বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি পেতে সহায়তার আহ্বান ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর
ন্যূনতম মজুরি ২৩ হাজার টাকা করার দাবিতে সম্প্রতি দেশের গার্মেন্টস শ্রমিকেরা আন্দোলন করছে। এরই মাঝে গত ৩০ অক্টোবর সংঘাতে রাসেল হাওলাদার নামের গাজীপুরের পোশাক কারখানা ডিজাইন এক্সপ্রেস লিমিটেডের এক কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে। একইসাথে নানা জায়গায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে বেশ কয়েকবার সংঘর্ষেও জড়িয়েছে গার্মেন্টস কর্মীরা।
ঘটনাটিকে ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইন (সিসিসি) এর পক্ষ থেকে 'গার্মেন্টস শ্রমিকদের উপর সহিংস নিপীড়ন' বলে উল্লেখ করা হয়েছে। একইসাথে চলমান পরিস্থিতির নিন্দা জানিয়েছে অ্যাপারেল লেবার ইউনিয়ন অ্যালায়েন্স হিসেবে কাজ করা এই সংগঠনটি।
সিসিসি'র পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) গার্মেন্টস সেক্টরে নতুন ন্যূনতম মজুরি ১০,৪০০ টাকা নির্ধারণে প্রস্তাব পেশ করেছে। কিন্তু এটি ট্রেড ইউনিয়নের দাবিকৃত বেতনের প্রায় অর্ধেক।
সিসিসি মনে করে, চলতি বছরের মজুরি বৃদ্ধিতে চলমান আন্দোলনে দমন-পীড়ন 'অভূতপূর্ব পর্যায়ে' পৌঁছেছে। যার ধারাবাহিকতায় আরও একজন গার্মেন্টস কর্মী নিহত হয়েছে।
সংগঠনটি মনে করে, বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানি করা ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে চলমান আন্দোলনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করা উচিত। তবে শ্রমিকরা যখন তাদের দাবি আদায়ে সোচ্চার হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে আন্দোলন করছে, তখন বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানি করা ব্র্যান্ডগুলো এই ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই বলছে না।
তাই ট্রেড ইউনিয়ন ও সিসিসির পক্ষ থেকে ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোকে ২৩ হাজার টাকা মাসিক মজুরির শ্রমিকদের দাবির পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে বিবৃতি প্রদানে আহ্বান করা হয়েছিল। তবে সেই আহ্বান উপেক্ষা করে তারা বিবৃতি প্রদানে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
সিসিসি'র পক্ষ থেকে বলা হয়, ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো কোড অফ কন্ডাক্ট এবং স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক মজুরি নির্ধারণ কাঠামোর প্রতি প্রতিশ্রুতিবন্ধ। কিন্তু তা সত্ত্বেও মজুরি নির্ধারণে শ্রমিকদের যে দাবি, সেটিতে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে ব্র্যান্ডগুলো ব্যর্থ হয়েছে।
ন্যূনতম মজুরির দাবিতে পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলনে হওয়া সহিংসতার নিন্দা জানাতে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা সকল পোশাক ব্র্যান্ডের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সিসিসি। একইসাথে ন্যায্য মূল্য নির্ধারণের শ্রমিকদের প্রতিশ্রুতি প্রদান, স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়নের দাবি মজুরি বোর্ডের কাছে তুলে ধরা এবং শ্রমিক সংগঠনের স্বাধীনতার অধিকার সুরক্ষিত করতে ব্র্যান্ডগুলোকে সহযোগিতা প্রদানের আহ্বান জানানো হয়।
অন্যদিকে স্পোর্টস জায়ান্ট ব্র্যান্ড এডিডাস, মার্কিন ফ্যাশন ব্র্যান্ড লেভি স্ট্রাউস এন্ড কো এর পক্ষ থেকে গত মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে যৌথভাবে চিঠি পাঠানো হয়। ঐ চিঠিতে সমস্ত স্টেকহোল্ডারদের মতামত নিয়ে দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে এমন ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে অনুরোধ করা হয়।
