মূল্যায়ন
জগৎসংসারে মানুষ অনেক রকম হয়—চালাক, বোকা, মারদাঙ্গা, ভীতু—এমন এক শ রকম মানুষ আছে। সদরুল আতিক এসব কোনো ক্যাটাগরিতে পড়ে না। সে মূলত হাদা টাইপের লোক—কিন্তু সব সময় সে নিজেকে যথেষ্ট বুদ্ধিমান ভাবে। বুদ্ধিমান কিন্তু লোকে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে সবকিছু থেকে তাকে বঞ্চিত করে।
ছোটবেলায় ক্লাসে পড়া না পারলে স্যার বেতের বাড়ি দিত—সেটা কিছু না। স্যাররা তাকে নিয়ে নিয়মিত তামাশা করত। তার চেহারা গোল আর বিভিন্ন পরীক্ষায় সে আন্ডা পেত। তখন টিকা-টিপ্পনি শুনতে হতো: মন খারাপের কি আছে—তুই একটা গোল আলু, পেয়েছিস গোল আলু!
সদরুল গোপনে কিছু শিক্ষকের ওপর প্রতিশোধ নিয়েছিল। একটা স্যারকে পেছন থেকে ঢিল মেরে মাথা ফাটিয়েছিল। আরেক স্যারের বাড়ির সামনে এক বস্তা গোবর ঢেলে রেখেছিল ভোরবেলায়, সেটাতে পা পিছলে স্যার আহত হয়েছিলেন।
সদরুল কেবল স্কুলেই ঝামেলায় পড়ত না—বাসাতেও একই কাহিনি।
তার বাবা তাকে নিয়ে বন্ধুদের সামনে তামাশা করত: এই যে স্কুল থেকে ফিরেছে আমার গোল আলু বাছা—পরীক্ষায় সে গোল আলু পায়! এ জন্য আমাকে বাজার থেকে আলু কিনতে হয় না!
বাবা বলে রক্ষা—সদরুলের অনেক রাগ উঠলেও বাপের ওপর প্রতিশোধ নিতে পারত না।
একমাত্র মা ছাড়া পৃথিবীর সবাই তাকে নিয়ে তামাশা করত। তার গোল চেহারা তো আছেই, সেই সাথে পরীক্ষার রেজাল্ট, 'সদরুল' নামসহ বিভিন্ন বিষয়ে সবাই তাকে নিয়ে মজা করত। তার সবচেয়ে রাগ লাগত, যখন কোনো বন্ধু তাকে নতুন কারও সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে, 'এই যে আমাদের বন্ধু সদরুল ওরফে সদু। ও ফর্সা হলেও আসলে ও আসলে সুদানের ছেলে!'
অমনি ফেটে পড়ত সদরুল, 'আমি সুদানের পোলা না—তুই সুদানের পোলা!'
আর সবাই হাসিতে ফেটে পড়ত!
যা-ই হোক, সদরুল অনেক কষ্ট করে এবং প্রচুর নকল করে আইন পাস করেছিল সেই নব্বই দশকে। তবে আইনজীবী হিসেবে বেশি সুবিধা করতে পারেনি। কারণ, ও না পারে গুছিয়ে কথা বলতে—না পারে তর্ক করতে। কারও সাথে যুক্তিতর্ক দিয়ে কথা বলতে বলতে সুবিধা না করতে পারলে খেপে যেত। এবং দু-একবার কোর্টে গিয়ে সেটাই হয়েছে। বিপক্ষের উকিলের সাথে যুক্তিতর্কে সুবিধা না করতে পেরে একবার বলেই ফেলল, 'কিসে? ঐত্তর মায়েরে বাপ...' অতএব কোর্টে সে দ্রুতই অবাঞ্ছিত হয়ে গেল।
এরপর সে কিছুদিন ইংরেজির শিক্ষক হয়ে টিউশনি করে জীবিকা নির্বাহ করল; বিয়ে করল; বউয়ের গয়না বেচে শেয়ারমার্কেটে শেয়ার কিনল; ধরা খেল এবং এরপর থেকে বাসায় বউয়ের কাছে খালি ঝাঁটাপেটা খেত। সদরুল বউয়ের কাছে কান ধরে ওয়াদা করল, সে জীবনে শেয়ারমার্কেটে যাবে না কিংবা ব্যবসার চেষ্টা করবে না।
টিউশনি করে খুব বেশি আয় হচ্ছিল না। সদরুল ইংরেজি পড়ায়; কিন্তু ও আসলে সঠিক পড়াচ্ছে কি না, সেটা বোঝার মতো মেধা তার নিম্নমধ্যবিত্ত ছাত্রদের অভিভাবকদের ছিল না। আবার তার এমন কোনো সুনাম ছিল না যে তার বাসায় লাইন দিয়ে ছাত্র আসবে কিংবা রাজধানীর বিভিন্ন দেয়ালে লেখা থাকবে 'সদরুল স্যার এখানে পড়ান'।
ছাত্র পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে সদরুল চাকরি খুঁজছে। কয়েক মাস পর হঠাৎ একদিন তার বন্ধু গফুর ফোন করল, 'সদু খবর কী তোর?'
