‘নীরব দখলদারি’: গাজা যুদ্ধের মধ্যে অস্ত্রের মুখে খালি করা হচ্ছে পশ্চিম তীরের বেদুইন গ্রাম
১২ অক্টোবর সকাল। আশেপাশের অবৈধ বসতি থেকে আসা বিপুল অস্ত্রে সজ্জিত ইসরায়েলিদের একটি দল গ্রামে ঢুকতেই নিজেদের খুপড়ি ঘর খুলে সরিয়ে নিতে শুরু করেন ওয়াদি আল-সিক সম্প্রদায়ের লোকজন। তাদের স্ত্রী এবং বেশিরভাগ সন্তান আগেই গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিল।
ওয়াদি আল-সিক সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণের দুই দিন আগেই ইসরায়েলি শান্তি কর্মী গাই হিরশফেল্ড ফেসবুকে সতর্ক করেছিলেন তাদের। সুতরাং ওয়াদিদের নেতা তথা মুখতার, আবদেলুর রহমান 'আবু বাশার' কাবনেহ সিদ্ধান্ত নিলেন সবাইকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, গত দুই সপ্তাহের গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধের মধ্যে পশ্চিম তীরের যেসব ফিলিস্তিনি বেদুইনদের গ্রাম ছাড়তে হয়েছে তাদের একটি ওয়াদি আল-সিক। প্রায় প্রতিদিন বেদুইনদের গ্রামে অবৈধ বসতি থেকে আসা ভারি অস্ত্রে সজ্জিত ইসরায়েলিরা হামলা চালাচ্ছে। অনেক সময় ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীও তাদের সহায়তা করে।
বছরের পর বছর যদিও এসব হয়ে আসছিল। তবে বিশ্বের নজর গাজার প্রতি বেশি পড়তেই তাদের প্রচেষ্টা আরো জোরদার হয়েছে।
হিরশফেল্ড বলেন, পুরো পশ্চিম তীরে এই অবস্থা। তারা পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে এবং যা খুশি করছে।
গ্রাম ত্যাগ অথবা মৃত্যু
রামাল্লাহর পূর্বে ২০ কিলোমিটার উত্তর-দক্ষিণের প্রায় সব ফিলিস্তিনিদের সরে যেতে হয়েছে। কষ্টে দিনযাপন করা বেদুইনদের ভোগান্তির শেষ সীমার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
ওয়েস্ট ব্যাংক প্রোটেকশন কনসোর্টিয়াম ও ইসরায়েলি মানবাধিকার সংস্থা ইয়েশ দিন-এর তথ্যমতে, এরিয়া সি নামে চিহ্নিত স্থান থেকে ৭ অক্টোবর থেকে অন্তত ১৩ সম্প্রদায়ের প্রায় ৫৪৫ ফিলিস্তিনিকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে।
অথচ ১৯৯৩ সালে ইসরায়েল ও পিএলও সাক্ষরিত অসলো চুক্তি অনুযায়ী, এসব জায়গাগুলো নিয়ে পরবর্তী আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্তে আসার কথা।
প্রত্যক্ষদর্শী এবং মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, খালি হওয়া প্রথম গ্রাম ওয়াদি আল-সিকের মতো একই ভাগ্য বরণ না করার জন্যে অনেক মানুষ এখন তাদের গ্রাম ছেড়ে এরিয়া বি-এর দিকে চলে আসছেন।
আরো হতাশার বিষয় হলো, ৭ অক্টোবর হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধের পর আগে থেকেই বিপুল অস্ত্রে সজ্জিত অবৈধ বসবাসকারীদে আরো অস্ত্র সরবরাহ করার নির্দেশ দিয়েছেন ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গভির।
'আমাদের আর কিছুই নেই'
ওয়াদি আল-সিক এ বাস করতেন ১৮৭ বেদুইন। রামাল্লার পূর্বে অনুর্বর পর্বতমালা রয়েছে, সেখানেই ফিলিস্তিনি মেষপালকরা কয়েক দশক ধরে বসতি গেড়েছেন।
চলতি বছরের শুরুর দিকে অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের আক্রমণে ওয়ালি আল-সিকের কাছাকাছি গ্রাম 'আইন সামিয়া' প্রথম পুরো খালি হয়ে যায়। আর সম্প্রতি জনমানবশূন্য হয়েছে আল-বাকা এবং রাস আল-তিন।
ঘর, সম্পদ এমনকি তাদের স্কুলের ওপর করা আক্রমণ থেকে বাঁচতে বছরের শুরুর দিকে ওয়াদি আল-সিকের অনেক পরিবার গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়। গ্রামবাসী জানায় যে, কাছাকাছি বসতি স্থাপনকারীরা তাদের প্রতিনিয়ত ভয় দেখায়।
অক্টোবরের সেই দুর্ভাগা দিনে অবৈধ স্থাপনকারী ও রিজার্ভ সেনারা এসে আকাশে ফাঁপা গুলি ছুড়ে এক ঘণ্টার মধ্যে তাদেরকে গ্রাম খালি করে দিতে বলে।
আবু বাশার জানান, তারা আমাদের ঘরে ঢুকে এবং আমাদেরকে কিছুই নিয়ে যেতে দেয়নি। যাদেরকে পেয়েছে টেনে হিঁচড়ে বের করেছে এবং মারধর করেছে।
