নভেম্বরের মধ্যে ১৭ লাখ আফগানকে পাকিস্তান ছাড়ার নির্দেশ
অবৈধভাবে বসবাসরত আশ্রয় প্রত্যাশী সকল আফগান শরণার্থীকে নভেম্বরের মধ্যে পাকিস্তান ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে দেশটির সরকার। বর্তমানে প্রায় ১৭ লাখ অননুমোদিত আফগান শরনার্থী দেশটিতে অবস্থান করছে। খবর বিবিসির।
গত মঙ্গলবার দেশটির তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী আনওয়ার উল হক কাকার এবং উচ্চপর্যায়ের সরকারি ও সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন তত্ত্বাবধায়ক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরফরাজ বুগতি। দেশত্যাগের এই নির্দেশনার আওতায় আসবে বহু আফগান রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থীও।
পাক-আফগান সীমান্তে সম্প্রতি হামলার প্রবণতা বেড়েছে। ইসলামাবাদ এগুলোর পেছনে আফগানিস্তানের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে দায়ী করছে। এতে করে চলতি বছরজুড়ে সীমান্তে অস্থিরতা বিরাজ করছে।
তারই পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেশে থাকা আশ্রয় প্রত্যাশী আফগান নাগরিকদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অন্যদিকে আফগানিস্তানের তালেবান সরকার পাকিস্তানের এমন সিদ্ধান্তকে 'অগ্রহণযোগ্য' বলে অভিহিত করে পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে।
আফগানিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সবসময়ই পাকিস্তানের কাছে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীদের আশ্রয় প্রদানের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। কিন্তু তবুও সীমান্তবর্তী এলাকায় সহিংসতার প্রবণতা যেন কমছেই না।
গত সপ্তাহেও পাকিস্তানের মাস্তুং শহরে আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী এক মসজিদের ভয়াবহ বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রায় ৫০ জন মুসল্লী নিহত হয়েছে।
যদিও এসব হামলার কারণেই যে আফগান আশ্রয় প্রত্যাশীদের বিপক্ষে এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, পাকিস্তানের সরকারের পক্ষ থেকে সেটি সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। তবে বালুচিস্তান প্রদেশে অনুরূপ একটি হামলার ঘটনার পরেই সরকারের পক্ষ থেকে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
একটি দেশের কোনো নাগরিকের বিশেষ অবস্থা বিবেচনায় বিদেশে আশ্রয় নেওয়ার অধিকার আন্তর্জাতিক আইনে অন্তর্ভুক্ত। তারই পরিপ্রেক্ষিতে কয়েক দশক ধরে চলা যুদ্ধের সময় হাজার হাজার আফগান নাগরিকদের শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় দিয়েছিল পাকিস্তান।
পাকিস্তানে বসবাসরত আফগান শরণার্থীদের একটি অংশ পাকিস্তানে এসেছিলেন ১৯৭৯ সালে; আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর। তারপর ১৯৯৫-৯৬ সালে তালেবান সরকার প্রথমবারের মতো ক্ষমতা দখলের পর শরণার্থী হিসেবে আসেন আরও কয়েক লাখ শরণার্থী। এরপর ২০২১ সালে তালেবান গোষ্ঠী দেশটির ক্ষমতা দখলের সময় এই প্রবণতা আরও বেশি লক্ষ্য করা যায়।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, প্রায় ১৩ লাখ আফগান নাগরিকের পাকিস্তানে শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধন রয়েছে। আর ৮ লাখ ৮০ হাজার শরণার্থী দেশটিতে বসবাসের আইনি অধিকার পেয়েছে।
তবে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরফরাজ বুগতি জানান, আরও প্রায় ১৭ লাখ আফগান নাগরিক দেশটিতে অবস্থান করছেন যারা পাকিস্তানে শরণার্থী হিসেবে থাকার বৈধতা এখনো লাভ করেনি। ঠিক তাদেরকেই স্বেচ্ছায় পাকিস্তান ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। তারা স্বেচ্ছায় দেশত্যাগ না করলে জোরপূর্বক পাঠানো হবে বলেও জানানো হয়েছে।
দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যমের তথ্যমতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরফরাজ বুগতি বলেন, "আশ্রয় প্রত্যাশীরা যদি স্বেচ্ছায় পাকিস্তান ছেড়ে চলে না যায় তবে তাদের নির্বাসনে প্রাদেশিক ও ফেডারেল সরকারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে ব্যবহার করা হবে।" তবে ঠিক এমন পরিকল্পনা কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানাননি তিনি।
একইসাথে পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে দেশটিতে বসবাসকৃত অবৈধ আফগানদের ব্যক্তিগত ব্যবসা এবং সম্পদ সনাক্ত করে বাজেয়াপ্ত করার জন্য একটি টাস্ক ফোর্স গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
তবে তালেবান প্রশাসনের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ অবশ্য দাবি করেছেন যে, পাকিস্তানে থাকা আফগান শরণার্থীরা দেশটির নিরাপত্তা সমস্যার জন্য দায়ী নয়।
জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ এক্স (প্রাক্তন টুইটার) এ পোস্ট করে বলেন, "যতদিন পর্যন্ত না এই শরণার্থীরা নিজ ইচ্ছায় পাকিস্তান ছাড়ছে, ততদিন পর্যন্ত দেশটির সরকারের তাদের সহ্য করা উচিত।"
অন্যদিকে পাকিস্তানে অবস্থিত আফগান কর্মকর্তারা বলেছেন যে, দেশটির স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যেই আফগানদের আটক শুরু করেছে।
আফগান দূতাবাসের পক্ষ থেকে এক্স এ বিবৃতি প্রদানের মাধ্যমে জানানো হয় যে, গত দুই সপ্তাহে এক হাজারের বেশি আফগানকে আটক করেছে পাকিস্তান সরকার।
পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো বারবার সশস্ত্র গোষ্ঠী কর্তৃক হামলার অভিযোগ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি) এবং ইসলামিক স্টেট গ্রুপের নাম সামনে চলে আসছে।
চলতি মাসের শুরুর দিকে বালুচিস্তানে এক বিষ্ফোরনে এক স্বনামধন্য ধর্মীয় নেতাসহ অন্তত ১১ জন মানুষ আহত হয়েছে।
স্থানীয় গণমাধ্যম এপিপি'র তথ্যমতে, ইসলামাবাদ ধীরে ধীরে দেশটিতে সকল থাকা সকল আফগান শরণার্থীদের ফেরত পাঠাতে চায়। এক্ষেত্রে সরকারি সূত্রের বরাতে জানা যায়, শুধু অবৈধ নয়, যাদের বৈধতা কিংবা রেসিডেন্ট কার্ড রয়েছে তাদেরও ফেরত পাঠাবে পাকিস্তান।
পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরফরাজ বুগতি জানান, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত পাকিস্তান বর্ডারে প্রায় ২৪ টি আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে অর্ধেকের পেছনেই এমন সব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নাম উঠে এসেছে যেগুলো আফগানিস্তান থেকে পরিচালিত হয়।
সরফরাজ বুগতি আরও জানান, আগামী ১ নভেম্বর থেকে আফগান নাগরিকদের পাকিস্তানে প্রবেশের ক্ষেত্রে আরও কড়াকড়ি আরোপের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শুধু ভিসা ও পাসপোর্ট থাকা আফগান নাগরিকদেরই পাকিস্তানে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে৷
অথচ আগে আফগানিস্তানের নাগরিকেরা নিজেদের জাতীয় পরিচয়পত্রকে ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট হিসেবে দেখিয়ে স্থলপথ দিয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করতে পারতেন৷ তবে বর্তমান কড়াকড়িতে ধারণা করা হচ্ছে যে, পাকিস্তানে প্রবেশের জন্য আফগানদের ভিসা এবং পাসপোর্ট প্রাপ্তি অনেকটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া হবে।