সদু নামটা শুনেই পিত্তি জ্বলে উঠল সদরুলের।
'খ খ খবরদার আমাকে সদু বলে ডাকবি না!' চিৎকার করে উঠল!
'সরি...মুখ ফসকে বের হয়ে গেছে!'
'আ আ আমি তো তো তোর সাথে কথা বলব না!' সদরুল ফোনটা কেটে দিতে গেল।
ওপাশ থেকে গফুর বলছে, 'দোস্ত চাকরি আছে!'
চাকরির কথা শুনে সদরুল থামল, 'কী? ফাজলামি ক-ক করিস!'
গফুর হাসছে, 'তুই রাগিস না! রেগে গেলে তুই খালি তোতলাতে থাকিস! যা হোক, একটা চাকরির সুবর্ণ সুযোগ!'
সদরুল প্রশ্ন করে, 'হু?'
'পত্রিকায় চাকরি! একটা ইংলিশ পত্রিকা আছে...ওখানে ব্যাপক লোকজন নিচ্ছে! ইংলিশ জানা লোক খুব কম! তুই তো ভালোই জানিস, তাই ভাবলাম তুই করবি কি না,' গফুর বলল!
সদরুলের মুখে হাসি ফুটল। চাকরির সুযোগের চেয়েও বড় কথা গফুর বলেছে সে ভালোই ইংলিশ জানে। কেউ তো ওকে প্রশংসা করে না! ওর মেধা কেউ সঠিক মূল্যায়ন করে না। আর এ চাকরি তো দারুণ সুযোগ! ইংলিশ জানা লোক কম মানে কম্পেটিশন কম।
পরদিন সদরুল গফুরের সাথে মতিঝিলে দৌড়ে গেল 'ডেইলি এটম বোম্ব' পত্রিকা অফিসে। নতুন পত্রিকা। ভালো রিপোর্টার আর সাব এডিটর খুঁজছে। গফুর এখানে এক মাস আগে ঢুকেছে। বলল ভালোই এখানকার পরিবেশ—তবে লোক কম হওয়ায় কাজের চাপ বেশি। এতে সদরুলের আপত্তি নেই। কাজের চাপ থাকা ভালো।
চাকরিটা এত সহজে পেয়ে যাবে ভাবেনি সদরুল। শুরুর বেতন ২৫ হাজার; কিন্তু সদরুলের বয়স আর তার ইংরেজি শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা দেখে ওকে বলল আপনি ৩৫ হাজার দিয়ে সাব এডিটরের কাজ শুরু করেন, ভালো করলে ছয় মাসে বেতন বেড়ে যাবে। সদরুল এতেই রাজি। টিউশনি করে ৪০ হাজার হয় আর তার সাথে ৩৫ হাজার যোগ দিলে খারাপ হবে না।
চাকরি শুরু করল সদরুল। গফুর ছিল স্পোর্টস ডেস্কে আর সদরুলকে মেইন ডেস্কে দেয়া হলো। তবে দুই সপ্তাহ পর নিউজ এডিটর তাকে সরিয়ে মেট্রো ডেস্কে দিল। সদরুল ভালো এডিট করতে পারে না; অতএব একটু দুর্বল সেকশনে কাজ করা শ্রেয়!
