চীনকে ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের ভারতকে দরকার, আর মোদি তা জানেন
এ বছরের জুন মাসে কানাডার মাটিতে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী এক নেতাকে হত্যার ঘটনায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে কাছের একটি মিত্র ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূরাজনৈতিক অংশীদারের মধ্যে সম্পর্কে চিড় ধরেছে। আর এ ঘটনায় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতির একটি পরিহাসজনক রূপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
হুমকির মুখে পড়া বর্তমান বিশ্বব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে বাইডেন চাচ্ছেন ভারতের উত্থানকে দ্রুত করতে। তবে ভারত শক্তিশালী হলে এটি মাঝেমধ্যে এমন সব আচরণ করবে যা ওয়াশিংটনের অভীষ্ঠ বিশ্বব্যবস্থাকেই চ্যালেঞ্চের মুখে ফেলবে। কিন্তু যেমনটা এশিয়া বিশেষজ্ঞ কার্ট ক্যাম্পবেল বলেছিলেন, যদি বাইডেনের সরকার মনে করে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে 'এ গ্রহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক' রয়েছে, তাহলে সেক্ষেত্রে এ সম্পর্ককে অক্ষত রাখতে ওয়াশিংটন হয়তো ভারতের অনেক কটু আচরণও সহ্য করবে।
যুক্তরাষ্ট্র–ভারত সহায়তায় দুই দেশের ভূরাজনৈতিক আঙ্গিক প্রশ্নাতীত। সেই ১৯০৪ সালে ব্রিটিশ ভূতাত্ত্বিক ও রাজনীতিবিদ স্যার হালফোর্ড ম্যাকিন্ডার কেন তা ব্যাখ্যা করেছিলেন।
তিনি লিখেছিলেন, প্রযুক্তি ও স্বেচ্ছাচার দুটোরই আধুনিকায়নের সুবাদে আগ্রাসি শক্তিগুলোর ইউরেশিয়ায় আধিপত্য স্থাপন ও এর সম্পদে নিয়ন্ত্রণ সৃষ্টির সম্ভাবনা ক্রমশ বাড়বে। তাই তিনি পরামর্শ দেন গ্রেট ব্রিটেন যেন কোরিয়া, ফ্রান্স ও ভারতে 'ব্রিজ হেড' তৈরি করে যার মাধ্যমে এটি ইউরেশিয়াকে বিভক্ত রেখে বিশ্বের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে।
বর্তমানে ইউরেশিয়ার একটি বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রের বৈরীরা — কলহপ্রিয় চীন, আগ্রাসি রাশিয়া, সম্প্রসারণবাদী ইরান — শাসন করছে। এক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখার ও বিশেষ করে চীনকে এ অঞ্চলে আধিপত্য স্থাপনে চ্যালেঞ্জ জানানোর মূলসূত্র হতে পারে ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারত।
বৈশ্বিক প্রযুক্তিগত সরবরাহ চেইনে ভারতের অবদান কম নয়। তেমনিভাবে উন্নয়নশীল বিশ্বের কূটনৈতিক নেতার ভূমিকাও রয়েছে দেশটির। এ কারণেই বাইডেন ইন্দো-মার্কিন সম্পর্ক জোরদারে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। মোদিকে তিনি ওয়াশিংটনে রাষ্ট্রীয় সফরে স্বাগত জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের মাধ্যমে মোদির নেতৃত্বকে সামনে আনার বিষয়ে সহায়তা করেছেন এবং দুই পক্ষের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও গাঢ় করার চেষ্টা করেছেন।
তবে এতকিছু সত্ত্বেও বাইডেন ভারতকে সম্ভাব্য সামরিক মিত্র হিসেবে বিবেচনা করেন না। তাইওয়ান নিয়ে চীনের সঙ্গে যুদ্ধ লাগলে নয়াদিল্লি সামরিক সহায়তা নিয়ে আমেরিকার পক্ষে ছুটে আসবে, এমনটা তিনি আশা করেন না। বিষয়টি হলো, আমেরিকা ও ভারত দুই দেশই এশিয়ায়, বা এমনকি সারাবিশ্বে, চীনের আধিপত্য ঠেকানোর বিরুদ্ধে একাট্টা। তাই ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত, সামরিকভাবে বলিষ্ঠ এবং অন্য যেকোনোভাবে চীনকে ঠেকানোর উপযুক্ত করতে সহায়তা করার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে সাহায্য করছে।
তবে বিষয়টির অতটাই সাদাসিধা নয়। যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট এক সময় স্বৈরতন্ত্র ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন, তিনিই এখন মোদির ভারতে মানবাধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কোনো আলোচনা-সমালোচনা না করে মুখ বন্ধ রেখেছেন।