আবু বাশার বলেন, তারা হুশিয়ারি দেয় যে এক ঘণ্টা পর কাউকে পাওয়া গেলে হত্যা করা হবে।
তিনি জানান, কেবল গায়ে থাকা পোশাক নিয়ে অনেক গ্রামবাসী দৌড়াতে থাকে। মারধর কিংবা পাহাড়ে চড়তে গিয়ে ৩০ বেদুইন আহত হয়েছেন বলেও জানান তিনি।
আল জাজিরাকে আবু বাশার বলেন, আমাদের খাবার নেই, পানি নেই, বিদ্যুৎ নেই, শোবার জায়গা নেই, আমাদের কিচ্ছু নেই।
তাদের বাড়ি-ঘর অবৈধ বসতি স্থাপনকারীরা লুটপাট করেছে বলে জানান বেদুইনরা। তাদের অনেকে এখন ভিক্ষা করা শুরু করেছেন। তারা এখন আন্তর্জাতিক সহায়তার দিকে তাকিয়ে আছেন।
'কোনো নিরাপত্তা নেই'
বেদুইন সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ দিন দিন আরো বাড়ছে। তারা এতদিন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে মানবিক সহায়তা পেয়ে আসছিলেন।
কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর এরিয়া সি-এর বেদুইনদের নিরাপত্তার জন্য ব্যবস্থা রাখা হয়নি। তাদের সহায়তা করা সম্প্রদায়ও আর এগিয়ে আসেনি।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ওয়াদি আল-সিকে যে তিন ফিলিস্তিন স্বেচ্ছাসেবক সহায়তা নিয়ে আসতেন তাদেরকে অবৈধ বসতি স্থাপনকারী এতটাই মারধর করে যে শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। সেখানে থাকা ইসরায়েলি শান্তি কর্মীদেরও মারধর করা হয়। সশস্ত্র ইসরায়েলিরা সবার মোবাইল কেড়ে নেয় এবং হামলার সমস্ত ছবি এবং ভিডিও ডিলেট করায়।
চেকপয়েন্ট বন্ধ থাকায় এবং নিরাপত্তার অভাবে বিদেশি মিশন কিংবা মানবাধিকার সংগঠনগুলো এরিয়া-সি তে প্রবেশ করতে পারছে না।
ইসরায়েলি মানবাধিকার সংগঠন বি'টিসেলেম এর কর্মী দ্রোর সাদোত বলেন, তাদের জন্য কোনো নিরাপত্তা নেই। আর বসতি স্থাপনকারীরা অবশ্যই এ বিষয়ে অবগত আছে।
বসতি স্থাপনকরাীদের চ্যাট গ্রুপের কিছু মেসেজ দেখতে পায় আল জাজিরা। যেখানে লেখা ছিল, রাস্তা… আরব শত্রুদের চলাচলে ক্ষেত্রে বন্ধ। তাদের কাছেও আসতে পারবে না।
আরেক চ্যাটে লেখা ছিল, সেনাবাহিনী বন্দুক ধরে রেখেছে, পথচারী কিংবা কোনো গাড়ি এগিয়ে গেলেই সাথে সাথে গুলি করা হবে।
ইসরায়েলি বাহিনীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তারা কোনো মন্তব্য করেনি।
'ফিলিস্তিনি শূন্য এলাকা'
৭ অক্টোবরের পর থেকে পশ্চিম তীরে প্রায় ৬৪ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এত মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি।
এক ভিডিওতে দেখা যায়, আল তাওয়ানি গ্রামে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী ঢুকে একদম সামনে থেকে এক ফিলিস্তিনিকে গুলি করছে। সাইর আল-গানুবে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিলে তিন পরিবার তাদের গ্রাম ছেড়ে চলে যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এরিয়া সি-এর মানবিক সহায়তার সমন্বয়ক বলেন, আমি অন্তত ২০টি সম্প্রদায় থেকে একই মেসেজ পেয়েছি। তারা বলছে, আমরা অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের আক্রমণের আতঙ্কে আছি।
যাদের গ্রামে এখনো হামলা হয়নি তাদেরকে আগেই হুশিয়ারি দিয়ে রাখা হচ্ছে। সেই সমন্বয়ক বলেন, এভাবে জোর করে তাদের বাস্তুচ্যুত করার মাধ্যমে জেরিকো এবং পূর্ব রামাল্লা এক সময় ফিলিস্তিনি শূন্য হয়ে উঠবে।
অধিকারকর্মী সাদোত বলেন, অবৈধ বসতি স্থাপনকারী কর্তৃক ফিলিস্তিনিদের ওপর সহিংসতা এবং ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় সহিংসতা একই বিষয়। তারা ফিলিস্তিন দখলের একটি অনানুষ্ঠানিক সশস্ত্র গোষ্ঠী।
তিনি আরো বলেন, আগেও তাদের লক্ষ্য একই ছিল (ফিলিস্তিন দখল), এবং এখনো একই আছে। সুতরাং যুদ্ধের মধ্যে তাদের প্রতি মনোযোগ না থাকার সুযোগ নিয়ে বসতি স্থাপনকারীরা গণহারে ভূমি দখল করছে।