মেইন ডেস্ক প্রথম পাতা, শেষ পাতা নিয়ে কাজ করে আর মেট্রো ডেস্ক ছোটখাটো ঘটনা দিয়ে ভেতরের পাতা ভরে। মেট্রো ডেস্ক চালায় মিঠু জামাল। সিনিয়র সাংবাদিক। ইউনিয়ন নেতা। সদরুলের মতো সে-ও আসলে ভালো ইংলিশ জানে না; কিন্তু নেতাগিরি করে একটা পজিশন ধরে রেখেছে। জামালের খোঁচাখুঁচি করার স্বভাব। তামাশা করা তার নেশা।
সদরুল যখন তার ডেস্কে কাজ করতে গেল, জামাল তাকে তার পাশের ডেস্কে বসতে দিল। মেট্রো ডেস্কে সর্বমোট ৫ জন; তার তিনজনই হয় ছাত্র, না হয় সবে পাস করে বের হয়েছে—মানে পোলাপান!
'সদরুল আতিক? এটা কেমন নাম, এ?' মিঠু জামাল প্রশ্ন করে, 'সদরুল একটা ডাকনাম—আতিক একটা ডাকনাম! এটা কেমন?'
সদরুল হাসল, 'কী করব! বাপ-মা নাম রেখেছে। হা হা!'
জামাল হাসে, 'বাবার কি একই রকম নাম ছিল?'
সদরুল মাথা নাড়ল, 'বাবার নাম কাশেম রফিক ছিল!'
জামাল আরও হাসে, 'হে হে...কোনো ফ্যামিলি টাইটেল নেই!'
সদরুলের ফর্সা গোলগাল চেহারাটা লাল হয়ে গেল। কিন্তু প্রথম দিনেই বসের সাথে ঝগড়া করার ইচ্ছে নেই বলে সে বলল, 'এই আর কী! যাই একটু বাথরুম করে আসি!'
সদরুল বাথরুমের দিকে যেতেই চেংড়া সাব এডিটর তৌহিদ বলে উঠল, 'আপনার যেমন অনেক বংশ পরিচয়, মিঠু জামাল ভাই? মিঠু একটা ডাকনাম—জামাল একটা ডাকনাম!'
'এই পোংটা ছেলে, চুপ!' জামাল হাসতে থাকে।
তৌহিদ মাথা নেড়ে বলল, 'আপনার নাম হওয়া উচিত ছিল জামাল কামাল!'
জামাল আরও হাসতে থাকে, 'শোনো পোলাপান, এই কথাটা ওর মাথায় তো আসেনি! কেন? কারণ, তার মাথায় কিছু নেই!'
নতুন চাকরিতে সে প্রায় প্রতিদিনই জামালের ওপর খেপে যেত। কিন্তু সেটা অনেক কষ্টে নিজের কাছে চেপে রাখত। দুই-একবার ফোঁসফোঁস করে কমেন্ট করে ফেললেও পরে হাসি দিয়ে বলত, 'ঠাট্টা করলাম এরি! হে হে হে!'
সেদিন জামালের পাশের ডেস্কে বসে সে কাজ করছে। কলমের কালি শেষ। 'জামাল ভাই—একটা কলম হবে?'
জামাল চশমাটা নামিয়ে বলে, 'আপনার ডেস্কের ড্রয়ার খুলে দেখেন—কলম আছে!'
ড্রয়ার খুলে কলম পেয়ে খুশি সদরুল। সে আবার এখনো কম্পিউটারে এডিট করতে পারে না—কলম দিয়ে হার্ড কপিতে সে এডিট করে লেআউট সেকশনে পাঠিয়ে দেয়। তবে তাকে নাকি আগামী মাসের মধ্যে অবশ্যই কম্পিউটারে এডিটিং শিখে কাজ করতে হবে।
'সদরুল সাহেব, এই অফিসে একমাত্র আপনিই কলম দিয়ে কাজ করেন। এ যুগে গরু-ছাগলেও কম্পিউটারে কাজ করে!'
ব্যাস! সদরুল লাফিয়ে উঠল, 'এটা অসভ্য কথা! আমাকে গরু-ছাগল বলে ডাকছেন!'