একইভাবে ভারতও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণের বিরুদ্ধে বেশি উচ্চবাচ্য করেনি। বরং এ যুদ্ধ থেকে ভারত বেশ সুবিধা পেয়েছে। যুদ্ধের কারণে দেশটি রাশিয়া থেকে ছাড়মূল্যে তেল কিনতে পেরেছে। আর মোদি'র এজেন্টরা যদি আদতেই জুন মাসে কানাডায় হরদীপ সিংকে খুন করে থাকে, তাহলে বলতে হয়, তার সরকার চীন, রাশিয়া ও সৌদি আরবের মতো স্বৈরতান্ত্রিক দেশগুলোর আন্তঃদেশীয় আগ্রাসনকেই অনুকরণ করছে।
একটি আপাত-উদারনৈতিক দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার বিপদ হলো, এসব দেশ ওয়াশিংটনের বিবেচনায় উদারনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি ক্ষতিকারক কাজগুলোই করতে থাকে। তাই ভারত যদি যুক্তরাষ্ট্রের অপরিহার্য মিত্রও হয়, দেশটি বাইডেন যে ব্যবস্থাকে ধরে রাখতে চাইছেন তার প্রতি দ্বিমুখী আচরণ প্রকাশ করছে।
ভারত চীনের হেজিমনির বিরোধী, কিন্তু তার মানে এ নয় যে এটি আমেরিকার শক্তিকে পছন্দ করে। নয়াদিল্লি ওয়াশিংটন ও এর মিত্রদের প্রভাবসম্পন্ন একক কোনো বিশ্বব্যবস্থার বদলে একটি বহুমাত্রিক বিশ্বব্যবস্থা চায় যেখানে ভারত শক্তিশালী দেশগুলোর কাতারে থাকবে। আর যেহেতু ভারতের ক্ষমতা বাড়ছে, তাই এটি বড় দেশ হওয়ার কিছু সুবিধা চাইবে। সেসব সুবিধার মধ্যে হয়তো অন্য দেশের মাটিতে নিজের শত্রুর ওপর হামলা চালিয়ে ওই দেশের সার্বভৌমত্বকে বুড়ো আঙুল দেখানোও থাকতে পারে।
এ মুহূর্তে মোদির সরকার মনে করে, নয়াদিল্লির হাতেই সব কার্ড রয়েছে। ভারতীয় কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে জানিয়েছেন, তারা বিশ্বাস করেন না যে বেইজিংকে ঠেকাতে আমেরিকার এ মুহূর্তে যে ধরনের সমর্থন দরকার, সে বিবেচনায় ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নষ্ট করে এমন কোনো কাজ করবে ওয়াশিংটন। হয়তো তাদের ধারণাই ঠিক।
এ উভয়সংকটই নিজ্জরের হত্যাকাণ্ডে বাইডেনের প্রতিক্রিয়ার ওপর বড় প্রভাব রাখবে। ২০১৮ সালে যখন পুতিনের এক শত্রুকে ব্রিটেনের মাটিতে রাশিয়ান এজেন্টরা বিষ খাইয়েছিল, তখন পাশ্চাত্য সমন্বিতভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল। ওই সময় গণহারে রাশিয়ার কূটনৈতিকদের বহিষ্কার করা হয়। কানাডার কপালে একই ধরনের সংহতি নেই।
শোনা যাচ্ছে, ভারতের এ অবৈধ কাজকে প্রতিষ্ঠা করতে মার্কিন গোয়েন্দারা নাকি সহায়তা করেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র নাকি কানাডাকেও বলেছিল এভাবে প্রকাশ্যে অভিযোগ করায় আপাতত কিছুটা লাগাম টানতে। যদিও নয়াদিল্লিতে আড়ালে এ বিষয় নিয়ে মুখ খুলেছিলেন বাইডেন, যাতে মোদির জি-২০-এর সাফল্য হঠাৎ করে ফিকে হয়ে না যায়। হয়তো দেখা যাবে, বাইডেন প্রশাসন নয়াদিল্লিকে সবার অগোচরে বলবে এ ধরনের আন্তর্জাতিক অপরাধ অগ্রহণযোগ্য এবং চাইবে না ব্যাপারটা নিয়ে আর প্রকাশ্যে ঘাঁটাঘাঁটি হোক। মোদি সে পরামর্শ শুনবেন কি না তা আলাদা ব্যাপার।
বৈশ্বিক পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রকে এখন ক্রমেই এমন সব অংশীদারদের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে যারা অপ্রীতিকর এমনকি নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডেও অভ্যস্ত। তুলনামূলক প্রভাবশালী ভারত ছাড়া চীনা শক্তির বিরুদ্ধে কোনো আপাতত জবাব নেই, তবে আবার এ কথাও মানতে হবে যে ভারতের মতো দেশের এ ধরনের কর্মকাণ্ড ওয়াশিংটন সবসময় পছন্দ করবে না।
হাল ব্র্যান্ডস: ব্লুমবার্গ অপিনিয়ন-এর কলামলেখক এবং জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি'র স্কুল অভ অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ-এর হেনরি কিসিঞ্জার ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।