খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, ৮ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে ২৬,১৩৩ কোটি টাকা
দেশে চলতি ২০২৩ সালের জুন শেষে ৮ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬,১৩২ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোতে ব্যাপক পরিমাণে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এমনটি হয়েছে বলে মনে করছেন ব্যাংকারা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের এপ্রিল-জুন সময়ে ৮ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ বেড়েছে ৫,৯৭৪ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০২৩ সালের জুনে নতুন করে দুটি বেসরকারি ব্যাংক ঘাটতিতে পড়েছে। এরমধ্যে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক তিনমাসে ঘাটতিতে পড়েছে ৫১৬ কোটি টাকা। এছাড়া, এনসিসি ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১১৯ কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ গত তিনমাসে বেড়েছে প্রায় ২৫,০০০ কোটি টাকার বেশি। যদিও এই সময়ে দেখা যাচ্ছে, প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে প্রায় ৬,০০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, অনেক ব্যাংককে তাদের প্রফিট থেকে প্রভিশনিং করতে হয়েছে, যে ব্যাংকগুলো প্রভিশনিং করতে পারেনি তাদের ঘাটতি বেড়ে গেছে।
তারা বলছেন, ব্যাংকগুলোর ডেফারেল সুবিধা না পেলে প্রকৃত প্রভিশন ঘাটতি আরও কয়েকগুণ বেশি হবে।
বর্তমানে প্রভিশন ঘাটতিতে থাকা ৮ ব্যাংক হলো– ন্যাশনাল ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক এবং এনসিসি ব্যাংক।
নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো আমানতের বিপরীতে ০.৫০ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন রাখতে হয়। তবে খেলাপি ঋণের মান অনুযায়ী, ২০ শতাংশ, ৫০ শতাংশ, এমনকি শতভাগ পর্যন্ত প্রভিশন রাখার নীতিমালা রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, চলতি জুন প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ রাষ্ট্রায়ত্ত কিছু ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ব্যাপক বেড়েছে। এরমধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ তিনমাসের ব্যবধানে দ্বিগুণ হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, জনতা ব্যাংক থেকে বড় একটি রপ্তানিকারক গ্রুপ ইডিএফএ'র ঋণ নিয়ে সেগুলো দীর্ঘদিন যাবৎ ফেরত না দেওয়ায় ব্যাংক বাধ্য হয়ে প্রতিষ্ঠানটির ঋণ খেলাপি করেছে। যা তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ার আরেকটি কারণ হলো- চলতি বছরের এপ্রিলে ঋণ স্থগিতের সুবিধা তুলে নিয়ে কিছু ইডিএফ (রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল) ওভারডিউ গ্রাহকদেরকে খেলাপি হিসেবে দেখানো।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুন মাসে ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১,৫৬,০৩৯ কোটি টাকা, যা মোট বকেয়া ঋণের ১০.১১ শতাংশ।
মার্চ মাসে ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১,৩১,৬২০ কোটি টাকা, যা মোট বকেয়া ঋণের ৮.৮০ শতাংশ। জুন শেষে বকেয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫,৪২,৬৫৫ কোটি টাকা।
দেশের ব্যাংকিং খাতে এমন সময়ে খেলাপি ঋণ ও প্রভিশন ঘাটতি বেড়েই যাচ্ছে, যখন বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের কম রাখতে হচ্ছে।
২০২৬ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর গড় এনপিএল অনুপাত ১০ শতাংশের নিচে এবং বেসরকারী ব্যাংকগুলোর ৫ শতাংশের নিচে কমিয়ে আনার ব্যাপারে আইএমএফের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খালাপি ঋণের পরিমাণ রয়েছে ২৫ শতাংশ। এছাড়া, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ৬ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে।
দেশের ব্যাংকিংখাত নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে গত আগস্টে 'Secret behind banks' hefty profit' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে দেশের ১৬টি ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ সুবিধায় প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি ডেফারেল সুবিধা ১ থেকে ৯ বছর সময়ের জন্য ভোগ করছে বলে উঠে আসে। আর এসব ব্যাংকের বেশির ভাগই রাষ্ট্রায়ত্ত।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংক যদি প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়, তবে তাদের মূলধন ঘাটতিতে পড়ার শঙ্কা থাকে।
এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ব্যাংকের ওপর; ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায় আমানত। গ্রাহকের আমানতের সুরক্ষায় ব্যাংকগুলোর যথাযথ প্রভিশন নিশ্চিত করা দরকার।