জামাল হেসে ওঠে, 'আপনাকে না...গরু ছাগলকে বলেছি!'
সদরুল আরও খেপে ওঠে, 'নি নি নিজেকে কী মনে করেন? আইন ইস্টাইন? আমি গরু হলে আপনি ভেড়া!'
পাশ থেকে তৌহিদ হাসি চেপে সদরুলকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করে। কিন্তু সদরুল এত খেপে গেল যে জামাল বুঝল এই লোক আধা পাগল। মস্করা বোঝে না। তাই জামাল বলল, 'আচ্ছা ভাই, ভুল করেছি! গরু-ছাগলরা এখনো কম্পিউটারে কাজ শেখেনি! আপনি অবশ্যই শিখে যাবেন!'
সদরুল আরও হাউমাউ করে ওঠে। পুরো অফিসের লোকেরা জড়ো হয়ে মজা দেখে। শেষে নিউজ এডিটর এসে ওকে একটা কষে ধমক দেয়, 'আরেকবার চেঁচালে এক্ষুনি ঘাড় ধরে বিদায় দিয়ে দেব!'
এরপর শান্ত হয় সদরুল।
জামাল নেতা মানুষ। সে পরিস্থিতি নিজের হাতে তুলে নিয়ে সদরুলকে চা-শিঙাড়া খাওয়াল; কিছু হালকা কথা বলে আবার কাজ শুরু করল।
এর মধ্যে একদিন ডেইলি এটম বোম্বের এডিটর ওকে ডেকে বলল, 'শোনো সদরুল তোমাকে এক মাস সময় দিচ্ছি—তোমার ইংলিশ বেশি সুবিধার না।'
ব্যাস অমনি সদরুল তার বসের পা চেপে ধরল, 'স্যার এমন কথা বলবেন না। বাসায় স্ত্রী অসুস্থ; বাচ্চাটা পাগল। আমি স্যার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম লোক...!'
এডিটর ওকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করে, 'আচ্ছা হয়েছে...থামো! আরে কাঁদছ কেন? ঠিক আছে ঠিক আছে যাও, একটু কাজের উন্নতি করার চেষ্টা করো! বেশি করে ইংলিশ পড়ো; মাঝে মাঝে লেখো। দেখবে ইংলিশ ভালো হচ্ছে!'
চোখ মুছে সে যাত্রায় সদরুল বেঁচে গেল।
কিন্তু পরদিন সে অফিস এসে দেখে মিঠু জামালের পাশের ডেস্কে একটা নতুন ছেলে বসে কাজ করছে। নতুন লোক আসতেই পারে; কিন্তু তাই বলে মিঠু জামাল তার পাশের ডেস্কে এভাবে বসিয়ে দেবে?
'ওহ সদরুল এসেছেন? এটা লেনন—আজ কাজে যোগ দিল; লেনন উনি হচ্ছে সদরুল ভাই।'
সদরুল একটা কষ্ট নিয়ে হাসি দিল; ফর্সা চেহারাটা একটু লাল হয়ে গেছে।
জামাল সদরুলের দিকে একটা কপি বাড়িয়ে দিল, 'এই কপিটা করেন।'
লেননের ডেস্কের অপর পাশে খালি চেয়ার আছে; তা সত্ত্বেও সদরুল বলল, 'কোথায় বসে কাজ করব?'
জামাল খালি চেয়ার দেখিয়ে বলল, 'ওই তো!'
সদরুল সেই চেয়ারে বসে কপি দেখার ভান শুরু করল আর আড়চোখে লেননকে মাপতে থাকল—কোথাকার কোন পাঙ্ক ছোড়া এসে মূল্যবান জায়গা দখল করে নিয়েছে। এসব মিঠু জামালের ষড়যন্ত্র—সদরুলকে অপমান করার জন্য এই আয়োজন!
হটাৎ সদরুল ফেটে পড়ল, লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল, 'এ আমি মানি না!'
লেনন চমকে উঠে পিছিয়ে যায়—চাকরির প্রথম দিন। কোন লোক কেমন, সে জানে না!
জামাল হতভম্ব, 'কী হয়েছে!'
