অরণ্যের দিনরাত্রি......
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2023/10/24/img20231014120433.jpg)
সত্যজিৎ রায়ের কালজয়ী চলচ্চিত্র 'অরণ্যের দিনরাত্রি' দেখেছেন নিশ্চয়ই? সভ্যতা ও নগরায়নের বেড়াজালে নত হয়ে থাকা মনস্তত্ত্বকে মুক্ত করতে চার বন্ধু হারিয়ে গিয়েছিলো গভীর অরণ্যে। সিনেমাটি আমাকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলো। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে চাকরি শুরু করার পর নিজের কাছে একটি প্রতিজ্ঞা করে ফেলি। প্রতি সেমিস্টার শেষ হওয়ার সাথে সাথে সেমিস্টার ব্রেকের ছুটিতে ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়বো। নিজেকে এই যান্ত্রিকতা থেকে মুক্ত করতে যে করেই হোক, ঢাকার বাইরে একটা ঝটিকা সফর দিতেই হবে।
যেই ভাবা সেই কাজ। ব্যাটেবলে সব মিলে গেলো, পেয়ে গেলাম একটি তুখোড় ভ্রমণপিয়াসী দল। ঠিক করলাম সপ্তাহান্তে কোথাও ছুটে যাবো। তবে যে করেই হোক অরণ্যে হারিয়ে যাবো। তাই এই সীমিত সময়ে প্রাকৃতিক কোনো নৈসর্গিক পরিবেশ যদি থেকে থাকে তবে শ্রীমঙ্গলই শ্রেষ্ঠ। যেখানে গেলে আপনি একই সাথে পাহাড়, চিরহরিৎ বন আর শীতল ঝর্ণার এক অমায়িক মিশ্রণ আবিষ্কার করবেন। তাই সিদ্ধান্ত নেয়া হল ঘুরে আসবো চায়ের দেশ শ্রীমঙ্গলেই। উদ্দেশ্য একটু প্রাকৃতিক বিশুদ্ধ বাতাসে নিজেদের চাঙ্গা করে তোলা।
কিন্তু এতে আপত্তি জানালো বাকিরা। একই জায়গায় আবার যাবো! সব স্পট তো ঘোরা হয়ে গেছে। নতুন করে আর যেয়ে কী লাভ!!
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2023/10/24/img_20231014_113436.jpg)
অনেক ভাবনাচিন্তার পর শেষে সিদ্ধান্ত হল যাবো তো শ্রীমঙ্গলেই, তবে এবারে একটু ভিন্ন মায়াবি রূপটা আবিষ্কার করে আসবো। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম একদম নিস্তব্ধ নির্মল কোনো ঘন অরণ্যের মধ্যে সময় কাটালে কেমন হয়? অনেক গবেষণা করে বুকিং করে ফেললাম আরন্য নিবাস ইকো রিসোর্টে। মেয়েদের জন্য চার সিটের একটা কটেজ। একদিনে খরচ পড়েছে প্রায় ৭০০০ টাকা।
বৃহস্পতিবার রাত ১২টায় বাস ছেড়ে রওনা দেয় মৌলভিবাজারের উদ্দেশে। যথাসময়ে বাস গিয়ে পৌঁছালো সকাল ৭টা বেজে ১৫ মিনিটে। এরপর হাতমুখ ধুয়ে হালকা নাস্তা করে বেড়িয়ে পড়লাম শহরের আশেপাশের কিছু জায়গা ঘুরে বেড়াতে। তবে চায়ের দেশে গিয়ে সেখানকার চা কিন্তু মিস করা চলবে না! একটু হাঁপিয়ে উঠলেই এক কাপ চা আপনাকে মুহূর্তেই চাঙ্গা করে তুলবে।
আমরা ১০ জনের একটি গ্রুপ গিয়েছিলাম। পুরো একদিনের জন্য 'চান্দের গাড়ি' বুক করে নেই। ভাড়া পড়েছে জনপ্রতি ২০০ টাকা। এরপর গাড়ি আঁকাবাকা পথের ভেতর দিয়ে ছুটে বেড়ায়। দু'পাশে টিলা আর চা বাগানের সবুজ স্বর্গরাজ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলার জন্য তো এটাই যথেষ্ট।
নূরজাহান টি স্টেট
