কাঁচামাল প্লেট ও বিলেটের দামও। বর্তমানে বাজারে প্রতি টন প্লেট ৬৩ হাজার টাকা ও বিলেট ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তিন মাস আগে বাজারে প্রতিটন প্লেট ৮২ হাজার টাকা ও বিলেট ৮৫ হাজার টাকায় বিক্রি হতো। সে হিসেবে, তিন মাসের ব্যবধানে বাজারে প্রতি টন প্লেটে ১৯ হাজার টাকা ও বিলেটে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম কমে গেছে।
শিপব্রেকিং ইয়ার্ড মালিকরা জানিয়েছেন, অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধির কারণে ইস্পাত পণ্য এমএস রডের চাহিদা ও উৎপাদন কমে গেছে। বিশেষ করে ডলার সংকটে সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প ছাড়া অন্যান্য প্রকল্পগুলো অনেকটা স্থবির। এছাড়া বর্ষার কারণেও ইস্পাতের চাহিদা কমেছে। এতে কারখানা পর্যায়ে রডের উৎপাদন কমে যাওয়ায় রড তৈরির কাঁচামাল স্ক্র্যাপের চাহিদা কমে গেছে। ফলে গত তিন মাস ধরে জাহাজ ভাঙ্গার প্রধাণ উপকরণ স্ক্র্যাপ পণ্যের দাম অস্বাভাবিক কমে গেছে।
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স এন্ড রিসাইক্লার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি আবু তাহের বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে গত তিন-চার মাস ধরে স্ক্র্যাপ ও পুরানো জাহাজের দাম কমেছে। তবে দিন দিন ডলারের দাম (বিনিময় মূল্য) বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানিকৃত জাহাজের বিপরীতে বেশি টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। এদিকে ইস্পাতের কারখানাগুলোতে কাঁচামালের চাহিদা কমে যাওয়ায় স্ক্র্যাপ, প্লেট ও বিলেটের দাম কমে গেছে। এতে লোকসানের ঝুঁকিতে রয়েছেন জাহাজভাঙ্গা শিল্পের ব্যবসায়ীর।
গো শিপিং ডট নেটের তথ্যমতে, আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে প্রতি টন স্ক্র্যাপ বিক্রি হচ্ছে ৪৯৫-৫০৫ ডলারে। যা গেল মার্চ-মে মাসে ৬২০ ডলারের বেশি দামে বিক্রি হয়েছে। সেই হিসেবে, গত তিন-চার মাসের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপ জাহাজের দাম টনে ১২০ ডলারের বেশি কমে গেছে, যা বাংলাদেশি টাকায় ১৪ হাজার টাকা।
এদিকে স্ক্র্যাপ সহ সব কাঁচামালের দাম অস্বাভাবিক কমলেও এখনো আগের বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে ইস্পাত খাতের প্রধান পণ্য এমএস রড। দীর্ঘদিন ধরে উর্ধ্বমুখী থাকা পণ্যটির দাম এখনো ৯৩-৯৫ হাজার টাকার ঘরে। তবে অতিরিক্ত দামের কারণে বাজারে পণ্যটির চাহিদা ও বিক্রি কমে গেছে বলে জানিয়েছেন রড উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীরা।
এমএস রড ব্যবসায়ী ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যমতে, বর্তমানে বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মধ্যে ৭৫ গ্রেডের (৫০০ টিএমটি) এমএস রড বিক্রি হচ্ছে ৯৩ হাজার থেকে ৯৫ হাজার টাকায়। যা গত আড়াই বছর ধরে দফায় দফায় বেড়ে গেল মার্চে লাখ টাকায় পৌঁছে।
৭৫ গ্রেডের রডের মধ্যে বর্তমানে বিএসআরএম ৯৫ হাজার টাকা, একেএস ৯৪ টাকা, কেএসআরএম ও জিপিএইচ ৯৩ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত দুই মাসে টনে সর্বোচ্চ ৫ হাজার কমেছে এসব ব্র্যান্ডের রড।