সদরুল চেঁচিয়ে বলে উঠল, 'এই ডেস্কের ড্রয়ার আমার দিকে থাকবে!'
এই কথা বলে সে টেবিলটা এক টানে ঘুরিয়ে ফেলল। সবাই চুপ হয়ে তামাশা দেখছে। সদরুল ডেস্কটা ঘুরিয়ে ড্রয়ার টেনে খুলে একবার দেখল। যদিও এর ভেতর তার কিছুই নেই। পত্রিকা অফিসে কিছু সুপারভাইজার ছাড়া বাকি সাব এডিটরদের কোনো নির্দিষ্ট ডেস্ক নেই।
'আমি সিনিয়র—আমার পাশে ডেস্কের ড্রয়ার থাকবে।'
লেনন মাথা নাড়ল, 'কোনো অসুবিধা নেই!'
জামাল মুচকি মুচকি হাসছে দেখে লেনন বুঝে গেল এই লোক পাগলা।
এরপর এক বছর কেটে গেল। মাঝে মাঝেই সদরুল বিভিন্ন ঘটনা ঘটায় এবং লোকজন তাকে এন্টারটেইনমেন্ট হিসেবেই দেখে। সে এর মধ্যে একটা মতামত লিখে পত্রিকায় প্রকাশ করে সবাইকে পড়িয়েছে। তাকে এডিটর আরেকবার বিদায় হতে বলেছিল, তখন সে আবার কেঁদে পরিস্থিতি আয়ত্তে এনেছে।
তবে এই লেনন ছেলেটা বেশ বেয়াদব। আঁতেল। সবজান্তা। ওর সাথে তর্ক করা যায় না। ইংলিশের ওস্তাদ এবং এডিটিংয়ে তুখোড় বলে সবাই তাকে সমীহ করে চলে। এই অফিসে সদরুল একমাত্র ওকেই ভয় পায়। বয়সে এত ছোট কিন্তু প্রচণ্ড তেজ!
পরপর কয় দিন সদরুলের সাথে লেনন রাতের শিফটে কাজ করেছিল। রাত ৯টা বাজলে অফিস থেকে সিএনজি দিয়ে বাড়িতে নামিয়ে দেয়া হয়। দুই রাত সদরুলের সাথে লেনন গাড়িতে উঠেছিল। সদরুলের বাড়ি জিগাতলার ভেতরের একটা গলিতে আর তাকে নামিয়ে গাড়ি লেননকে মোহাম্মদপুর নামিয়ে দেয়। এখানে সমস্যা হচ্ছে সদরুল কখনোই অন্যের অসুবিধা নিয়ে মাথা ঘামায় না। অফিসের গাড়ি তার বাড়ির গেটে নামিয়ে দিতেই হবে; মানে মেইন রোডে সে নামবে না।
সেদিন বেশি রাত হয়ে গেছে। অফিসের গাড়ি অন্যদের নামিয়ে এখনো ফেরেনি। লেনন, তৌহিদ আর সদরুল অপেক্ষায় আছে। লেনন শেষে বিরক্ত হয়ে অফিস থেকে নেমে সামনের রাস্তা থেকে একটা স্কুটার ডাকল। অফিসের গাড়ি লাগবে না—ভাড়া করেই যাব! লেনন তৌহিদকে নিচ থেকে ডাক দিল, 'তৌহিদ, যাবেন নাকি?'
উপর থেকে উঁকি দিয়ে সদরুল দেখল নিচে লেনন ষড়যন্ত্রমূলকভাবে অফিসের গাড়ি হাইজ্যাক করে কেটে পড়ছে। পড়িমরি করে নেমে এসে এক লাফে গাড়িতে উঠল। লেনন আশ্চর্য হয়ে বলল, 'এটা আমার গাড়ি!'
সদরুল হেসে বলল, 'হ্যাঁ হ্যাঁ!'