বলা হয়, শ্রীমঙ্গলের সবচেয়ে বড় চা বাগান হলো এই নূরজাহান টি স্টেট। সরু পথ বেয়ে যখন আমাদের লাল জিপ গাড়িটি চা বাগানে প্রবেশ করছিলো, তখন যেন মনে হচ্ছিলো সবুজের কার্পেটের উপর দিয়ে ছুটে চলা পথিক আমরা। তবে বাগানের ভেতরে এখন প্রবেশ নিষিদ্ধ। আমাদের পরিচয় দিয়েও লাভ হল না। তবে আমরাও হাল ছেড়ে দেবার মত না। কিছুটা ছেলেমানুষি না করলে কি আর হয়! গার্ডের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঠিকই একে একে বাগানের ভেতর ঢুকে পড়লাম। নানান ভঙ্গিতে ছবি তুলে কিছু স্মৃতির ভাণ্ডার নিয়ে বেরোলাম।
মাধবপুর লেক
আমাদের দ্বিতীয় স্পট ছিলো মাধবপুর লেক। কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়নে এর অবস্থান। জায়গাটিতে পাহাড় বন ও পানির এক বুনো নৈসর্গিক সৌন্দর্য আপনাকে অবশ্যই বিমোহিত করবে। ঢুকতেই চোখে পড়েছে চা শ্রমিকদের খুনসুটির দৃশ্যগুলো। একদিকে শিশুদের চাঞ্চল্যে মুখরিত প্রাঙ্গণ, অপরদিকে দেখা যাচ্ছে ক'জন নারী দুপুরের খাবারের আয়োজন করছে। হঠাৎ চোখে পড়লো একদল নারী বেশ ব্যতিক্রমী খাবারের আয়োজন করছে। এক দল পেঁয়াজ আর শুকনো মরিচ মাখাচ্ছে আর আরেকদল হাত দিয়ে কচি সবুজ চায়ের পাতাগুলো পিষছিলো। এরপর সেগুলো একসাথে মাখিয়ে একটি বিশেষ ভর্তা বানিয়ে তারা মধ্যাহ্নভোজনের কাজ সারলো। চলতে চলতে কথা হলো এক ষাটোর্ধ্ব মুরুব্বি চাচার সাথে। তিনি বংশপরম্পরায় এই বাগানে চা পাতা সংগ্রহের কাজ করে আসছেন। কিন্তু মজুরি যৎসামান্য। আর বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে এই উপার্জনে ভালোমন্দ খাওয়া এখন তাদের কাছে বিলাসিতা। তাই বাধ্য হয়ে চা পাতা দিয়ে তৈরি এই বিশেষ ভর্তা দিয়েই তাদের উদরপূর্তি করতে হয়।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2023/10/24/img_20231013_1023041.jpg)
এরমধ্যে টুকটাক গল্পসল্প করার মাঝে ৯-১০ বছর বয়সী একটি ছোট্ট ছেলে হাতে করে একটি বেগুনি রঙের শাপলা তুলে নিয়ে আসলো। পুরো লেক ছেয়ে আছে গাড় বেগুনি রঙের শাপলায়। যেন কেউ স্বর্গরাজ্যের উপর বেগুনি চাদর আচ্ছাদন করে দিয়েছে। আর লেকের পানির স্বচ্ছতা আপনার আত্মা ও মনকে প্রশান্ত করে তোলবে নিশ্চিত।
ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ মনে পড়লো আমাদের রিসোর্টে চেক ইন করার সময় হয়ে গেছে। তাই দ্রুত সবাই গাড়িতে চেপে বসি। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিলো। শুরু হল আরেক রোমাঞ্চকর জার্নি।
চা বাগানের মাঝে দিয়ে আমাদের গাড়ি প্রস্থান করতে থাকে। এরপর শহর ছেড়ে আমরা যতই ভেতরে ঢুকতে থাকি ততই আমরা এক অন্যরকম শ্রীমঙ্গলকে আবিষ্কার করতে লাগি। ছোট ছোট টিলার মধ্য দিয়ে সাপের মত অলিগলি রাস্তা। দু'পাশে সারি সারি গাছ। আর অনেক দূর অব্দি কিছু ছোট ছোট লোকালয়। চায়ের রাজ্যের মাঝে এ যেন ভিন্ন এক নির্যাসের অনুভূতি। দু'পাশে সুবিশাল ধানক্ষেত, বাতাসে ঢেউ খেলে নাচছিলো কচি সবুজ ধানের চারা। ঢাকার এই জঞ্জাল ছেড়ে এসব দেখে নিজেকে মনে হচ্ছিলো অন্য এক আমি।
আরন্যনিবাস ইকো রিসোর্ট