চিঠিতে স্বাক্ষর করা ব্র্যান্ডগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হয়, করোনা মহামারী, পরবর্তীতে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে একটি চূড়ান্ত বর্ধিত ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা উচিত।
অন্যদিকে গত ২৫ অক্টোবর গার্মেন্টস শ্রমিকের প্রস্তাবিত মজুরি নিয়ে ঢাকার সেগুনবাগিচায় ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের কার্যালয়ে চতুর্থ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে পোশাক কারখানার মালিকদের পক্ষ থেকে ন্যূনতম মজুরি হিসাবে প্রস্তাবিত পরিমাণের প্রায় অর্ধেক প্রস্তাব করা হয়।
সিসিসির বিবৃতিতে বলা হয়, মালিক পক্ষের কাছ থেকে এত অল্প পরিমাণ মজুরির প্রস্তাব খুবই হতাশাজনক। এক্ষেত্রে মজুরি নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় শ্রমিকদের দাবিগুলি আবার উপেক্ষা করা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশ শ্রম আইন ও ন্যূনতম মজুরি সম্পর্কিত আইএলও কনভেনশন ১৩১ এর অধীনে নির্ধারিত মানদণ্ডের পূরণের কথা রয়েছে।
সিসিসি আশঙ্কা করছে যে, মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে পোশাক শ্রমিকদের চলমান আন্দোলন আরও সহিংস আকার ধারণ করতে পারে। কেননা পাঁচ বছর আগেও একই দাবিতে অনুরূপ পরিস্থিতির তৈরি হয়েছিল।
সিসিসির বিবৃতিতে বলা হয়, "আমরা বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে চলমান সহিংসতা বন্ধ করার আহ্বান জানাই। কেননা তাদের বাংলাদেশের আইনে বিক্ষোভ করার অধিকার রয়েছে। পাঁচ বছর আগে একই দাবিতে শ্রমিকদের সাথে যা ঘটেছিল, সেই একই ঘটনা পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা করছি।"
এদিকে গত ৩১ অক্টোবর বিজিএমইয়ের পক্ষ থেকে সদস্যভুক্ত গার্মেন্টস মালিকদের ফ্যাক্টরি বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এক্ষেত্রে যুক্তি হিসেবে গার্মেন্টস কর্মীদের জীবন ও ফ্যাক্টরির মালামাল রক্ষার বিষয়টিকে উল্লেখ করা হয়। কেননা এই ঘটনার জেরেই সম্প্রতি দুই গার্মেন্টস কর্মী নিহত হয়েছে এবং একটি ফ্যাক্টরিতে আগুন দেওয়া হয়েছে।
এদিকে ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আশুলিয়ায় চলমান শ্রমিক আন্দোলনের ৭ম দিনে আজ (৪ নভেম্বর) সকাল থেকে আবারও বিক্ষোভ শুরু করেছে বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশের ছোঁড়া স্প্লিন্টার ইত্যাদির আঘাতে আহত হয়েছে অন্তত তিন জন।
রোববার (৪ নভেম্বর) সকালে আশুলিয়ার জামগড়া-ছয়তলা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এলাকাটির বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা সকাল সাড়ে ৭টার দিকে কারখানায় প্রবেশ করলেও কারখানায় কাজ না করে হাজিরা কার্ড পাঞ্চ করে কারখানা থেকে বেরিয়ে যায়।
পরে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে শ্রমিকরা জামগড়া-ছয়তলা এলাকার বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে।
এক পর্যায়ে শ্রমিকেরা সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর সড়কে নেমে সড়ক অবরোধের চেষ্টা করলে ও বিভিন্ন কারখানার সামনে অবস্থান নেওয়া পুলিশ সদস্যদের লক্ষ্য করে ইট পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করলে পুলিশ ধাওয়া দেওয়ার পাশাপাশি টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এরপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
এদিকে বিজিএমইএর পক্ষ থেকে পাঠানো এক বার্তায় জানানো হয়েছে, আজ (শনিবার) সকাল থেকেই টঙ্গী, বোর্ডবাজার, গাজীপুর চৌরাস্তা, মৌচাক, কালিয়াকৈর, শ্রীপুর, মাওয়ায় সব কারখানা চলছে। একইসাথে রাজধানীর মিরপুরসহ পুরো ডিএমপি এলাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের কারখানাগুলোও চলছে।