লেনন কাঁধ ঝাকাল।
তিনজনকে নিয়ে স্কুটার ছুটছে। প্রথমে ধানমন্ডি ২ নম্বর এ নামল তৌহিদ। ও নেমে ৫০ টাকা দিল লেননকে। সদরুল ব্যাপারটা দেখেও না দেখার ভান করল। ও বুঝে গেছে যে এই গাড়ি ভাড়া করা—অফিসের না।
এরপর গাড়িটা জিগাতলায় তার বাড়ির গলির মুখে মেইন রোডে থামল, 'সদরুল ভাই এখানে নামেন আর ৫০ টাকা দিন!'
সদরুল অবাক হয়ে তাকায়—'টাকা? এখানে নামব?'
লেনন ঠিক জন লেননের মতো তাকিয়ে বলল, 'আগেই বলেছি, এটা আমার স্কুটার—ভাড়া করা। আপনি লাফিয়ে উঠে হেহে করে বলেছেন...'
সদরুল বলল, 'তুমি ভাই অফিস থেকে বিল করে টাকাটা নিয়ে নিয়ো!'
'আমি ছোটলোকের মতো ১৫০ টাকা বিল করি না—আমার গাড়িতে উঠেছেন, টাকা ছাড়েন! তৌহিদ টাকা দিল দেখেননি?'
ইতস্তত করে পকেট থেকে ৫০ টাকা বের করল—বিশাল লস! 'কিন্তু আমাকে এখানে কেন—বাড়ির গেটে নামিয়ে দাও।'
'আপনাকে যে এই গাড়িতে চড়তে দিয়েছি, এ জন্য আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে নেমে যান; ওই কানা গলিতে ঢুকব না!'—লেনন ঠান্ডা গলায় বলল।
সদরুল সভয়ে নেমে গেল—লেননকে ভয় লাগে; বেশি তর্ক করলে যদি ঘুষি মারে! ছোড়াটা লম্বা-চওড়া! বেয়াদব!'
যা-ই হোক, গাড়ি থেকে নেমে মনে মনে লেনিনকে গালি দিতে দিতে বাড়ির গলিতে ঢুকল সদরুল। রাত একটা বাজে। আশেপাশে কেউ নেই। গলিটা আঁধার—দূরের আলোতে দেখা যাচ্ছে পাড়ার কয়টা নেড়ি কুকুর। হঠাৎ কেমন যেন ভয় লাগতে থাকে—যদি এখন একটা ছিনতাইকারী ধরে? কিংবা ভূত?
সদরুলের চিন্তাসূত্র হটাৎ ভেঙে যায় কুকুরদের 'ঘেউ ঘেউ' শব্দে। সর্বনাশ—পাড়ার নেড়িগুলো দৌড়ে ওর দিকেই আসছে! ওরে বাবা! কুত্তাদের বিশ্বাস নেই! তিনটা কুত্তা! সদরুল দিল দৌড়! আর তাতে কুকুরগুলো আরও উত্তেজিত হয়ে ওর পেছন দৌড়াতে থাকে!
'এই! এই শয়তানের দল—ভাগ!' সদরুল দেখল কুকুরগুলো ওর খুব কাছে চলে এসেছে। সামনে একটা খাম্বা—সেটাতে আবার পাত লাগানো, যেটা বেয়ে উপরে ওঠা যায়; সদরুল সেই পাত ধরে লাফিয়ে খাম্বায় উঠে গেল। অল্পের জন্য রক্ষা; কারণ, পরমুহূর্তে কুত্তাগুলো এখানে এসে প্রচণ্ড চেঁচামেচি শুরু করেছে। সদরুল চিৎকার করে লোকজন ডাকতে লাগল।
কিন্তু ওর চিৎকার আর কুকুরদের ডাক মিলে যে শব্দ হচ্ছে, তাতে সমগ্র জিগাতলার কুকুররা বুঝে গেল এখানে কোনো চোর-বাটপার এসেছে। সদরুল সভয়ে দেখল বিভিন্ন দিক থেকে কুকুরের দল আসছে। কান খাওয়া কুকুর; লেজ কাটা কুকুর—কোনোটা ল্যাংড়া, কোনোটা চামড়া খাওয়া। সব মিলে ১২টা কুকুর ওর খাম্বার চারপাশে জুটে গেল। সব ঘেউ ঘেউ করে ওকে নামতে বলছে।