বেলা বাজে প্রায় আড়াইটা। ভীষণ লড়াই করে গুগল ম্যাপ অনুসরণ করে খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম কাঙ্ক্ষিত আরন্যনিবাস ইকো রিসোর্ট। দ্রুত সব আনুষঙ্গিকতা শেষ করে চেক ইন করলাম। বরণ করে নিলো ঠান্ডা একগ্লাস ওয়েলকাম ড্রিংক দিয়ে। তবে নামে রিসোর্ট হলেও জায়গাটা একটা বিশাল ফার্ম হাউজের হাইব্রিড ভার্সন বলা যায়। রিসিপশন ছেড়ে কটেজের দিকে হেঁটে যাওয়ার পথটুকু আপনাকে অন্যরকম অনুভূতি দেবে। হাতের একপাশে ঘন সবুজ জঙ্গল আর আরেকপাশে ইকো কটেজ। আর হেটে যাওয়ার রাস্তাটাও ভীষণ রোমাঞ্চকর। উঁচুনিচু টিলা পেরিয়ে আমরা কটেজ খুঁজে পেলাম। হাতের দু পাশে অসংখ্য প্রজাতির গাছ। আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল ট্রি হাউজগুলো। ঘুরতে গিয়েও নিজেকে একটু আলাদা করে সময় দিতে কিংবা বন্ধুদের সাথে জম্পেশ আড্ডা দিতে হলে এই ট্রি হাউজ আপনার জন্য বেস্ট চয়েজ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা গান আর সাথে চায়ের দেশের তরতাজা কড়া লিকারের চা...সুখী হতে চাইলে এর চেয়ে বেশি কিছুর প্রয়োজন আছে কি?
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2023/10/24/fb_img_1697294095938.jpg)
তপ্ত গরমে ঘুরে এসে ভীষণ হাঁসফাঁস হচ্ছিলো। তাই সময় নষ্ট কিসের! দ্রুত পোশাক পালটে ঝপাঝপ করে লাফিয়ে নেমে পড়লাম বিশাল সুইমিং পুলে। সুইমিং পুলে কিডস জোনও আছে। চাইলে শিশুরাও সেখানে নামতে পারে। প্রায় দু'ঘণ্টা সেখানে আয়েশ করে গা ভিজিয়ে উঠলাম।
এরপর বিকেলবেলা বেড়িয়ে পড়লাম পুরো রিসোর্ট ঘুরে বেড়াতে। শুরুতে ভাবি নি ভেতরে এত বড় জায়গা আছে। মূল টিলাগুলোতে কটেজ নির্মাণ করা হয়েছে। মূল টিলা বেয়ে নিচে নামতেই চোখে পড়লো সারি সারি পডহাউজ। এবার আরেকটু নিচের দিয়ে বেয়ে নামলাম। এবারে চোখে পড়লো সুবিশাল আনারসের বাগান। ক্যাডেট কলেজের সেই অভ্যাস কি এত সহজে ভোলা যায়? কিছুক্ষণ আনারস তোলার ব্যর্থ চেষ্টাও চালালাম। যদিও সফল না হয়ে ফিরে এলাম।
এবার টিলা বেয়ে উপরে উঠে আসলাম। সুইমিংপুল পার হয়ে অপর পাশে টিলা বেয়ে নিচে নেমে দেখি বিশাল মুক্তমঞ্চ। উন্মুক্ত মঞ্চে আপনিও চাইলে গলা ছেড়ে গান ধরতে পারেন, আজ যেন হারিয়ে যেতে নেই কোনো মানা।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2023/10/24/img_20231014_114016.jpg)
সবমিলিয়ে অসাধারণ কিছু সময় কাটাতে হলে পরিবার বা বন্ধু নিয়ে ঢুঁ মেরে আসতে পারেন। সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে তাদের রিসোর্টের সব ব্যবস্থা অত্যন্ত পরিবেশবান্ধব। কোনো ইট-পাথরের স্পর্শ নেই। এমনকি খাবার পরিবেশন করতেও আপনার সামনে হাজির করা হবে মাটির পাত্র। অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন আর পরিকল্পিত ছিমছাম এই জায়গাটি খুব কম সময়ে আপনার মন কেড়ে নিবে নিশ্চিত। তবে রিসোর্টটি মূল শহর থেকে অনেক দূরে অবস্থান করায় ফিরতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। তবে বন্ধু থাকলে চিন্তা কিসের? একটি মিনি ভ্যানে চেপে হৈ হুল্লোড় করতে করতে শ্রীমঙ্গল শহরে এসে ঢাকার উদ্দেশে রওনা করে দেই। এভাবেই শেষ হলো আমার স্বল্পদৈর্ঘ্য ট্যুর কাহিনী…
লেখক: প্রভাষক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)