একই সময়ে টনে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত কমেছে ৬০ গ্রেডের এমএস রডের দামও। বর্তমানে অটো মিলের ৬০ গ্রেডের এমএস রডের মধ্যে এইচএম ও গোল্ডেন স্টিল ৮৭ হাজার টাকা, বায়েজিদ স্টিল ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা ও কে আর স্টিল ৮৩ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া সেমি অটো কারখানার মধ্যে এসএস, আল ছাফা, মাস্টার, জিরি, চম্পা, এসএল ও খলিল স্টিলের রড ৭৯-৮০ হাজার টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। গত তিন মাস আগে বাজারে ৬০ গ্রেডের বিভিন্ন কোম্পানির এম এস রড ৯০ হাজার টাকার উপরে বিক্রি হয়েছে।
ইস্পাত খাতের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে দফায় দফায় বাড়তে থাকে রডের বাজার। ২০২০ সালের অক্টোবরে সর্বোচ্চ ৫৫ হাজার টাকায় বিক্রি হওয়া পণ্যটি আড়াই বছরে দফায় দফায় বেড়ে চলতি বছরের মার্চে লাখ টাকায় পৌঁছে। তবে দাম বৃদ্ধির ফলে নির্মাণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় আবাসন ও অন্যান্য খাতের নির্মাণকাজ স্থবির হয়ে পড়ায় রডের চাহিদা ও বিক্রি কমে গেছে।
এইচএম স্টিলের পরিচালক সারওয়ার আলম বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাবে দেশীয় বাজারেও রডের দাম কিছুটা কমে এসেছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে যে পরিমাণ কমেছে দেশীয় বাজারে সেভাবে কমানো সম্ভব হয়নি। কারণ দেশীয় বাজারে ডলারের বিনিময় মূল্য অনেক বেশি। এখন আমাদের ১১৮-১১৯ টাকায় আমদানি মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে। তাছাড়া অতিরিক্ত দামের কারণে বাজারে রডের চাহিদা ও বিক্রি দুটিই কমে গেছে। এতে আমাদের উৎপাদন কমাতে হলেও খরচ কমাতে পারছি না। ফলে কাঁচামালের দাম কমার সেই সুফলটা পাচ্ছে না গ্রাহকরা।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএমএ) এর তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে প্রতিবছর ৭০-৭৫ লাখ টন এমএস রডের চাহিদা রয়েছে। দেশের প্রায় ৫৫টি অটো স্টিল রি-রোলিং মিলস ও শতাধিক সেমি অটো ও ম্যানুয়াল মিলস এসব রডের যোগান দিয়ে থাকে।
দেশের শীর্ষ রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম এর ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর তপন সেনগুপ্ত বলেন, বর্তমানে যে দামে রড বিক্রি হচ্ছে তার চেয়ে আর বেশি কমানোর সম্ভাবনা নেই। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের বুকিং দর কমলেও ডলার প্রাইস, গ্যাস-বিদ্যুতের উর্ধ্বমুখী দাম মিলে রডের উৎপাদন খরচ বর্তমান দামের চেয়ে বেশি। তিনি আরো বলেন, বর্ষাকালে নির্মাণ কাজ কম হয়। যে কারণে চাহিদা কমে রডের দামও কিছুটা কমে এসেছে।
চট্টগ্রামের পাইকারি রড ব্যবসায়ী মেসার্স খাজা মেটালের স্বত্বাধিকারী আলমগীর হোসেন বলেন, রডের দাম লাখ টাকায় পৌঁছার পর থেকে অনেকে নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিয়েছে। এছাড়া ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে সরকারের অনেক প্রকল্পের নির্মাণকাজ এখন স্থবির। যে কারণে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে রডের বেচাকেনা একদম কমে গেছে। স্বাভাবিক সময়ে আমরা প্রতিদিন ৩০-৪০ গাড়ি (প্রতি গাড়ি ২৪ টন) রড বিক্রি করলেও তা এখন ১০ গাড়ির নিচে নেমে এসেছে। রডের বাজারকে চাঙ্গা করতে হলে রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে পণ্যটির দাম কমিয়ে আনতে হবে বলে মনে করছেন এই ব্যবসায়ী।