সৌভাগ্যবসত সদরুল মাটি থেকে ৬-৭ ফুট উপর আছে। এখানে থাকলে ওরা কামড়াতে পারবে না! সদরুল ভালো করে উঠে পাতটার উপর বসে নিল; পকেট থেকে ফোন বের করে বউকে ফোন করতে থাকল। কিন্তু বউ ফোন ধরে না। ও রাত করে আসলে বউ-বাচ্চা ঘুমিয়ে থাকে। সদরুলের কাছে চাবি আছে—নিজে নিজে ঢুকে যায়।
হায় কপাল। বউ ধরে না—কোনো মানুষ সাহায্যে আসে না; কুকুররাও যায় না।
ওই খাম্বায় বসে বাকি রাত কাটিয়ে দিতে হলো সদরুলকে। কুকুরগুলো যখন দেখল ও নামে না, ওরা সবাই ওটার নিচেই ঘুম দিল। নির্ঘুম সদরুলকে শেষ পর্যন্ত ভোরবেলা কয়েকজন মুসুল্লি দেখতে পেল। ওরা খুব অবাক যে একটা লোক খাম্বার ওপর পিলারটা জড়িয়ে বসে আছে আর নিচ্ছে এক ডজন কুকুর।
মুসুল্লিদের ধমকে কুকুরগুলো মুহূর্তেই লেজ নাড়তে নাড়তে কেটে পড়ল—কুকুররা ভাবছে ওরা ওদের দায়িত্ব পালন করে মানুষদের কাছে একটা চোর ধরিয়ে দিয়েছে।
সেদিনের পর থেকে সদরুল লেননকে পুরোপুরি এড়িয়ে চলে।
কিন্তু লেনন তো সমস্যা না—পুরো অফিস তার বিরুদ্ধে। সবাই তার পেছনে লেগে আছে। এটম বোম্বের অফিস ওর অসহ্য লাগত—কিন্তু এই চাকরি ছেড়ে দিলে ওকে কে চাকরি দেবে? তাই সদরুল মাটি কামড়ে এই চাকরি করে। এটার জন্য কত কষ্ট করে ওকে কম্পিউটার চালানো শিখতে হয়েছে। ইদানীং আবার ওকে একটু একটু অনলাইন এডিট করতে হয়—এগুলো ওর ভালো লাগে না।
বছর পার হয়ে যায়—ছোট ছোট পোলাপানের প্রমোশন হয়; ওর হয় না। একবার বসের কাছে এই নিয়ে কথা বলতে গেল সদরুল।
এডিটর ওর কথা শুনে বলল, 'দেখো সদরুল, তোমাকে শুধু মানবিক বিবেচনায় এখানে রেখেছি—আমি যদি একটু কম মানুষ হতাম, তাহলে বহু আগেই তোমাকে বের করে দিতাম। তুমি প্রোমোশনের যোগ্য নও!'
'স্যার!' সদরুলের চোখে পানি এসে গেল, 'স্যার আমার স্ত্রীর মানসিক সমস্যা আর আমার বাচ্চা অসুস্থ!'
এডিটর অবাক হয়ে বলল, 'কেন? এর আগে না বললে তোমার স্ত্রী অসুস্থ আর তোমার বাচ্চার মানসিক সমস্যা?'
সদরুল মাথা ঝাঁকাল, 'আসলে দুজনেরই মাথায় গন্ডগোল—দুজনই অসুস্থ! আমি কী বলব...'
এডিটর হাত তুলে বলল, 'থাক বোলো না! আমি যথেষ্ট ঝামেলার ভেতরে আছি! যাও তোমার বেতন একটু বাড়িয়ে দিচ্ছি—এসব দুঃখের আলাপ আমার সাথে কোরো না!'
এভাবে করে সদরুল ১০ বছর কাটিয়ে দিল ডেইলি এটম বোম্বে। আগের অনেকেই এখানে নেই আর যারা আছে—তারা প্রমোশন পেয়ে পেয়ে অনেক উপরে চলে গেছে। কিন্তু সদরুল সেই মেট্রো ডেস্কেই রয়ে গেছে।
সেদিন সদরুল অফিসে এসে শোনে লেননকে নিউজ এডিটর করা হয়েছে। কি? সেই পাঙ্ক ছোড়া এখন নিউজ এডিটর?
সদরুলের বিস্ফোরণ হলো, 'এই অফিস সত্যিকার সাংবাদিকদের মূল্যায়ন করে না!'
সে অফিসের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে গিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল, 'আমি এক যুগ ধরে নিষ্ঠার সাথে কাজ করে এখনো সাব এডিটর—আর অন্যরা বসদের চামচামি করে লক্ষ টাকার বেতন নিচ্ছে! আমি এর বিচার চাই! আমার কাজের মূল্যায়ন চাই!'
তৌহিদ কোথা থেকে উঁকি দিয়ে বলল, 'সদরুল ভাই, আপনি কোন কাজের মূল্যায়ন চাইছেন?'
সদরুল চোখ গোলগোল করে বলল, 'আমি যে গত ১০ বছরে ১৩টা লিখা ছাপিয়েছি—এটার কেউ মূল্যায়ন করেছে? করেনি!'
ও পাশ থেকে রিপোর্টার আজাদ বলল, 'আমার গত এক সপ্তাহে ১০টা রিপোর্ট বের হয়েছে!'
সদরুল একটু থতমত খেয়ে বলল, 'আমার এবং আজাদের কাজের মূল্যায়ন চাই!'
আজাদ দূর থেকে বলল, 'আমার কাজের মূল্যায়ন হয়! আমাকে গত সপ্তাহে প্রমোশন দেয়া হয়েছে!'
সদরুল এবার রেগে গেল, 'আমার সাথে বেয়াদবি চলবে না! আমি এই পত্রিকার বিরুদ্ধে মামলা করব...'
বলতে বলতে সদরুল হঠাৎ দেখল তার এডিটর সামনে দাঁড়িয়ে।
'মামলা করবে? আমার পত্রিকার বিরুদ্ধে?'
সদরুল থেমে গেল; কিছুক্ষণ সবাই চুপ। সদরুল এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, 'ভুলে যাবেন না—আমি কিন্তু আইনজীবী!'
এটম বোম্বের এডিটর এক গাল হেসে বলল, 'ওহ আমি ভুলে গিয়েছিলাম! শোনো সদরুল, তুমি যে ঝগড়াটে—তুমি আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করলে সহজেই জিতে যাবে! যাও মামলা করো! তোমার এখানে চাকরির দরকার নেই! কাল এসে তোমার পাওনা নিয়ে চলে যেও!'
সদরুল হঠাৎ বুঝতে পারল, সে বেশি বেশি করে ফেলেছে—চাকরিটা এই মাত্র চলে গেল! কিন্তু বুঝতে পারলেও ওর অনেক রাগ হচ্ছিল; তাই ফোঁস করে বলল, 'হ্যাঁ হ্যাঁ দেখা হবে কোর্টে!'
সদরুল অফিস থেকে বের হয়ে গেল; এভাবে ডেইলি এটম বোম্ব ওকে প্রতারণা করবে সে ভাবেনি! ওর মূল্য ওরা দিল না! আমি ওদের মামলা করে মূল্যায়ন করা বের করব। আমি আবার কোর্টে প্র্যাকটিস করব—শুধু এই পত্রিকাকে শিক্ষা দিতে! কী ভেবেছে ওরা আমাকে! আমি অসহায়? কক্ষনো না!
কোনো একটা পথচারী ওকে ধাক্কা মেরে চলে গেল—সদরুল পাত্তা দিল না! মনে মনে সে এডিটরকে শূলে চড়াচ্ছে! আমার চাকরি খেয়ে দিল ব্যাটা—অথচ আমি ১৩টা লেখা ছাপিয়েছি! ও আচ্ছা—একটু ঝালমুড়ি খাই! ঝালমুড়িওয়ালার সামনে এসে পকেটে হাত দিয়ে টের পেল ওর মানিব্যাগ হাওয়া! ওকে! নো প্রবলেম! আমি আইন প্র্যাকটিস করে ওই এডিটর, মিঠু জামাল, লেননসহ ঢাকার সব পকেটমারদের জেলে ঢুকাব!
আমি সদরুল আতিক ওরফে সদু! আমার সাথে বাটপারি!